মনসামঙ্গল কাব্যের বৈশিষ্ট্য | মনসামঙ্গল কাব্যের কাহিনী ও কবিগণ

মনসামঙ্গল কাব্য :-

সর্পদেবী মনসার মাহাত্ম্য ও পূজা প্রচলনের কাহিনী নিয়ে মনসামঙ্গল কাব্যের প্রতিষ্ঠা। ইউফ্রেটিস তীরবর্তী তুরানী জাতির মানুষ নাকি সর্বপ্রথম সর্পপূজার প্রচলন করে। সর্পের অধিষ্ঠাত্রী দেবী মনসাকে নিয়ে যে মাহাত্ম্যকথা লেখা হয়েছে তার সাধারণ পরিচিতি হল ‘মনসামঙ্গল'।

ডঃ আশুতোষ ভট্টাচার্য বৌদ্ধ সর্পদেবী জাগুলিকে মনসার ভিত্তিরূপে গ্রহণ করেছেন। দক্ষিণ ভারতের দ্রাবিড় গোষ্ঠীর সর্পদেবী হলেন ‘মনচাঅম্মা'। পদ্মপুরাণ, দেবীভাগবত ও ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণেও মনসার কথা আছে। জেলে ও দরিদ্র কৃষকদের মধ্যে মনসার পূজা প্রচলিত হলেও বৃহত্তর হিন্দু সমাজে চাঁদ সদাগরের পূজার মধ্য দিয়ে মনসা পূজা প্রচলিত হয়।

মনসামঙ্গল কাব্যের কাহিনী :-

মনসামঙ্গলের কাহিনীরামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ নিরপেক্ষ একটি স্বতন্ত্র লৌকিক কাহিনি। মনে করা হয়, পল্লীগীতিকা বা ছড়ার আকারে সংক্ষিপ্ততম মূলকাহিনি লোকমুখে প্রচলিত ছিল, তের-চৌদ্দ শতকে কোন প্রতিভাধর কবির হাতে কাব্য কাহিনিবদ্ধ হয়েছে। কাহিনিটি সে যুগেই বাংলা, বিহার ও আসামের সর্বত্র প্রচারিত হয়েছিল। মনসামঙ্গলের কাহিনিকে আগাগোড়া কল্পনামূলক বলে দাবি করা যায় না। এর বাস্তব ভিত্তি অবশ্যস্বীকার্য। নীচে মনসামঙ্গল কাব্যের কাহিনীআলোচনা করা হলো -
মনসামঙ্গল

চাঁদ সদাগর চাম্পাই নগরের বণিক। বীরপুরুষ, আত্মশক্তিতে অবিচল বিশ্বাসী চাঁদ সদাগর মহাজ্ঞানী দেবতা শিবের ভক্ত। চাঁদ সদাগর পূজা না করলে পৃথিবীতে মনসার পূজা প্রচার হয় না। স্ত্রী সনকা গোপনে মনসা দেবীর পূজা করেন। চাঁদ সদাগর তা জানতে পেরে লাথি মেরে মনসার ঘট ভেঙে দিলেন। মনসা ক্রোধান্বিত হলে চাঁদের ছয় পুত্র সাপের কামড়ে মারা গেল।


চাঁদ সদাগর মনসার পূজা করলে মৃত পুত্রেরা প্রাণ ফিরে পাবে বলে প্রলোভন দেখালে চাঁদ লাঠির আঘাতে মনসার পাঁজর ভেঙে ফেলেন। সনকা গোপনে মনসার কাছে স্বামীর মঙ্গল প্রার্থনা করলে মনসা তাঁকে পুত্রবর দিলেন। কিন্তু বিয়ের রাতে পুত্র সাপের কামড়ে মারা যাবে বলা হল। সনকা ভবিষ্যতের কথা না ভেবে পুত্রমুখ দেখার আনন্দে মগ্ন রইলেন।

