প্রবন্ধ কাকে বলে বা কি | বাংলা প্রবন্ধ রচনার স্বরূপ ও বৈশিষ্ট্য, উদ্দেশ্য

প্রবন্ধ :-

ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাংলা সাহিত্য ক্ষেত্রে এক নতুন ধরনের সাহিত্য শাখার উদ্ভব হল, যাকে আমরা বলতে পারি, প্রবন্ধ সাহিত্য। সাধারণত প্রবন্ধ গদ্যে রচিত হয়। প্রবন্ধের ভিত্তি মানুষের চিন্তা, মনন ও তত্ত্ব। তথ্য ও যুক্তির সাহায্যে মননজ্যত কোনো বিষয়ের প্রতিষ্ঠা দান প্রবন্ধের লক্ষ্য।

প্রবন্ধ কি বা কাকে বলে :-

প্রবন্ধ কি? প্রবন্ধ শব্দটির প্রকৃতি প্রত্যয়গত অর্থ হ'ল 'প্ৰকৃষ্ট বন্ধন'। প্রবন্ধ কাকে বলে? 'প্রকৃষ্ট-বন্ধন' যুক্ত রচনাকেই প্রবন্ধ বলা হয়ে থাকে।

বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যে সাধারণত জ্ঞান বিজ্ঞান, ধর্ম, দর্শন, ইতিহাস, রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ, সাহিত্য, শিল্প ইত্যাদি চিন্তামূলক ও তত্ত্বমূলক বিষয় গদ্যবাহিত হয়ে প্রকাশ পায়। এই সমস্ত লেখার পেছনে থাকে যুক্তি। কোনো চিন্তাগ্রাহ্য বিষয়কে লেখক যখন যুক্তির সাহায্যে প্রতিষ্ঠা করতে চান, তখন তা প্রবন্ধ হয়ে উঠে।

‘প্রবন্ধ' বা 'Essay' এক বিশেষ ধরনের গদ্যরচনা, ষোড়শ শতকে ফরাসি লেখক Michel de Montaigne তার 'Essais' (1580) গ্রন্থের শিরোনামে শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন 'essai' বা 'attempt', অর্থাৎ প্রয়াস' এই মূলগত অর্থে।
প্রবন্ধ রচনা কি বা কাকে বলে | বাংলা প্রবন্ধ স্বরূপ ও বৈশিষ্ট্য, উদ্দেশ্য
Montaigne ও বেকনেরও বহু পূর্বে প্রাচীনকালে গ্রিস ও রোমে প্রবন্ধধর্মী গদ্যরচনার চর্চা করেছিলেন। থিওফ্রাসটাস, প্লুতার্ক, সিসেরো এবং সেনেকা। প্রাচীন প্রয়োগে 'প্রবন্ধ' শব্দটির অর্থ ছিলো 'উপায়' বা 'ব্যবস্থা'। সংস্কৃত ভাষায় ‘প্রবন্ধ’ বলতে বোঝাতো 'প্রকৃষ্টরূপে বন্ধন' এবং সাহিত্যের সকল শাখাতেই প্রবন্ধের চলন ছিল।

প্রবন্ধ রচনার শ্রেনীবিভাগ :-

প্রবন্ধকে দুভাগে ভাগ করা হয় –
  1. তন্ময় বা বস্তুনিষ্ঠ প্রবন্ধ
  2. ব্যক্তিগত বা মন্ময় প্রবন্ধ

নীচে এই দুইপ্রকার প্রবন্ধ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।


বস্তুনিষ্ঠ প্রবন্ধে লেখক নিরাসক্তভাবে বিষয়ের উপর কর্তৃত্ব স্থাপন করে যুক্তিশৃঙ্খলার মাধ্যমে গভীরভাবে বিষয় বিশেষণ করেন। চিন্তাশীল অনুসন্ধানী পাঠক এ জাতীয় প্রবন্ধের অনুরাগী। বঙ্কিমন্দ্রের 'বাঙ্গালা ভাষা' বস্তুনিষ্ঠ প্রবন্ধের অন্তর্ভুক্ত। এছাড়াও বঙ্কিমচন্দ্রের 'প্রবন্ধপুস্তক', জ্যোতিরিন্দ্র নাথের 'প্রবন্ধমধুরী', রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ের 'নানা প্রবন্ধ', কাজী মোতাহের হোসেনের 'সংস্কৃতি কথা', এসব প্রবন্ধ তন্ময় বা বস্তুনিষ্ঠ প্রবন্ধ।

ভাবনিষ্ট বা মন্ময় প্রবন্ধকে ব্যক্তি প্রবন্ধ হিসেবেও আখ্যায়িত করা হয়। এ ধরনের প্রবন্ধে বিষয় অপেক্ষা লেখক পাঠককেই বেশি গুরুত্ব দেন। নিজের অনুভূতিকে পাঠকের অনুভূতি ও সংবেদনশীলতার সঙ্গে সংযুক্ত করতে চান। বলা যায়, এ-জাতীয় প্রবন্ধে লেখকের ব্যক্তিসত্তার 'আত্মপ্রকাশ' ঘটে। বঙ্কিমচন্দ্রের "কমলাকান্তের দপ্তর' ও 'লোক রহস্য', রবীন্দ্রনাথের 'বিচিত্র প্রবন্ধ' এই প্রবন্ধ রচনার অন্তর্ভুক্ত।

