একতরফা দাখিলা পদ্ধতি কি? একতরফা দাখিলা পদ্ধতির বৈশিষ্ট্য, সুবিধা ও অসুবিধা এবং প্রয়োগক্ষেত্র?

একতরফা দাখিলা পদ্ধতি কি :-

প্রতিটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য- আর্থিক ফলাফল ও আর্থিক অবস্থা জানার জন্য সংঘটিত লেনদেনোগুলিকে হিসাবভুক্ত করা। যে হিসাব পদ্ধতিতে সকল লেনদেন একটিকে ডেবিট অপরটিকে ক্রেডিট করা হয় না অর্থাৎ দুতরফা দাখিলা পদ্ধতি মোতাবেক হিসাব সংরক্ষণ করা হয় না তাকে এক তরফা দাখিলা পদ্ধতি বলা হয়।

এই পদ্ধতিতে দু'তরফা দাখিলা পদ্ধতির নীতি অনুসরণ করা হয় না। ফলে বছর শেষে ব্যবসায়ের ফলাফল ও আর্থিক অবস্থা নিরূপণ করা অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ে। এ পদ্ধতিতে নামিক হিসাব ও সম্পত্তিবাচক হিসাব রাখা হয় না শুধুমাত্র নগদান হিসাব ও ব্যক্তিবাচক হিসাব রাখা হয়। এটি অসম্পূর্ণ পদ্ধতি। এ ধরনের হিসাব পদ্ধতি একাধিক হিসাব পদ্ধতির মিশ্রণ মাত্র।

এ পদ্ধতি সম্পর্কে হিসাববিজ্ঞানের বিভিন্ন লেখক বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। এবার আসুন আমরা তাদের কথা জেনে নেই এবং সর্বশেষ নিজেরা এর একটি সংজ্ঞা দেওয়ার চেষ্টা করি।

সাধারণভাবে যে হিসাব ব্যবস্থা দু'তরফা দাখিলা পদ্ধতির মূলনীতি মেনে চলে না, তাকে একতরফা দাখিলা পদ্ধতি বলে।

অন্যভাবে বলা যায়, যে হিসাব ব্যবস্থায় দু'তরফা দাখিলা পদ্ধতির নিয়মনীতি সঠিক ও সম্পূর্ণভাবে প্রয়োগ না করে অবৈজ্ঞানিক, অনুমাননির্ভর, বিশৃঙ্খলভাবে হিসাব লিপিবদ্ধ করা হয়, তাকে একতরফা দাখিলা পদ্ধতি বলে।

এ পদ্ধতি একটি ত্রুটিপূর্ণ, অসম্পূর্ণ, অনুমানভিত্তিক ও অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতি। একতরফা দাখিলা পদ্ধতিতে কোনো কোনো লেনদেনের দু'টি পক্ষ হিসাব বইতে লিপিবদ্ধ করা হয়। আবার কোনো কোনো লেনদেনের কোনো পক্ষই লিপিবদ্ধ করা হয় না।

Professor William Pickles "The method goes by the name of single entry is nothing but an admixture of single entry, double entry and no entry" অর্থৎ একতরফা দাখিলা পদ্ধতি নামে প্রচলিত পদ্ধতি একতরফা, দু'তরফা এবং বিনা তরফার সংমিশ্রণ ছাড়া আর কিছুই নয়।

Professor J. R. Batliboi এর মতে “In fact single entry is not any particular system of book-keeping but rather the double entry system is an incomplete and disjointed form" অর্থাৎ প্রকৃতপক্ষে একতরফা দাখিল পদ্ধতি হিসাবরক্ষণের কোনো বিশেষ পদ্ধতি নয় বরং দু'তরফা দাখিলা পদ্ধতির একটি অসম্পূর্ণ ও বিশৃঙ্খল রূপ মাত্র ।

সুতরাং, পরিশেষে আমরা বলতে পারি, একতরফা দাখিলা পদ্ধতি একটি ত্রূটিপূর্ণ, অসম্পূর্ণ ও অবৈজ্ঞানিক হিসাব ব্যবস্থা যেখানে বিজ্ঞানসম্মত দু'তরফা দাখিলা পদ্ধতি মোতাবেক লেনদেন লিপিবদ্ধ করা হয় না।
একতরফা দাখিলা পদ্ধতি কি

একতরফা দাখিলা পদ্ধতির বৈশিষ্ট্য :-

একতরফা দাখিলা পদ্ধতি একটি অসম্পূর্ণ, অগোছালো ও মিশ্র হিসাব ব্যবস্থা। এ পদ্ধতির বৈশিষ্ট্যসমূহ নিম্নরূপঃ

১. হিসাবরক্ষণ :

