জ্যামিতি কাকে বলে? জ্যামিতি কত প্রকার ও কি কি?

জ্যামিতির মৌলিক ধারণা :-

জ্যামিতি গণিত শাস্ত্রের একটি অন্যতম শাখা। জ্যামিতি বলতে বুঝায় আকার-প্রকৃতি এবং স্থান-অবস্থানের বিজ্ঞান। জ্যামিতি বা Geometry শব্দের আভিধানিক অর্থ ভূমি পরিমাপ। প্রায় আড়াই হাজার বৎসর পূর্বে ৩০০ খ্রিষ্ট পূর্বাব্দে মিশরে ভূমি চিহ্নিত করার কাজে জ্যামিতি ব্যবহৃত হতো।

মানুষ যখন থেকে আকার, আকৃতি, অবস্থান সম্পর্কে অবহিত হল, তখন এসব জ্ঞান শৃঙ্খলাবদ্ধ করে জ্যামিতি শাস্ত্রের উদ্ভব হল। গ্রিক পণ্ডিত ও গণিতবিদ ইউক্লিড সর্বপ্রথম জ্যামিতির বিভিন্ন সূত্রকে সুবিন্যস্ত করে তাঁর 'এলিমেন্টস' (Elements) গ্রন্থের তের খণ্ডে জ্যামিতির ধারণা শ্রেণীবদ্ধ করেন। এলিমেন্টস গ্রন্থটিই আধুনিক জ্যামিতির ভিত্তি।

জ্যামিতি আমাদের চারপাশের বিশ্বের আকার, আয়তন, দূরত্ব এবং অবস্থান সম্পর্কে ধারণা দেয়। এটি সাধারণ জীবনেও ব্যবহৃত হয়, যেমন ভবন নির্মাণ, সড়ক-মহাসড়ক নির্মাণ, ভূমি মাপার ক্ষেত্রে। জ্যামিতির বিভিন্ন শাখা রয়েছে যেমন ইউক্লিডিয়ান জ্যামিতি, প্রক্রিয়াজাত জ্যামিতি, রেশজাত জ্যামিতি ইত্যাদি।
 
আরও পড়ুনঃ সংখ্যা কাকে বলে? 

এই পোস্টে আমি জ্যামিতি কাকে বলে এবং তার বিভিন্ন শাখা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করবো এবং জীবনে জ্যামিতির প্রয়োগ নিয়েও আলোচনা করবো। আশা করি পোস্টটি আপনার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে।

জ্যামিতি শব্দের অর্থ :-

জ্যামিতির ইংরেজি অর্থ হলো Geometry। 'Geometry' শব্দটি গ্রীক Geo অর্থ ভূমি (Earth) ও Metrein অর্থ পরিমাপ (Measure) শব্দের সমন্বয়ে গঠিত। ব্যুৎপত্তিগতভাবে 'জ্যামিতি' বা 'Geometry' শব্দের অর্থ 'ভূমি পরিমাপ' ।

কৃষিভিত্তিক সভ্যতার যুগে ভূমি বা জমি পরিমাপের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের প্রয়োজনেই জ্যামিতি শাস্ত্রের উদ্ভব হয়। তবে জ্যামিতি কেবলমাত্র ভূমি পরিমাপের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং গণিত শাস্ত্রের একটি অন্যতম শাখা হিসেবে অনেক জটিল গাণিতিক সমস্যা সমাধানে ও ব্যাখ্যাদানে বিশেষ প্রয়োজনীয় বলে প্রতিপন্ন হয়েছে।

জ্যামিতি কাকে বলে :-

বিন্দু, রেখা, তল ইত্যাদি সংযুক্ত করে যে সকল চিত্র অঙ্কিত হয় তাদের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কিত পাঠকে জ্যামিতি বলে।

উদাহরণস্বরূপ কোণ, ত্রিভুজ, চতুর্ভূজ ইত্যাদি সরলরেখ ক্ষেত্রসমূহ এবং বৃত্ত, অধিবৃত্ত, উপবৃত্ত ইত্যাদি চিত্র সম্পর্কিত অঙ্কন এবং উপপাদ্য সম্পর্কিত পাঠকে জ্যামিতি বলে।