প্রবন্ধ রচনার স্বরূপ ও বৈশিষ্ট্য :-

উপরিউক্ত আমরা যা আলোচনা করলাম তা থেকে কতগুলি প্রবন্ধ রচনার স্বরূপ ও বৈশিষ্ট লক্ষ্য করা যায়- 

১ - প্রবন্ধ সাহিত্য গদ্য লেখা মানুষের চিন্তা, মনন ও তত্ত্বই এখানে প্রাধান্য পেয়ে থাকে। প্রবন্ধ মস্তিষ্ক প্রসূত রচনা। তথ্য, তত্ত্ব, যুক্তি, তর্ক, সিদ্ধান্ত প্রবন্ধের প্রধান উপকরণ।

২ - সাধারণত প্রবন্ধ সাহিত্যে জ্ঞান, বিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাস, সমাজ, রাজনীতি, সাহিত্য, ধর্ম ইত্যাদি বিষয়সমূহ প্রাধান্য পেয়ে থাকে। কোনো বিষয় সম্পর্কে লেখকের চিন্তা গ্রাহ্য তত্ত্বকে কেন্দ্র করে প্রবন্ধ গড়ে ওঠে।

তেমনি আবার বস্তুনিষ্ঠ বা তন্ময় প্রবন্ধের বৈশিষ্ট্যগুলি হল -

১ - যুক্তিনিষ্ঠা ও ভাবনার নির্দিষ্ট শৃঙ্খলা থাকবে।

২ - তত্ত্ব ও তথ্যর লক্ষণীয় প্রাধান্য থাকবে ।

৩ - যিনি প্রবন্ধ রচনা করছেন তার ব্যক্তিগত আবেগ-অনুভূতির বদলে বস্তুনিষ্ঠা বেশি প্রধান্য।

৪ - প্রবন্ধের বিষয় সম্পর্কে প্রবন্ধকারের থাকবে নিঃস্পৃহতা, নিরপেক্ষতা।

৫ - বস্তুনিষ্ঠ প্রবন্ধ রচনা করার সময় লেখকের ভাষা ব্যবহারে সতর্কতার মাধ্যমে প্রবন্ধের বক্তব্য উল্লেখিত হবে।

ব্যক্তিগত বা মন্ময় প্রবন্ধের বৈশিষ্ট্যগুলি নিম্নরূপ :

১ - যুক্তি ও মননশীলতার পরিবর্তে লেখকের হৃদয় আবেগেরই প্রাধান্য থাকবে ।

২ - লেখকের লেখা প্রবন্ধের বিষয়বস্তু ভাবরসে জারিত হয়ে পাঠকের হৃদয়কে স্পর্শ করবে।

৩ - সরস, মর্মস্পর্শী, আত্মকেন্দ্রিক ভঙ্গিতে পাঠকদের কাছে টেনে আনেন প্রাবন্ধিক।

৪ - বস্তুনিষ্ঠ প্রবন্ধকারের মতো মন্ময় প্রাবন্ধিক সোচ্চার বা উদ্দেশ্যতাড়িত নন, বরং আত্মমগ্ন ও কিছুটা রহস্যময়।

৫ - মন্ময় প্রবন্ধ মূলত ব্যক্তিগত নৈর্ব্যক্তিক নয়।

৬ - ভাষার ব্যবহারে প্রবন্ধকার অনেক বেশি স্বাধীনতা পান এবং পাঠকের সঙ্গে আন্তরিক বিনিময় গড়ে তোলেন।

প্রবন্ধ রচনার জন্য প্রয়োজনীয় কাজ :-

১ - লেখক যে বিষয়ে প্রবন্ধ রচনা করবে তা স্থির করার পর তার উপকরণ ও তথ্য প্রস্তুত করতে হবে।

২ - প্রবন্ধের মধ্যে সাধারনত তিনটি অংশ থাকে। এক সূচনায় বিষয়বস্তুর আভাস, দুই মূল বক্তব্যে পক্ষে ও বিপক্ষে মতামত এবং তিন উপসংহার থাকবে।

৩ - সহজ সরল ভাষায় সংক্ষেপে ছোট গল্প, ছোট অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রবন্ধ প্রকাশ করতে হবে।

৪ - গুরুত্বপূর্ণ অনুচ্ছেদগুলো রচনার শুরুতে লিখতে হবে।


৫ - বিষয়ওয়ারি যুক্তি ও তথ্যের প্রতিফলন ঘটাতে হবে। পরস্পর বিরোধী যুক্তি ও ভাব রচনায় স্থান পাবে না।

৬ - প্রবন্ধ রচনায় সাধু ও চলিত ভাষায় মিশ্রণ থাকবে না।

৭ - লেখক যে বিষয়ে প্রবন্ধ রচনা করবেন তা যেন খুব বেশি বড় বা ছোট না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