একতরফা দাখিলা পদ্ধতিতে শুধুমাত্র নগদান ও ব্যক্তিবাচক হিসাব রাখা হয়। সম্পত্তি ও নামিক হিসাবগুলো রাখা হয় না, রাখলেও আংশিক।

২. মিশ্র হিসাব পদ্ধতি :

একতরফা দাখিলা পদ্ধতি একটি মিশ্র হিসাব পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে কিছু লেনদেন উভয় পক্ষকে ডেবিট ও ক্রেডিট করা হয় আবার কোন কোন লেনদেন হিসাব রাখা হয় এবং কোন কোন লেনদেন হিসাব রাখা হয় না।

৩. লাভ-লোকসান নির্ণয় :

এই পদ্ধতিতে আয় ব্যয়ের পৃথক কোন হিসাব রাখা হয় না। সমাপনী মূলধন হতে প্রারম্ভিক মূলধন বিয়োগ করে লাভ লোকসান নির্ণয় করা হয়।

৪. অদৃশ্য লেনদেন হিসাব :

ব্যবসায়ে অবচয় একটি অদৃশ্য লেনদেন হিসাব। এই পদ্ধতিতে অবচয় জাতীয় কোন লেনদেনের পৃথক হিসাব রাখা হয় না।

৫. আর্থিক বিবরণী প্রস্তুত :

এ পদ্ধতিতে কোন আর্থিক বিবরণী প্রস্তুত না করে নির্দিষ্ট সময়াকে সম্পত্তি ও দায়ের একটি বিবরণী প্রস্তুত করা হয়ে থাকে।

৬. নীতিমালা :

এ পদ্ধতিতে দু'তরফা দাখিলা পদ্ধতির নীতি অনুসরণ না করে মালিকের নিজের সুবিধা মোতাবেক নীতিমালা অনুসরণ করা হয়।

৭. প্রয়োগ :

ছোট ছোট ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানে এই পদ্ধতিতে হিসাব সংরক্ষণ করা হয়।

আরও পড়ুন :- চেক ও বিনিময় বিলের পার্থক্য?

একতরফা দাখিলা পদ্ধতির সুবিধাসমূহ :-

একতরফা দাখিলা পদ্ধতি একটি অসম্পূর্ণ ও অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতি। বিভিন্ন প্রকার দুর্বলতা থাকলেও এর বিশেষ কিছু সুবিধা বিদ্যমান থাকায় এটি একটি জনপ্রিয় পদ্ধতি। নিম্নে একতরফা দাখিলা পদ্ধতির সুবিধা সমূহ উল্লেখ করা হলঃ

১. সহজ পদ্ধতি :

এই পদ্ধতিতে হিসাব রাখা খুব সহজ ও সরল। তাই এই পদ্ধতিতে সাধারণ একজন লোক খুব সহজে হিসাব সংরক্ষণ করতে পারে।

২. অল্প সংখ্যক হিসাব :

এ পদ্ধতিতে সম্পত্তি সংক্রান্ত ও নামিক হিসাব রাখা হয় না বলে হিসাবরক্ষণের পরিমাণ কমে যায়।

৩. কম শ্রম ও স্বল্পসময় :

হিসাবের সংখ্যা এবং কাজের পরিমাণ কমে যায় বিধায় হিসাবরক্ষণের জন্য সময় ও শ্রম কম লাগে।

৪. অল্প ব্যয় :

এতে মালিক নিজের প্রয়োজন অনুযায়ী হিসাব রাখতে পারে বিধায় একাধিক হিসাবরক্ষকের প্রয়োজন হয় না। ফলে ব্যয় কম হয়।

৫. গোপনীয়তা রক্ষা :

মালিক নিজে হিসাব সংরক্ষণ করতে পারে বিধায় হিসাবের গোপনীয়তা রক্ষা হয়।

৬. প্রয়োগ ক্ষেত্র :

ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক প্রতিষ্ঠান এবং ছোট ছোট ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে এ ধরনের হিসাব পদ্ধতি পরিলক্ষিত হয়।

একতরফা দাখিলা পদ্ধতির অসুবিধা :-

একতরফা দাখিলা পদ্ধতির যেমন কিছু সুবিধা রয়েছে তেমনি অনেক অসুবিধাও রয়েছে। অসুবিধাসমূহ নিম্নরূপঃ

১. অসম্পূর্ণ পদ্ধতি :

এই পদ্ধতিতে লেনদেনের সম্পূর্ণ হিসাব রাখা হয় না। ফলে এটি একটি অসম্পূর্ণ পদ্ধতি।

২. গাণিতিক শুদ্ধতা :

এ পদ্ধতিতে রেওয়ামিল প্রস্তুত করা যায় না বিধায় হিসাবের গাণিতিক শুদ্ধতা যাচাই করা সম্ভব হয়।

৩. সঠিক লাভ লোকসান নির্ণয়ে সমস্যা :

এ পদ্ধতিতে নামিক হিসাবসমূহ (আয়-ব্যয় বা লাভ- লোকসান) লিপিবদ্ধ করা হয় না। তাই সঠিক লাভ লোকসান হিসাব নির্ণয় করা যায় না।

৪. প্রকৃত আর্থিক অবস্থা নির্ণয়ে সমস্যা :

এই পদ্ধতিতে সব সম্পত্তি ও দায়ের হিসাব রাখা হয় না বিধায় প্রকৃত আর্থিক অবস্থা নির্ণয় করা সম্ভব হয় না।

আরও পড়ুন :- জাবেদার কাকে বলে?