জার্মান গণিতবিদ এফ ক্লেইন (F. Klein) এর মতে, জ্যামিতিক চিত্রের যে সকল ধর্ম ও বৈশিষ্ট্য তার রূপান্তরের (Transformation) ফলে পরিবর্তিত হয় না, সে সকল বৈশিষ্ট্য সম্পর্কিত পাঠকে জ্যামিতি বলা হয়।

জ্যামিতিক চিত্রের রূপান্তর বলতে তার প্রতিফলন (Reflection), ঘূর্ণন (Rotation) এবং সমান্তরাল অপসারণকে (Translation) বুঝায়।

জ্যামিতি কত প্রকার ও কি কি :-

জ্যামিতি ব্যবহার, পরিমাপের ভিত্তিতে নানা ধরনের হতে পারে। যেমন -

ব্যবহার ভিত্তিতে জ্যামিতি কত প্রকার ও কি কি:

জ্যামিতিকে ব্যবহার ভিত্তিতে দুই ভাগে ভাগ করা যেতে পারে:

1. ব্যবহারিক জ্যামিতি কাকে বলে:

এটি হল জ্যামিতির ঐ অংশ যেখানে বিভিন্ন জ্যামিট্রিক শিল্পকলা এবং চিত্রায়নের ব্যবহার করা হয়। এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে বিন্দু, রেখা, কোণ, আকৃতি ইত্যাদির চিত্রায়ন এবং বিশ্লেষণ।

ব্যবহারিক জ্যামিতি বলতে বোঝায় জ্যামিতির সেই অংশ যেখানে বিভিন্ন জ্যামিট্রিক ধারণা ও চিত্রায়ন করা হয় এবং প্রকৃত জগতে প্রয়োগ করা হয়।

ব্যবহারিক জ্যামিতির বৈশিষ্ট্য:
  • - এটি বিভিন্ন জ্যামিট্রিক আকৃতি যেমন বিন্দু, রেখা, কোণ, আয়তক্ষেত্র, বৃত্তাকার ইত্যাদির চিত্রায়ন শিখিয়ে দেয়।
  • - এর মাধ্যমে বাস্তবের বিভিন্ন জিনিসের আকার-প্রকৃতির ধারণা লাভ করা যায়।
  • - এটি জ্যামিট্রিক সরঞ্জাম ব্যবহারের মাধ্যমে নকশা ও মাপকাঠিতে মাপ নেওয়ার পদ্ধতি শেখায়।
  • - ব্যবহারিক জ্যামিতি দৈনন্দিন জীবনে প্রয়োজনীয় যেমন নির্মাণ কাজ, সড়ক নির্মাণ, ভূমি মাপানো ইত্যাদি।
  • - এর মূল লক্ষ্য হল শিক্ষার্থীদের জ্যামিট্রিক ধারণা সহজে উপলব্ধি করানো।

সংক্ষেপে, ব্যবহারিক জ্যামিতি জ্যামিতির ঐ অংশ যেখানে বাস্তব জীবনে প্রয়োগ ও জ্যামিট্রিক ধারণা লাভের উপর গুরুত্ব দেয়া হয়।

2. তাত্ত্বিক জ্যামিতি কাকে বলে:

এটি হল গণিতের ঐ অংশ যেখানে জ্যামিট্রিক উপাদানগুলো ব্যবহার করে প্রমেয়, নিয়ম এবং তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করা হয় যা প্রমাণ দ্বারা সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়।

তাত্ত্বিক জ্যামিতি বলতে বোঝায় জ্যামিতির সেই অংশ যেখানে জ্যামিট্রির বিভিন্ন উপাদান ব্যবহার করে প্রমেয়, নিয়ম ও তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করা হয়।

তাত্ত্বিক জ্যামিতির কিছু বৈশিষ্ট্য:
  • - এটি জ্যামিট্রির বিভিন্ন উপাদান যেমন বিন্দু, রেখা, কোণ, আয়তন ইত্যাদি নিয়ে কাজ করে।
  • - এর মাধ্যমে জ্যামিট্রিক উপাদানগুলো ব্যবহার করে বিভিন্ন প্রমেয়, নিয়ম, ও তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করা হয়।
  • - এই প্রমেয় এবং তত্ত্বগুলো যুক্তি ও প্রমাণের মাধ্যমে সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়।
  • - এর মাধ্যমে নতুন তত্ত্ব খুঁজে বের করা যায় এবং জ্যামিট্রির বিভিন্ন উপাদানের মধ্যে সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যায়।
  • - এটি মূলত গণিতবিদদের জন্য প্রযোজ্য।

সংক্ষেপে, তাত্ত্বিক জ্যামিতি হল জ্যামিতির ঐ অংশ যেখানে প্রমেয় এবং তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা ও প্রমাণের উপর গুরুত্ব দেয়া হয়।

আরও পড়ুনঃ তল কাকে বলে?