এদিকে অবিচল, দৃঢ় প্রতিজ্ঞ চাঁদ সদাগর চৌদ্দ ডিঙা সাজিয়ে বাণিজ্যে যাচ্ছেন। মনসা আবার চাঁদকে পূজা করতে নির্দেশ দিলেন। চাঁদ এবারও তাঁকে অপমান করে তাড়ালেন। চাঁদ সদাগর বাণিজ্য বহর নিয়ে পাটনে পৌঁছলেন এবং নিজের তুচ্ছ দ্রব্যসামগ্রীর বিনিময়ে বহু মূল্যবান সম্পদ লাভ করলেন।
ফেরার পথে মনসা আবার পূজা করতে চাঁদকে নির্দেশ দিলেন। কিন্তু শিবভক্ত চাঁদ এবারও অস্বীকৃতি জানালে। মনসা রাগে সমুদ্রে অসময়ে ঝড়তুফান তুলে চাঁদ সদাগরের সমুদয় বাণিজ্যবহর ডুবিয়ে দিলেন। চাঁদ বহু কষ্টে তীরে উঠলেন। বারো বৎসর নানা দুঃখ কষ্ট সহ্য করে চাঁদ ভিক্ষুকের বেশে নিজদেশে ফিরে এলেন।

এদিকে মনসার বরে সনকার পুত্রলাভ হয়েছে। পুত্রের নাম লখিন্দর বা লখাই। চাঁদ সদাগর নিঃস্ব হয়ে ফিরলেও পুত্রের মুখ দেখে সকল দুঃখ ভুলে গেলেন। সনকার অসম্মতি উপেক্ষা করে চাঁদ সদাগর পুত্রের বিয়ের উদ্যোগ নিলেন। উজানী নগরের সায়বেনের কন্যা পরমাসুন্দরী বেহুলার সঙ্গে লখিন্দরের বিয়ে।

মনসার কোপ থেকে রক্ষা করার জন্য লোহার বাসর ঘর তৈরি করানো হল, কিন্তু দৈবাৎ চুলের মত সরু একটি ছিদ্র রয়ে গেল। সে ছিদ্র দিয়ে এক সাপ এসে লখিন্দরকে দংশন করলে সে মারা যায়।

সর্পদংশনে মৃত লখিন্দরের দেহ ভেলায় ভাসিয়ে দেওয়া হল; বেহুলা মৃতস্বামীর অনুগামিনী হয়ে মৃতদেহের সঙ্গে ভেলায় ভেসে চলল। স্বর্গলোকে দেবতাদের কাছ থেকে সে স্বামীর প্রাণ ফিরিয়ে আনবে। নদীপথে বহু বাধার সম্মুখীন হয়েও বেহুলা নিরাশ হয় নি। সমস্ত বাধাবিপত্তি জয় করে সে এগিয়ে চলল।

ভেলা স্বর্গের ধোপানী নেতার ঘাটে পৌঁছল। নেতা একটি ছেলেকে নিয়ে কাপড় কাচতে ছিল। ছেলেটির দুরন্তপনায় বিরক্ত হয়ে নেতা তাকে আঘাত দিয়ে মেরে ফেলে রাখে; যাবার সময় তাকে মন্ত্র পড়ে জীবিত করে সঙ্গে নিয়ে গেল। বেহুলা এ দৃশ্য দেখে তার স্বামীর প্রাণদানের জন্য নেতাকে অনুরোধ করল। নেতা নিজের অক্ষমতার কথা বলে বেহুলাকে স্বর্গলোকে নিয়ে গেল।

আরও পড়ুন :- ধর্মমঙ্গল কাব্যের কাহিনি

সেখানে নৃত্যগীতে দেবতাদের তুষ্ট করে বেহুলা তাঁদের কাছে স্বামীর প্রাণভিক্ষা চাইল। শিবের নির্দেশে অনিচ্ছাসত্ত্বেও মনসা লখিন্দরের প্রাণ ফিরিয়ে দিলেন। তবে বেহুলাকে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করালেন যে চাঁদ সদাগরকে মনসার পূজা করতে হবে। বেহুলা সম্মত হয়ে মনসার দয়ায় ছয় ভাসুর, শ্বশুরের চৌদ্দ ডিঙা বাণিজ্য বহর সবই ফিরে পেল।