৫. ভুল ত্রুটি নিরূপনে সমস্যা :

এই পদ্ধতিতে পর্যাপ্ত তথ্যের অভাব থাকার কারণে ভুল ত্রুটি ধরা পড়ে না।

৬. কারচুপি ও জালিয়াতি :

এই পদ্ধতিতে হিসাবের অসম্পূর্ণতা ও ত্রুটির কারণে হিসাবের কারচুপি ও জালিয়াতি উদঘাটন করা সম্ভব হয় না।

৭. তুলনামূলক বিচার বিশেষণের অভাব :

এটি অবৈজ্ঞানিক এবং অসম্পূর্ণ হওয়ার কারণে বিগত বছরের আয়-ব্যয়, লাভ-লোকসান, অন্য-বিক্রয়, দায়-দেনা ও সম্পত্তির তুলনামূলক বিচার বিশ্লেষণ করা যায় না।

৮. পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের সমস্যা :

এই পদ্ধতি অসম্পূর্ণ ও ত্রুটিপূর্ণ হিসাব ব্যবস্থা বিধায় প্রয়োজনে সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না। ফলে ভবিষ্যতে কর্ম পরিকল্পনা গ্রহণ করা সম্ভব হয় না।

৯. ব্যয় নিয়ন্ত্রণ :

এই পদ্ধতিতে নামিক হিসাব রাখা হয় না বিধায় প্রতিষ্ঠানের ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করা যায় না।

১০. প্রয়োগ ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা :

কোম্পানী আইন এই পদ্ধতিকে স্বীকার করে না। আয়কর কর্তৃপক্ষ এটা গ্রহণ করে না। তাই ছোট ছোট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেই ইহা সীমাবদ্ধ থাকে।

একতরফা দাখিলা পদ্ধতির প্রয়োগক্ষেত্র :-

একতরফা দাখিলা পদ্ধতি একটি অনির্ভরযোগ্য পদ্ধতি হওয়া সত্ত্বেও ছোট ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান যাদের কম পুঁজি, আর্থিক অবস্থা স্বচ্ছল নয় এবং বেশিরভাগ লেনদেন নগদে করে থাকে, সেসব প্রতিষ্ঠানে এ পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়। যেমন: রেস্টুরেন্ট, হোটেল, মোটেল, মুদি দোকান, কাপড়ের দোকান, টেইলরিং এর দোকান, ফলের দোকান প্রভৃতি। নিম্নে এ পদ্ধতির প্রধান প্রয়োগ ক্ষেত্রগুলো উল্লেখ করা হলো:

১. কম পুঁজির ব্যবসায় :

যে সব ব্যবসায়ে অধিক মূলধন বিনিয়োগ করার প্রয়োজন হয় না, সে সব প্রতিষ্ঠানে এক তরফা দাখিলা পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়। যেমন: মুদি দোকান, টেইলরিং এর দোকান, ফলের দোকান প্রভৃতি।

২. পণ্যের মালিকানা ও স্থায়িত্বকাল :

যে সব পণ্যের স্থায়িত্বকাল কম এবং একক মালিকানাধীন সে সব পণ্যের হিসাব সংরক্ষণের ক্ষেত্রে এ পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়। যেমন: সবজির দোকান, মাছের দোকান, ফলের দোকান প্রভৃতি।

৩. কম ব্যয় বরাদ্দ :

যে সব প্রতিষ্ঠানে হিসাবরক্ষণের জন্য ব্যয় বরাদ্দ কম, তাদের ক্ষেত্রে এ পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়।

৪. কারবারের আয়তন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা :

যে সব প্রতিষ্ঠানের আয়তন অতি ছোট এবং খরিদারের সাথে মালিকের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ থাকে, সে সব প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে এ পদ্ধতি প্রয়োগ করা যায়। যেমন: মুদি দোকান, ফলের দোকান, চায়ের দোকান ইত্যাদি।

৫. লেনদেনের ধরণ :

যে সব প্রতিষ্ঠানে নগদ লেনদেনের পরিমান বেশী, সে সব এক মালিকানা ও অংশীদারি কারবারের ক্ষেত্রে এ পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