পরিমাপের ভিত্তিতে জ্যামিতি কত প্রকার ও কি কি:

পরিমাপের ভিত্তিতে জ্যামিতি দুই প্রকার। যথা

1. সমতল জ্যামিতি এবং
2. ঘন জ্যামিতি

1. সমতল জ্যামিতি কাকে বলে:

সমতল জ্যামিতি হল জ্যামিতির সেই শাখা যেখানে দ্বিমাত্রিক আকৃতি এবং চিত্রায়নের উপর কাজ করা হয়। এবং এদের দৈর্ঘ্য ও ক্ষেত্রফল পরিমাপ করা হয়।

এর কিছু বৈশিষ্ট্য:
  • - এটি মূলত দুই দিক বিশিষ্ট জ্যামিট্রিক চিত্র এবং আকৃতি নিয়ে কাজ করে।
  • - এর মধ্যে রয়েছে বিন্দু, রেখা, কোণ, ত্রিভুজ, চতুর্ভুজ এবং বৃত্ত ইত্যাদি।
  • - এই জ্যামিট্রিক উপাদানগুলোর দৈর্ঘ্য, পরিমাপ, ক্ষেত্রফল ইত্যাদি হিসাব করা হয়।
  • - এতে সরল রেখা, কোণ, ত্রিভুজন ইত্যাদির সম্পর্কে নিয়ম, প্রমেয় ও তত্ত্বের প্রতিষ্ঠা করা হয়।
  • - এটি স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের শেখানো হয়।
  • - এর ব্যবহার রয়েছে সড়ক নির্মাণ, ভূমি মাপ, নকশাকরণ ইত্যাদিতে।

সংক্ষেপে, সমতল জ্যামিতি হল দ্বিমাত্রিক জ্যামিট্রির উপর ভিত্তি করে গঠিত জ্যামিতির একটি শাখা যার বিভিন্ন ব্যবহারিক প্রয়োগ রয়েছে।

2. ঘন জ্যামিতি কাকে বলে:

ঘন জ্যামিতি বলতে বোঝায় ত্রিমাত্রিক বা ত্রিদিমেনশনাল জ্যামিতি। ত্রিমাত্রিক বলতে দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও উচ্চতা বা বেধকে বুঝায়।

এর কিছু বৈশিষ্ট্য:
  • - এটি তিনটি দিক - দৈর্ঘ্য, প্রস্থ এবং উচ্চতা বিবেচনায় নেয়।
  • - এখানে বিভিন্ন ঘনবস্তু যেমন কুব, ঘনক, পিরামিড, গোলক, সিলিন্ডার ইত্যাদির উপর কাজ করা হয়।
  • - এসব ঘনবস্তুর আয়তন, পৃষ্ঠপ্রস্থ, উচ্চতা ও অন্যান্য মাপকাঠি গণনা করা হয়।
  • - বিভিন্ন ঘনবস্তুর মধ্যে সম্পর্ক খুঁজে নিয়ম ও প্রমেয় প্রতিষ্ঠা করা হয়।
  • - এর ব্যবহার রয়েছে বাস্তুনির্মাণ, প্রকৌশল বিজ্ঞান, শিল্পকলা ইত্যাদিতে।
  • - এটি মূলত ত্রিমাত্রিক জগৎ সম্পর্কে ধারণা দেয়।

সংক্ষেপে, ঘন জ্যামিতি হল ত্রিমাত্রিক জ্যামিতির একটি শাখা যেখানে ঘনবস্তুর উপর কাজ করা হয়।

জ্যামিতির বিভিন্ন ধারণা:-

জ্যামিতির উপাদান কাকে বলে:

বিন্দু, রেখা এবং তল এদের বৈশিষ্ট্য বা সম্পর্ক এবং বিন্দু, রেখা বা তল দ্বারা সৃষ্ট জ্যামিতিক চিত্র বা ক্ষেত্র এবং তাদের সম্পর্ক বা বৈশিষ্ট্য হল জ্যামিতির উপাদান।

উপপাদ্য কাকে বলে:

জ্যামিতিক উপাদান সম্পর্কিত কোন সত্য, তাদের বৈশিষ্ট্য বা সম্পর্ক যুক্তির সাহায্যে প্রমাণ করার প্রস্তাবকে উপপাদ্য বলা হয়।

সম্পাদ্য কাকে বলে:

জ্যামিতিক চিত্র অঙ্কন বা বিভাজন সম্পর্কিত প্রস্তাবকে সম্পাদ্য বলা হয়।

জ্যামিতিক প্রমাণ:

কোন জ্যামিতিক তত্ত্বকে প্রমাণ করতে হলে কিছু প্রাথমিক ধারণা, সংজ্ঞা এবং স্বীকার্যের মাধ্যমে ঐ তত্ত্ব সম্পর্কিত বিভিন্ন উক্তি ধাপে ধাপে যৌক্তিকভাবে প্রমাণ করতে হয়। এরূপ উক্তিকে সাধারণ প্রতিজ্ঞা বলা হয়।

জ্যামিতিক প্রমাণে বিভিন্ন তথ্য চিত্রের সাহায্যে বর্ণনা করা হয়। জ্যামিতিক প্রমাণ অবশ্যই যুক্তি নির্ভর হতে হবে।

জ্যামিতিক প্রতিজ্ঞা বর্ণনায় সাধারণ নির্বাচন (General enunciation) এবং বিশেষ নির্বচন (Particular enunciation) ব্যবহার করা হয়। সাধারণ নির্বাচন হচ্ছে চিত্র নিরপেক্ষ বর্ণনা এবং বিশেষ নির্বচন হচ্ছে চিত্র নির্ভর বর্ণনা।

কোন প্রতিজ্ঞায় সাধারণ নির্বচন দেওয়া থাকলে প্রতিজ্ঞার বিষয়বস্তু চিত্রের সাহায্যে বিশেষ নির্বচনে রূপান্তরিত করা যায়। এজন্য চিত্র অঙ্কন করতে হয়। জ্যামিতিক উপপাদ্যের আলোচনায় সাধারণত নিম্নলিখিত ধাপগুলো থাকে।

(ক) সাধারণ নির্বচন

(খ) বিশেষ নির্বাচন

(গ) প্রয়োজনীয় অঙ্কনের বর্ণনা

(ঘ) প্রমাণের যৌক্তিক ধাপগুলোর বর্ণনা।

যদি কোন প্রতিজ্ঞা সরাসরিভাবে একটি উপপাদ্যের সিদ্ধান্ত থেকে প্রমাণিত হয়, তবে তাকে অনেক সময় ঐ উপপাদ্যের অনুসিদ্ধান্ত (Corollary) হিসেবে উল্লেখ করা হয়। জ্যামিতিক সম্পাদ্যের আলোচনায় চিত্র অংকন করে চিত্রের বর্ণনা এবং যৌক্তিকতা উল্লেখ করতে হয়।

জ্যামিতির উপাদান সমূহ :-

স্থান (Space) :

আপনারা আপনাদের চারপাশে সামনে, পিছনে, বামে, ডানে, উপরে, নিচে যে দিকেই তাকান দেখা যায় সীমাহীন বিস্তৃত জায়গা। জ্যামিতিক ধারণায় সীমাহীন এই বিস্তৃতিকে বলা হয় স্থান (Space)।

স্থানের বিভিন্ন অংশ জুড়ে রয়েছে ছোট বড় নানারকম বস্ত্র। বিভিন্ন বস্তু স্থানের যে অংশ জুড়ে থাকে সেই স্থানের আকার, আকৃতি, অবস্থান, বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি থেকেই জ্যামিতিক ধারণার উদ্ভব।

ঘনবস্তু (Solid):