বেহুলা ধনরত্বপূর্ণ চৌদ্দ ডিঙা নিয়ে চাঁদের সাত পুত্রসহ ঘাটে এসে ভিড়ল। চাঁদ সদাগর ছুটে এলেন; কিন্তু মনসার পূজা করতে হবে শুনে ফিরে চললেন। পুত্রবধূ বেহুলার কাতর আবেদনে অবশেষে চাঁদ সদাগর মনসার পূজা করতে সম্মত হলেন এবং মুখ ফিরিয়ে বাম হাতে একটি ফুল মনসার উদ্দেশ্যে ছুঁড়ে দিলেন । মনসা তাতেই খুশি। আর এভাবেই পৃথিবীতে মনসার পূজা প্রচারিত হল।

মনসামঙ্গল কাব্যের কবিগণ :-

কানা হরিদত্ত :-

মনসামঙ্গলের কাহিনী প্রথম কাব্যরূপ লাভ করে কানা হরিদত্তের হাতে। হরিদত্ত ছিলেন পূর্ববঙ্গের লোক। ময়মন সিংহের দিঘপাইৎ গ্রাম থেকে দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার মহাশয় কানা হরিদত্তের ভণিতাযুক্ত ‘পদ্মার সর্পগন্ধা' নামে একটি অংশ উদ্ধার করেন। বিজয় গুপ্ত খাঁটি খবর দিয়েছিলেন যে, হরিদত্ত মনসার প্রথম মাহাত্ম্যগীত রচয়িতা।

বিজয় গুপ্তের মনসামঙ্গল :-

বিজয় গুপ্তের মনসামঙ্গল কাব্য 'পদ্মাপুরাণ’ সর্বাধিক জনপ্রিয়তা পায় বরিশালে। কাব্যটি ১৪৮৪ খ্রীঃ রচনা ও আঠাশটি পালায় বিভক্ত। গৈলা ফুল্লশ্রী গ্রামে বিজয় গুপ্তের জন্ম, পিতার নাম সনাতন, মাতার নাম রুক্মিণী।

আরও পড়ুন :- চন্দীমঙ্গল কাব্যের কাহিনি?

কাহিনীতে অলৌকিকতা থাকলেও সমকালীন পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের ছবি প্রতিফলিত হয়েছে। মনসা তাঁর কাব্যে গোত্র পরিচয়ে দেবী বটে, কিন্তু স্বভাব পরিচয়ে রাক্ষসী, দানবী। শিবও সমানভাবে কবির কাব্যে দেবত্ব পরিহার করে রক্তমাংসের মানুষে পরিণত। বিজয় গুপ্তের কাব্যে অলংকার ও বাগ বৈদগ্ধ্য প্রকাশে যথেষ্ট কুশলতার পরিচয় দিয়েছেন। বিজয় গুপ্তের ‘পদ্মাপুরাণ’ সমগ্র মঙ্গল সাহিত্যের ধারায় প্রথম সন তারিখযুক্ত রচনা।

বিপ্রদাস পিপলাই :-

মনসামঙ্গলের পশ্চিমবঙ্গীয় ধারার অন্যতম কবি হলেন বিপ্রদাস পিপলাই। কবির বাস ছিল উত্তর চব্বিশ পরগণার বসিরহাট মহকুমার অন্তর্গত নাদুড়্যা বটগ্রামে। বিপ্রদাসের কাব্যের নাম 'মনসাবিজয়'।

কাব্যের ভাষাতে আধুনিকতার ছাপ আছে, নিমাইতীর্থ ও শ্রীপট খড়দহ তো ষোড়শ-সপ্তদশ শতকের আগে গড়ে উঠতে পারে না। এজন্য অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বিপ্রদাসের কাব্যকে ষোড়শ শতাব্দীর বলে গণ্য করেছেন।

