'লোককথা' শব্দটি আশুতোষ ভট্টাচার্য (FOLK TALK) শব্দটির প্রতিশব্দ হিসাবে ব্যবহার করেন। আর যত দিন যাচ্ছে তত লোক কাহিনী, লোক গল্প প্রভৃতি শব্দ এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে চলেছে। আজও আমাদের গ্রামাঞ্চলে সাধারণ মানুষ ও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ বংশানুক্রমিক ভাবে চলে আসা বা শুনে আসা কাহিনীকে 'কিসসা কাহিনী' বলে থাকে। শুধু বাংলা কেন সারা পৃথিবী জুড়ে এগুলোর বিকাশ ঘটেছে এবং এক দেশের কাহিনির সঙ্গে অন্য দেশের কাহিনির আশ্চর্য সামঞ্জস্যও লক্ষ করা যায়।
লোককথা কাকে বলে বা কি :-
কার্ল টমলিনসন ও ক্যারেল লিঞ্চ ব্রাউন এর মতে লোককথা কাকে বলে -"মানুষের জীবন ও কল্পনার সংমিশ্রণে গড়ে ওঠা গল্প গাথা হলো লোককথা।"
গবেষক হেনরি গ্লাসি মনে করেন -
"ইতিহাসের বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণকে সামনে রেখে লোককথা হলো মিথ্যা অথবা কাহিনি কিংবদন্তির সংকলন।"
তবে আমরা সাধারণত ভাবে বলতে পারি, গদ্যের মাধ্যমে কোনো কাহিনি বর্ণিত হলে তখন তাকে 'লোককথা' বা 'লোককাহিনি' বলা হয়।
লোককথার বৈশিষ্ট্য :-
১ - একটা অভাব বোধ দিয়ে লোককথার গল্প গুলি শুরু হয় এবং শেষ হয় সেই অভাব পুরণের মধ্যে দিয়ে। যেমন গল্পের শুরুতে রাজ্য, রাজা বা রাণী নিঃসন্তান ছিল। গল্পের শেষে রাজা বা পুত্রের বিবাহের মধ্য তা সম্পূর্ণ হয়।আরও পড়ুন :- নাটক কাকে বলে? এর বৈশিষ্ট্য লেখ?
২ - একটি কার্যকর্মের পুনরাবৃত্তি ঘটতে থাকে কিন্তু সেখানে শেষ পরিণতি হয় আলাদা রকমের। যেমন দুঃখ বেদনা ও সুখের গল্প বা কাঠুরে ও জলদেবতার গল্প।
৩ - নানা রকমের চরিত্রের সন্নিবেশ লক্ষ্য করা যায়।
৪ - অসংলগ্ন কাহিনির দ্বারা গল্পের কাহিনী চলতে থাকে।
৫ - লোককথা সজীব শিল্প। লোককথা বলার মধ্যে যেমন রসসৃষ্টি হয়, শোনার মধ্যেও তেমনি রসের প্রাচুর্য থাকে।
৬ - সতর্কমূলক বিধি নিষেধ লোককথার অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
লোককথার শ্রেনীবিভাগ :-
ড. আশুতোষ ভট্টাচার্য লোককথার শ্রেনীবিভাগ তিনটি ভাগে বিভক্ত করেছেন। এগুলো হলো-১ - রূপকথা
২ - উপকথা ও
৩ - ব্রতকথা।
এগুলো সম্পর্কে আলোচনা করা হলো-
১ - রূপকথা :-
Fairy tale এর সমার্থক শব্দ রূপকথা। রূপকথার মধ্যে রাজা রাণী, রাজকন্যা, পরী, রাক্ষস, ক্ষোকস প্রভৃতি কাহিনী থাকে। রাজা রানীদের শাসনের সময় কাল থেকে সম্ভবত রূপ কথার সৃষ্টি হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। রূপকথার গল্প মূলত শিশুদের মনকে আনন্দ দেবার জন্য উদ্ভব হয়েছিল।
২ - উপকথা :-
পশুপক্ষীর চরিত্র অবলম্বনে যেসব কাহিনি গড়ে উঠেছে সেগুলোর উপকথা। কৌতুকসৃষ্টি ও নীতিপ্রচারের জন্যই এগুলোর সৃষ্টি। এতে মানবচরিত্রের মতই পশুপাখির বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করে বক্তব্য পরিবেশিত হয়েছে।
৩ - ব্রতকথা :-
ব্রতকথার মধ্যদিয়ে বাংলার সমাজ জীবনের চিত্র পাওয়া যায়। ব্রতকথার কাজ গার্হস্থ্য কর্তব্য সাধন। গার্হস্থ্য সুখসমৃদ্ধি বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা মিটানো এর লক্ষ্য। ব্রতকথার ঐতিহাসিক মূল্য অস্বীকার করা যায় না।
আরও পড়ুন :- ছোট গল্পের বৈশিষ্ট্য লেখ?
উপরোক্ত এই শ্রেনীবিভাগ ছাড়াও আরও কিছু বিভাগ লক্ষ্য করা যায়। যথা -
রোমাঞ্চ কাহিনি :
আলিব-লায়লার গল্প, বোক্কাচিত্তর কাহিনী, ডেকামেরনের কাহিনী প্রভৃতি রোমাঞ্চ কাহিনি।
হাস্যরসাত্মক কাহিনী :
মানুষকে ঠকানোর উদ্দেশ্যে হাস্য রসাত্মক লোক কাহিনীর উদ্ভব হয়। পৃথিবীর প্রায় সর্বত্র এই হাস্য রসাত্মক লোক কাহিনী প্রচলিত আছে। এই কাহিনীর শ্রেষ্ঠ সংযোজন - “গোপাল ভাঁড়ের গল্প"।
বীর কাহিনী :
এরকম গল্পে হিরোরা অসম্ভব কাজকে যেমন অতি প্রকৃত শক্তি সমূহকে হারাতে পারে। যেমন- হারকিউলিসের গল্প।
স্থানিক কাহিনি :
স্থানিক কাহিনীতে সাধারণ মানুষের বিশ্বাস এই কাহিনী গুলি অসম্ভবের মাত্রাকে স্পর্শ করে। এই সব কাহিনির নায়ক ও নায়িকা অতিপ্রাকৃত বিভিন্ন অবিশ্বাসী শক্তিকে পরাজিত করতে পারে।
নীতি কাহিনী :
বিভিন্ন পশু পাখির কাহিনীতে যখন আদর্শ ও নীতির কথা জড়িত হয় তখন তাকে নীতি কাহিনী বলে। এই সব নীতি কাহিনী সমূহ গল্পের উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় ঈশপের গল্প, পঞ্চতন্ত্রের গল্প, হিতপদেশ গল্প ইত্যাদি।
আরও পড়ুন :- প্রবন্ধ কাকে বলে?
পুরাণ কাহিনী :
পুরাণ কাহিনী মানুষের ধর্ম বিশ্বাস বা ধর্ম আচারের সঙ্গে জড়িত যে সব লোক গল্প সৃষ্টি হয় তা পুরাণ কাহিনী হিসাবে পরিচিত।
0 মন্তব্যসমূহ
Please do not enter any spam link in the comment box.