কোনো জাগতিক বস্তু যে স্থান দখল করে থাকে, তা তিন দিকে বিস্তৃত। এ তিন দিকের বিস্তার বস্তুটির তিনটি মাত্রা (Three dimension) দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও উচ্চতা নির্দেশ করে। সেজন্য প্রত্যেক ত্রিমাত্রিক (three-dimensional) বস্তুকে বলা হয় ঘনবস্তু (Solid)।

যেমন, একটি ইট বা বাক্সের তিনটি মাত্রা দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও উচ্চতা আছে। একটি বল বা গোলকেরও তিনটি মাত্রা আছে। এর তিন যাত্রার অভিন্নতা স্পষ্টভাবে বোঝা না গেলেও একে দৈর্ঘ্য-প্রস্থ-উচ্চতা বিশিষ্ট। খণ্ডে বিভক্ত করা যায়। এগুলো ঘনবস্তু।

তল (Surface) :

ঘনবস্তুর উপরিভাগকে তল (Surface) বলা হয়। প্রত্যেক ঘনবস্তু এক বা একাধিক তল দ্বারা সীমাবদ্ধ থাকে।

যেমন, একটি ইট বা বাক্সের ছয়টি পৃষ্ঠ ছয়টি তলের প্রতিরূপ। আবার, বল বা গোলকের উপরিভাগও একটি তল। তবে বাক্সের পৃষ্ঠতল ও গোলকের উপর তল ভিন্ন প্রকারের। বাক্সের পৃষ্ঠতল হচ্ছে সমতল (Plane Surface) এবং গোলকের উপর তল হচ্ছে বক্রতল (Curved Surface)।

তলের শুধু দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ আছে, কোনো উচ্চতা নাই। কাজেই তল দ্বিমাত্রিক (Two-dimensional)। একটি বাক্সের দুইটি মাত্রা ঠিক রেখে তৃতীয় মাত্রা অর্থাৎ উচ্চতা ক্রমশ হ্রাস করে শূন্যে পরিণত করলে বাক্সটির পৃষ্ঠবিশেষ শুধু অবশিষ্ট থাকে। এভাবে ঘনবস্তু থেকে তলের ধারণায় আসা যায়।

রেখা (Line) :-

দুইটি তল পরস্পরকে ছেদ করলে ছেদস্থলে একটি রেখা ( Line) উৎপন্ন হয়।

যেমন, বাক্সের দুইটি পৃষ্ঠতল বাক্সের এক ধারে একটি রেখায় মিলিত হয়। এই রেখা একটি সরলরেখা (Straight Line)।

একটি লেবু বা গোলাকার বস্তুকে একটি পাতলা ছুরি দিয়ে কাটলে, চুরির সমতল যেখানে লেবুর বক্রতলকে ছেদ করে সেখানে একটি বক্ররেখা (Curved Line ) উৎপন্ন হয়।

রেখার শুধু দৈর্ঘ্য আছে, প্রস্থ ও উচ্চতা নাই। কাজেই রেখা একমাত্রিক (One-dimensional)। বাক্সের একটি পৃষ্ঠতলের প্রস্থ ক্রমশ হ্রাস পেয়ে সম্পূর্ণ শূন্য হলে, ঐ তলের একটি রেখা শুধু অবশিষ্ট থাকে। এভাবে তলের ধারণা থেকে রেখার ধারণায় আসা যায়।

বিন্দু (Point)

দুইটি রেখা পরস্পর ছেদ করলে বিন্দুর সৃষ্টি হয়। অর্থাৎ, দুইটি রেখার ছেদস্থান বিন্দু (Point) দ্বারা নির্দিষ্ট হয়।

যেমন, বাক্সের দুইটি ধার বাক্সের এক কোনায় একটি বিন্দুতে মিলিত হয়। বিন্দুর দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও উচ্চতা নাই, শুধু অবস্থান আছে।

একটি রেখার দৈর্ঘ্য ক্রমশ হ্রাস পেয়ে অবশেষে শূন্য হলে, একটি বিন্দু শুধু অবশিষ্ট থাকে। বিন্দুকে শূন্য মাত্রার সত্ত্বা (Entity) বলে গণ্য করা হয়।