নারায়ণ দেব :-

নারায়ণ দেব ময়মন সিংহ জেলার কিশোর গঞ্জ মহকুমার অন্তর্গত বোর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। কবিরা জাতিতে কায়স্থ, গোত্রে মৌদগল্য। নারায়ণ দেবের কাব্য তিনখণ্ডে বিভক্ত। কবির কাব্যে দেবখণ্ডের তুলনায় নরখণ্ড সংক্ষিপ্ত। নারায়ণ দেবের ‘পদ্মাপুরাণে’ লৌকিক উপাদানের চেয়ে পৌরাণিক উপকরণ বেশি মেলে। তাঁর রচনায় শিবপুরাণ, কালিকাপুরাণ, মহাভারত, কুমারসম্ভব, প্রভৃতি গ্রন্থের প্রভাব আছে যথেষ্ট।

দ্বিজবংশী দাস :-

দ্বিজবংশী দাস মনসামঙ্গলের পূর্ববঙ্গীয় কবিদের মধ্যে অন্যতম। কাব্যের নাম 'পদ্মাপুরাণ'।

দ্বিজবংশী দাসের কাব্যে চিরাচরিত আখ্যানের শৈবচাঁদ শক্তির উপাসকরূপে পরিণত হয়েছেন। তবে করুণরসের প্রবাহে মাঝে মাঝে দেখা দিয়েছে হাস্যরসের ক্ষণিক ঝিলিক। বংশী দাসের রচনায় বৈষ্ণবীয় প্রভাব আছে বলে, অনেকেই তাকে চৈতন্যোত্তর কালের কবি বলে বর্ণনা করেছেন।

কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ :-

রাঢ়বঙ্গের মনসামঙ্গলের বিশিষ্ট রূপকার হলেন বর্ধমানের কাঁকড়া গ্রামের কবি কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ। ইনি সম্ভবতঃ সপ্তদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে কাব্য রচনা করেছিলেন।

ক্ষেমানন্দ তাঁর কাব্যে মনসার আর এক নাম কেতকা দিয়েছেন। যেহেতু কেতকী বা কেয়া বনে মনসা জন্মলাভ করেছিলেন। কেতকাদাসের কাব্যে মোট চোদ্দটি পালা দেখতে পাওয়া যায়। এগুলি যথাক্রমে মনসার জন্ম, চণ্ডী-মনসার বিবাদ, চিত্রবতী উপাখ্যান, কপিলার মর্ত্য আগমন ইত্যাদি। দক্ষিণবঙ্গের মনসামঙ্গল রচয়িতাদের মধ্যে কেতকাদাস ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ কবি।

তন্ত্র বিভূতি :-

উত্তরবঙ্গীয় শাখায় অন্যতম বিশিষ্ট কবি হলেন তন্ত্র বিভূতি। অনেকের মতে, কবির প্রকৃত নাম 'বিভূতি’। তন্ত্র বিভূতির কাব্যের নাম 'মনসা-পুরাণ'।

কবি, কাহিনীর মধ্যে কিছু নতুন বিষয়ের অবতারণা করেছেন। যেমন ধর্মপূজা করতে গিয়ে শিব মনসাকে জন্ম দিলেন। মনসার রূপ দেখে পিতামহ ব্রহ্মার আত্মবিস্মরণ ঘটা এবং তার থেকে বিষের জন্ম সম্পূর্ণ অভিনব তথ্য।

জগজ্জীবন ঘোষাল :-

জগজ্জীবন ঘোষালের দিনাজপুরের অন্তর্গত কুচিয়া মোড়ায় জন্ম। কবির পিতার নাম রূপ রায়চৌধুরী, মাতা রেবতী। ইনি সম্ভবত সপ্তদশ শতকের শেষে 'মনসামঙ্গল' লিখেছিলেন। কবির কাব্যটি দুটি খণ্ডে বিভক্ত – দেবখণ্ড ও বণিকখণ্ড।