ইউক্লিড জ্যামিতির স্বীকার্য ও স্বতঃসিদ্ধ :-

যেকোনো গাণিতিক আলোচনায় কতকগুলো প্রাথমিক তথ্য বা ধারণা স্বীকার করে নিতে হয়। এসব প্রাথমিক তথ্যের সত্যতা বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে উপলব্ধি করা যায়। প্রমাণ ছাড়া যে প্রাথমিক সত্যগুলো মেনে নিতে হয়, তাদেরকে স্বীকার্য (Postulate) বলে। অর্থাৎ, স্বীকার্য হলো স্ব-প্রকাশিত সত্য (Self-evident truth)। জ্যামিতিতে বিন্দু, রেখা ও তলকে প্রাথমিক ধারণা হিসেবে স্বীকার করে নেওয়া হয়।

ইউক্লিড জ্যামিতিক সংজ্ঞা:

ইউক্লিড তাঁর 'ইলিমেন্টস' গ্রন্থের প্রথম খণ্ডের শুরুতেই বিন্দু, রেখা ও তলের যে 'সংজ্ঞা' উল্লেখ করেছেন তা-ও আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে অসম্পূর্ণ।

ইউক্লিড প্রদত্ত বর্ণনা নিম্নরূপ:

১. যার কোনো অংশ নাই, তাই বিন্দু।

২. যার কেবল দৈর্ঘ্য আছে, কিন্তু গ্রন্থ ও উচ্চতা নাই, তাই রেখা।

৩. রেখার প্রান্ত বিন্দু নাই।

৪. যে রেখার উপরিস্থিত বিন্দুগুলো একই বরাবরে থাকে, তাই সরলরেখা।

৫. যার কেবল দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ আছে, কিন্তু উচ্চতা নাই, তাই তল।

৬. তলের প্রান্ত হলো রেখা।

৭. যে তলের সরলরেখাগুলো তার উপর সমভাবে থাকে, তাই সমতল।

ইউক্লিড স্বতঃসিদ্ধ :

উপরের বর্ণনায় অংশ, প্রান্ত, দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, উচ্চতা, সমভাবে ইত্যাদি শব্দগুলো লক্ষ করলে দেখা যায় যে, এগুলো অসংজ্ঞায়িতভাবে গ্রহণ করা হয়েছে।

ধরে নেওয়া যায় যে, এগুলো সম্পর্কে আমাদের প্রাথমিক ধারণা রয়েছে। এসব‌ ধারণার উপর ভিত্তি করেই বিন্দু, সরলরেখা ও সমতলের ধারণা দেওয়া হয়েছে।

বস্তুত, যেকোনো গাণিতিক আলোচনায় এক বা একাধিক প্রাথমিক ধারণা স্বীকার করে নিতে হয়। ইউক্লিড এগুলোকে স্বতঃসিদ্ধ (Axioms) বলে আখ্যায়িত করেন।

ইউক্লিড প্রদত্ত কয়েকটি স্বতঃসিদ্ধ নিচে দেওয়া হলো:

১. যে সকল বস্তুর প্রত্যেকটি একই বস্তুর সমান, সেগুলো পরস্পর সমান।

২. সমান সমান রাশির সাথে সমান সমান রাশি যোগ করলে যোগফলগুলো সমান হয়।

৩. সমান সমান রাশি থেকে সমান সমান রাশি বিয়োগ করলে, বিয়োগফলগুলো সমান হয়।

৪. সমান সমান রাশিকে সমান সমান রাশি দিয়ে গুণ করলে গুণফলগুলো সমান হয়।

৫. সমান সমান রাশিকে সমান সমান রাশি দিয়ে (শূন্য নয়) ভাগ করলে, ভাগফলগুলো সমান হয়।

৬. একটি সম্পূর্ণ রাশি তার যেকোনো অংশ থেকে বৃহত্তর।

স্বীকার্য (Postulate):

যে কোন গাণিতিক আলোচনায় এক বা একাধিক প্রাথমিক ধারণা স্বীকার করে নিতে হয়। বর্তমানে জ্যামিতিতে বিন্দু, সরলরেখা ও সমতলকে প্রাথমিক ধারণা হিসেবে গ্রহণ করে তাদের কিছু বৈশিষ্ট্যকে স্বীকার করে নেয়া হয়। এই স্বীকৃত বৈশিষ্ট্যসমূহকে জ্যামিতিক স্বীকার্য (Postulate) বলা হয়। বাস্তব ধারণার সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই স্বীকার্যসমূহ নির্ধারণ করা হয়।