জীবনকৃষ্ণ মৈত্র :-

উত্তরবঙ্গের করতোয়া নদী-তীরবর্তী লাহিড়ী পাড়া গ্রামে এক বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ পরিবারে কবি জীবনকৃষ্ণ মৈত্রের জন্ম। কবি কাব্য রচনার দ্বারা রাজা রামকৃষ্ণ কর্তৃক ‘কবিভূষণ’ উপাধি পেয়েছিলেন। জীবনকৃষ্ণের কাব্যে বেহুলা ‘বেললি' বলে নামাঙ্কিত। কবির অনবদ্যতা ফুটে উঠেছে দৈনন্দিন জীবনের বাস্তব বর্ণনায়।


বাইশ কবির মনসামঙ্গল :-

মনসামঙ্গলের জনপ্রিয়তার জন্য বিভিন্ন কবির রচিত কাব্য থেকে বিভিন্ন অংশ সংগ্রহ করে যে পদসংকলন করা হয়েছিল তা 'বাইশ কবির মনসামঙ্গল' বা 'বাইশা' বা 'বাইশ কবি মনসা' নামে প্রচলিত। এ ধরনের অন্য একটি সংকলনের নাম 'ষট কবি মনসামঙ্গল।'

বাইশ কবি মনসামঙ্গলে বাইশ জন কবির তালিকা আছে। তবে গ্রন্থে সকলের নাম পাওয়া যায় না। এ সংকলনে অনেক অখ্যাত কবির নাম স্থান পেয়েছে। বিভিন্ন কবির কাব্য থেকে বিভিন্ন অংশ সংগৃহীত বলে এ ধরনের সংকলনে সর্বাঙ্গীন কৃতিত্ব নেই। অনেক স্থানে আধুনিকতার নিদর্শনও বিদ্যমান।

মনসামঙ্গল কাহিনির জনপ্রিয়তার জন্য অসংখ্য কবি মনসামঙ্গল কাব্য রচনা করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে ষোল শতকের গঙ্গাদাস সেন, সতের শতকের রামজীবন বিদ্যাভূষণ, বাণেশ্বর রায়, প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।

মনসামঙ্গল কাব্যের বৈশিষ্ট্য :-


  • মনসামঙ্গল কাব্যের একটি প্রধান উদ্দেশ্য দেবদেবীদের মাহাত্ম্য প্রচার করা।
  • মনসামঙ্গল কাব্যে কবির ভূমিকা অংশে পূর্বপুরুষের পরিচয়, বসবাসের বর্ণনা, স্বপ্ন-আদেশ প্রভৃতির অল্প-বিস্তর বর্ণনার উল্লেখ থাকে।
  • মনসামঙ্গল কাব্যের অন্যতম উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য কবিদের ভনিতা ব্যবহার। এখানে কবির নাম, তার পদবী, আশ্রয়দাতা, পৃষ্ঠপোষক প্রভৃতি নাম উল্লেখ করা থাকে।
  • মনসামঙ্গল কাব্যে উল্লেখিত কাহিনি গুলো অনেক পালায় বিভক্ত থাকে।
  • মনসামঙ্গল কাব্যের নায়ক-নায়িকা স্বর্গ থেকে আগত দেব-দেবী। মর্ত্যে আগমনের উদ্দেশ্য দেব মাহাত্ম্যের প্রচারের জন্য।
  • মনসামঙ্গল কাব্যের অন্যতম একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য নারীদের পতিনিন্দার বর্ণনা।
  • মনসামঙ্গল কাব্যের অন্যতম একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো দেবীর চৌতিশা স্তব বর্ণনা করা।
  • প্রহেলিকা বা ধাঁধাঁ, প্রবাদ-প্রবচন, লোকবিশ্বাস, লোকশ্রুতি প্রভৃতি মনসামঙ্গল কাব্যের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য।
  • মনসামঙ্গলকাব্যের অপর একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো দেব-দেবতাদের বিদ্রোহীকে তাদের পদতলে নতশীর্ষ করানো।

মনসামঙ্গল কাব্যের সমাজচিত্র :-

মনসামঙ্গল কাব্যের সমাজচিত্র সম্পর্কে নিম্নে বিস্তারিত আলোচনা তুলে ধরা হল:

• বৈষ্ণব পদাবলীর কবি বিদ্যাপতি তাঁর 'মনসামঙ্গল' কাব্যে সমকালীন বাংলা সমাজের এক ব্যাপক চিত্র ফুটিয়েছেন।

• সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষদের জীবন, আচার-আচরণ, রীতি-নীতির বর্ণনা রয়েছে।

• যেমন রাজা-মহারাজা, ভূ-স্বামী জমিদারদের বর্বর শাসন। জমিদার-কৃষক শোষণ-পীড়ন।

• ধর্মগুরু, পুরোহিতেরা ভক্তদের বোঝার চেয়ে কেবল দান-দক্ষিণা তুলতেন।

• মহিলাদের অবস্থাও ছিল শোচনীয়। তাঁদের উপেক্ষা, নির্যাতন বর্ণিত হয়েছে।

• নারী শিক্ষার প্রতি সমাজের অবজ্ঞার কথাও তিনি তুলে ধরেছেন।

• এছাড়াও বৈষ্ণব সাহিত্য, কবি-কবিতা, গীতিকাব্যের প্রভাব ইত্যাদি নিয়েও আলোচনা করেছেন কবি।

সামগ্রিকভাবে, সমাজের গভীর পর্দায় ঢুকে যাওয়ার মাধ্যমে ১৮শ শতাব্দীর বাংলা সমাজের এক সমগ্র চিত্র উপস্থাপন করেছেন বিদ্যাপতি।

মনসামঙ্গল কাব্যে চরিত্র :-

মনসামঙ্গল কাব্যে দেবতার কথা মুখ্য বিষয় হলেও পূজা প্রচারের অভিযানে যে কাহিনী জাল বিস্তৃত হয়েছে তার তস্তবায়নের উপাদানরূপে চরিত্রগুলি বিশেষ কার্যকরী ভূমিকা পালন করেছে।

এই চরিত্রগুলিকে দুইভাগে ভাগ করা যেতে পারে- দেবতা চরিত্র ও মানবচরিত্র। আবার এদের উপবিভাগ করলে এরকম দাঁড়ায় -

১. দেব চরিত্র - শিব।

২. দেবী চরিত্র- মনসা ও চন্ডী।

৩. পুরুষ চরিত্র - চাঁদ ও লখিন্দর।

8. নারী চরিত্র- বেহলা ও সনকা।

এই চরিত্র গুলির অতিরিক্ত অন্যান্য সাধারণ কিছু চরিত্রের সাক্ষ্য আমরা মনসামঙ্গলে পাব ঠিকই কিন্তু আমরা আমাদের তুলনামূলক আলোচনাকে এই চরিত্রগুলির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখব।

মনসামঙ্গল কাব্যের বেহুলা চরিত্র :-

মনসামঙ্গল কাব্যের মূল কেন্দ্রীয় চরিত্র বেহুলা। মূলত এই চরিত্রকে কেন্দ্র করে কাব্যের মূল উদ্দেশ্যে (দেবী মনসার মর্ত্যে পূজা প্রচার) সাধিত হয়েছে।

স্বর্গের অপ্সরী ঊষা শাপভ্রষ্ট হয়ে মনসাপূজা প্রচারের জন্য উজানী নগরের সায় বেনের বাড়ীতে বেহুলা রূপে জন্মগ্রহণ করে।

সুতরাং সেকারণে জন্মের পর থেকে বেহুলাকে একটা ছকের মধ্যেই ঘুরপাক খেতে হয়। কবিরা এ ব্যাপারটা সম্বন্ধে সচেতন থেকে বেহুলা চরিত্রটিকে এঁকেছেন।

জন্মের পর বেহুলা পরম আদরে মাতৃস্নেহে বড় হয়। তারপর বিবাহাযোগ্যা হলে চম্পকনগরের চাঁদ বণিকের পুত্র লখিন্দরের সঙ্গে বিয়ে হয়।

কিন্তু চাঁদের সঙ্গে মনসার সংঘাত থাকার কারণে বেহুলা বাসর ঘরে বিধবা হয়। কাব্যমধ্যে এরপর থেকেই বেহুলা চরিত্র দীপ্যমান হয়ে উঠতে থাকে।

অর্থাৎ মনসামঙ্গল কাব্যে বেহুলার জীবনকাহিনীকে দু'টি পর্বে ভাগ করা যায়- বিবাহ পূর্ববর্তী অংশ ও বিবাহ পরবর্তী অংশ।

বিবাহ পূর্ববর্তী অংশটিতে বেহুলার চরিত্রের তেমন কোনো বিশেষত্ব পরিস্ফুট হয় নি। চাঁদের পাত্রীসন্ধান অংশে লোহার কলাই রন্ধন কার্যে ও কিশোরী অবস্থায় জলক্রীড়া অংশে (বিপ্রদাসের কাব্যে) মনসার অভিশাপের প্রেক্ষিতে তার বলিষ্ঠ আত্মবিশ্বাস ও সতীত্বের প্রাথমিক লক্ষণগুলি স্বল্লালোকে পরিস্ফুট হয়ে ওঠে।

তবে বৈধব্য পূর্ববর্তী জীবনের বর্ণনা মনসামঙ্গলের কবিরা যা দিয়েছেন বা যা এই অংশে তাঁর চরিত্রের উৎকর্ষতা সূচিত করেছে তা কোন কোন কবি বিক্ষিপ্তভাবে নিজস্ব স্বতন্ত্র কবিত্ব গুণে উপস্থাপন করেছেন।

কিন্তু বৈধব্য পরবর্তী অংশে এই বিক্ষিপ্ত বর্ণনা সব কবির কাব্যেই সংহত রূপ পেয়েছে। মূলতঃ এখান থেকেই কাব্যে বেহুলা চরিত্রের প্রকৃত পরিচয়টি উদ্‌ঘাটিত হতে শুরু করেছে।

মনসামঙ্গল কাব্যের মনসা চরিত্র :

মনসামঙ্গল কাব্যের কেন্দ্রীয় দৈবী চরিত্র মনসা। মনসামঙ্গল কাব্য তাঁরই মাহাত্ম্যসূচক কাব্য। কাব্যের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তাঁর যে স্বরূপের প্রকাশ আমরা লক্ষ্য করি তার সবটাই লৌকিক সামাজিক জীবনরসে সংপৃক্ত। তাই কবিরা পৌরাণিকীকরণের অভ্যাসবশত মনসা চরিত্র চিত্রণে বার বার হোঁচট খেয়ে চেনা সামাজিক মানসের পরিমন্ডলেই ফিরে এসেছেন।

আমরা প্রথম দিকের আলোচনাতে মনসামঙ্গল কাব্যের উদ্ভব প্রসঙ্গে যে সামাজিক অবস্থার উল্লেখ করেছি তাতে দেখেছি মনসামঙ্গল কাব্য হচ্ছে দুই সংস্কৃতির ভাব-সমন্বয়ের কাব্য। লোকজীবনে বহমান মনসা কাহিনীর পৌরাণিকীকরণের কাব্য।

মনসা কাহিনীর মধ্যে যে মিথধর্ম তাতে মনসার পূজা প্রচারের এবং মনসাপূজার যে সংস্কার তাই পালনের কাজ করা হয়েছে। তাই স্বাভাবিক কারণেই মনসার পূজা প্রচারের প্রধান বাধা চাঁদের পরাজয় ও মনসার জয়ের মাধ্যমে সমাজ মানসের ইচ্ছাটাই জয়যুক্ত হয়েছে। আর এই ইচ্ছাটাকে জয়যুক্ত করতে গিয়ে প্রাচীন মনসা কাহিনীতে মনসা চরিত্রটিকে কখনো স্বৈরাচারী, হিংস্র প্রতিহিংসাপরায়ণ করে এঁকেছেন।

মঙ্গলকাব্যের কবিরা এইরকম একটি চরিত্রকে তাঁদের সমাজ সংসারের প্রেক্ষিতে যথাসম্ভব বস্তুমুখী দৃষ্টিতেও সমকালীন জীবনচেতনায় গড়ে তুলেছেন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