ইউক্লিড প্রদত্ত পাঁচটি স্বীকার্য হলো:

স্বীকার্য-১: দুইটি বিন্দু দিয়ে কেবলমাত্র একটি সরলরেখা আঁকা যায়।

স্বীকার্য ২: যেকোনো সরল রেখাংশের প্রান্তদ্বয়কে উভয়দিকে যতদূর ইচ্ছা বর্ধিত করা যায়।

স্বীকার্য-৩: যেকোনো বিন্দুকে কেন্দ্র করে যেকোনো ব্যাসার্ধ নিয়ে কেবলমাত্র একটি বৃত্ত আঁকা যায়।

স্বীকার্য ৪: সকল সমকোণ পরস্পর সমান।

স্বীকার্য ৫: একটি সরলরেখা দুইটি সরলরেখাকে ছেদ করলে এবং ছেদকের একই পাশের অন্তঃস্থ কোণদ্বয়ের সমষ্টি দুই সমকোণের থেকে কম হলে, রেখা দুইটিকে যথেচ্ছভাবে বর্ধিত করলে যেদিকে কোণের সমষ্টি দুই সমকোণের থেকে কম, সেদিকে মিলিত হয়।

সময় গণিত শাস্ত্র যুক্তি নির্ভর। এই যুক্তির প্রয়োগ জ্যামিতিতে খুবই সুস্পষ্ট। ইউক্লিড সংজ্ঞা, স্বতঃসিদ্ধ ও স্বীকার্যগুলোর সাহায্যে যুক্তিমূলক নতুন প্রতিজ্ঞা প্রমাণ করেন।

তিনি সংজ্ঞা, স্বতঃসিদ্ধ, স্বীকার্য ও প্রমাণিত প্রতিজ্ঞার সাহায্যে আবার নতুন একটি প্রতিজ্ঞা প্রমাণ করেন। ইউক্লিড তাঁর 'ইলিমেন্টস' গ্রন্থে বেশ কতকগুলো শৃঙ্খলাবদ্ধ প্রতিজ্ঞার প্রমাণ দিয়েছেন যা আধুনিক জ্যামিতির ভিত্তি।

ইউক্লিডের প্রথম থেকে চতুর্থ পর্যন্ত স্বীকার্যগুলো এতো সহজ যে এগুলো স্পষ্টই সত্য” বলে প্রতীয়মান হয়। কিন্তু স্বীকার্যগুলো প্রমাণ করা যায় না। কাজেই, উক্তিগুলো "প্রমাণবিহীন সত্য" বা স্বীকার্য বলে ধরে নেওয়া হয়। অন্যদিকে, পঞ্চম স্বীকার্যটি অন্য চারটি স্বীকার্যের থেকে জটিল। এই স্বীকার্যটি সমান্তরাল সরলরেখার সাথে সম্পর্কিত।

জ্যামিতির বৈশিষ্ট্য :-

  • - জ্যামিতি বিভিন্ন আকার-প্রকৃতির জ্যামিট্রিক অবজেক্ট সম্পর্কে ধারণা দেয়। এর মধ্যে রয়েছে বিন্দু, রেখা, কোণ, আয়তন প্রভৃতি।
  • - জ্যামিতিতে এই অবজেক্টগুলোর মাপ, পরিমাপ, ক্ষেত্রফল ইত্যাদি গণনা করা হয়।
  • - এছাড়া এরা জ্যামিট্রিক অবজেক্টগুলোর মধ্যে সম্পর্ক, সাম্য-অসাম্যতা ইত্যাদি খুঁজে বের করে।
  • - জ্যামিতিতে বিভিন্ন নিয়ম, প্রমেয়, ও তত্ত্বের প্রতিষ্ঠা করা হয়।
  • - জ্যামিতি স্থান, দিক, দূরত্ব এবং মাপ সম্পর্কে ধারণা দেয়।
  • - জ্যামিতি ব্যবহারিক জীবনে অনেক জায়গায় প্রয়োগ করা যায়।
  • - জ্যামিতি দ্বারা তাৎক্ষণিক চিন্তাশক্তি এবং যুক্তি বৃদ্ধি পায়।
  • - জ্যামিতি সমস্যা সমাধানে সহায়তা করে এবং দক্ষতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।

জ্যামিতির গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা :-

১. জ্যামিতি আমাদের চারপাশের বিশ্বের আকার, পরিমাপ, স্থান সম্পর্কে ধারণা দেয়। এর মাধ্যমে আমরা স্থানীয় অবকাঠামো বুঝতে পারি।

২. জীবনে অনেক কাজে জ্যামিতি প্রয়োজনীয় যেমন সড়ক নির্মাণ, ভবন নির্মাণ, কৃষি, ভূমি মাপ, নেভিগেশন ইত্যাদি।

৩. জ্যামিতি লজিক এবং যুক্তির উপর ভিত্তি করে। তাই এটি আমাদের যুক্তিগত চিন্তাশক্তি বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।

৪. জ্যামিতি সমস্যা সমাধানে দক্ষতা বৃদ্ধি করে। এর মাধ্যমে আমরা ক্রমাগত চিন্তার প্রশিক্ষণ লাভ করি।

৫. জ্যামিতি সংখ্যা, প্যাটার্ন, রঙ এবং আকৃতির মাধ্যমে ধারণা বৃদ্ধি করে।

৬. জ্যামিতি বিজ্ঞান, প্রকৌশলবিদ্যা, কম্পিউটার সায়েন্স এবং অন্যান্য বিষয়ের ভিত্তি।

৭. শিক্ষার্থীদের জন্য জ্যামিতি গুরুত্বপূর্ণ কারণ এটি তাদের মাথার উপর চাপ সৃষ্টি করে না এবং সহজেই বুঝতে পারে।

৮. জ্যামিতি সৃজনশীলতা এবং কল্পনাশক্তিকে উদ্বুদ্ধ করে।

সুতরাং জ্যামিতি গণিত শিক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ যা আমাদের মাথা ও চিন্তার প্রশিক্ষণে সাহায্য করে।

জ্যামিতি সম্পর্কিত প্রশ্ন উত্তর:-

১. জ্যামিতি কী?
জ্যামিতি হল গণিতের একটি শাখা যা বিভিন্ন আকার-প্রকৃতির চিহ্নিতকরণ, মাপান এবং তাদের মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করে।

২. জ্যামিতির গুরুত্ব কী কী?
জ্যামিতির গুরুত্ব হল এটি আমাদের চারপাশের পরিবেশ বুঝতে সাহায্য করে, চিন্তাশক্তি বাড়ায়, সমস্যা সমাধানে সহায়তা করে।

৩. জ্যামিতির বিভাগ কি কি?
জ্যামিতির প্রধান বিভাগ হল সমতল জ্যামিতি এবং ঘন জ্যামিতি।

৪. সমতল জ্যামিতি কী?
সমতল জ্যামিতি হল দ্বিমাত্রিক জ্যামিতি।

৫. ঘন জ্যামিতি কী?
ঘন জ্যামিতি হল ত্রিমাত্রিক জ্যামিতি।

৬. ত্রিভুজ কী?
ত্রিভুজ হল তিনটি রেখার সংযোগ দ্বারা গঠিত একটি সীমাবদ্ধ আকৃতি।

৭. বৃত্ত কী?
বৃত্ত হল একটি বিন্দু থেকে সমান দূরত্বে থাকা সব বিন্দুর সংযোগসূত্র।

৮. সমকোণ ত্রিভুজ কী?
সমকোণ ত্রিভুজ হল যেখানে তিনটি কোণ ৯০ ডিগ্রির সমান।

৯. পারলেলোগ্রাম কী?
পারলেলোগ্রাম হল একটি আয়তক্ষেত্র যার দুই বিপরীত পার্শ্বরেখা সমান্তরাল এবং অন্য দুই পার্শ্বরেখা সমান।

১০. জ্যামিতিতে পিথাগোরাস প্রমেয় কী?
পিথাগোরাস প্রমেয় হল একটি সমকোণ ত্রিভুজের ঘনক বর্গের ক্ষেত্রফলের সমান হয় ঐ ত্রিভুজের দুই কাতার বর্গের যোগফল।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