খুচরা ব্যবসায় কাকে বলে? খুচরা ব্যবসায় কত প্রকার ও কি কি?

খুচরা ব্যবসায় বিপণন ব্যবস্থার একটি অংশ। খুচরা ব্যবসায় ও খুচরা ব্যবসায়ী (Retailing and Retailers) বণ্টন প্রণালির মধ্যে ভোক্তার সবচেয়ে নিকট খুচরা ব্যবসায়ী অবস্থান করে। ভোগ্য পণ্যের ক্ষেত্রে খুচরা ব্যবসায়ীরাই ভোক্তার সাথে যোগসূত্র স্থাপনের প্রধান ভিত্তি।

খুচরা ব্যবসায় কাকে বলে :-

উৎপাদনকারী বা অন্য কোন উৎস হতে পণ্য ক্রয় করে চূড়ান্ত ভোক্তার নিকট পৌঁছে দেওয়া সংক্রান্ত কার্যাবলিকে খুচরা ব্যবসায় বা Retailing বলে। যে ব্যক্তি খুচরা ব্যবসায়ের মাধ্যমে পণ্য বিক্রয় করে তাকে খুচরা ব্যবসায়ী বা Retailer বলে।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ব্যক্তিগত ভোগের জন্য যারা পণ্য খরিদ করে তাদের নিকট যদি কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কোন পণ্য (যেমন চাল, ডাল, টুথপেস্ট ইত্যাদি) বিক্রি করে, তবে সে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান খুচরা ব্যবসায়ে নিয়োজিত হয়েছেন বলে বিবেচনা করা হবে অনুরূপভাবে, কোন কৃষক রাস্তার ধারে বসে শাক-সবজী বা ধান-চাউল বিক্রি করলে তিনিও খুচরা ব্যবসায়ে নিয়োজিত বলে করা হবে। খুচরা ব্যবসায়ী প্রধানত চূড়ান্ত ভোক্তাদের নিকট অব্যবসায়িক ব্যবহারের (non-business use) জন্য পন্য বিক্রি করে থাকে।

W.J. Stanton খুচরা ব্যবসায়ের যে সংজ্ঞা প্রদান করেছেন তা হলো “Retailing includes all activities directly related to the sale of goods or services to the ultimate consumer for personal, non-business use.”

অর্থাৎ ব্যক্তিগত, অব্যবসায়ী কাজের জন্য চূড়ান্ত ভোক্তার নিকট পণ্য ও সেবা বিক্রির সাথে সরাসরি জড়িত সর্বপ্রকার কার্য খুচরা ব্যবসায়ের অন্তর্ভুক্ত।


Philip Kotler & Gary Armstrong এর মতে“Retailing includes all the activities involved in the selling of goods or services directly to final consumers for their personal, non-business use.”

অর্থাৎ যারা ব্যক্তিগত বা অব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে পণ্য ক্রয় করে, তাদের নিকট পণ্য বিক্রয়ের সাথে জড়িত সকল কার্যক্রমই হলো খুচরা ব্যবসায়।

উপরের দুটি সংজ্ঞাতেই খুচরা ব্যবসায়ের প্রকৃতি একইভাবে বর্ণিত হয়েছে। এ ব্যবসায়ের প্রধান উদ্দেশ্য হলো চূড়ান্ত ভোক্তার নিকট সরাসরি পণ্য বিক্রি করা এবং চূড়ান্ত ভোক্তাদের প্রত্যক্ষ সংস্পর্শে থেকে ভোগ্যপণ্য বন্টনের কাজে লিঙ্ক থাকা।

খুচরা ব্যবসায় কত প্রকার ও কি কি :-


বর্তমান যুগে প্রযুক্তির উন্নয়নের সাথে সাথে খুচরা ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান যেকোন আয়তনের হতে পারে। ভোক্তার আবাসস্থলের পাশে ছোট মুদি দোকান থেকে স্বপ্নের বিশাল বিক্রয় শাখাও এর অন্তর্ভুক্ত।

খুচরা ব্যবসায়ের ধরন বিভাজনে সেবা প্রদানের ধরন, পণ্য সারির দৈর্ঘ্য ও গভীরতা তুলনামূলক মূল্য গ্রহণ এবং প্রাতিষ্ঠানিক সংগঠন ইত্যাদি বৈশিষ্ট্যকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে খুচরা ব্যবসায়কে বিভিন্ন ভাবে ভাগ করা হয়, যা নিচে আলোচনা করা হলো -
খুচরা ব্যবসায় কাকে বলে

ক. সেবার পরিমাণভিত্তিক খুচরা ব্যবসায় (Amount of service) :-

ভিন্ন ভিন্ন পণের জন্য ভিন্ন ভিন্ন পরিমাণ সেবার প্রয়োজন হয়। তাই সেবার পরিমাণ ভিত্তিতে খুচরা ব্যবসায়কে তিন ভাগে ভাগ করা হয়। যথা:

১. স্ব-সেবা খুচরা ব্যবসায় (Self service retailers) :-

যে খুচরা ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে চূড়ান্ত ভোক্তাদের নিজের প্রয়োজনীয় পণ্য নিজেকে খুঁজে বের করে ক্রয়ের জন্য নির্বাচন করতে হয় তাকে স্ব-সেবা খুচরা ব্যবসা বলে। যেমন: সুপার মার্কেট হলো স্ব-সেবা খুচরা ব্যবসায়।

২. সীমিত সেবা খুচরা ব্যবসায় (Limited service retailers) :-

যে খুচরা ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান চূড়ান্ত ভোক্তাদের কতিপয় নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে সেবা প্রদান করে তাকে সীমিত সেবা খুচরা ব্যবসায় বলে। যেমন: সিয়ার্স (Sears), জেসি পেনি (JCPenney) এ ধরনের খুচরা ব্যবসায়।

৩. পূর্ণ সেবাদানকারী খুচরা ব্যবসায় (Full service retailers) :-

যে সকল খুচরা ব্যবসায় চূড়ান্ত ভোক্তাদের প্রয়োজনীয় সকল সেবা প্রদান করে তাদেরকে পূর্ণ সেবাদানকারী খুচরা ব্যবসা বলে।


খ. পণ্য সারি ভিত্তিক খুচরা ব্যবসায় (Product lines retailing) :-

পণ্য সারির ভিত্তিতে খুচরা ব্যবসায়ীকে নিম্নোক্ত ভাগে ভাগ করা যায়। যথা:

১. বিশিষ্ট পণ্যের দোকান (Speciality stores) :-

যে খুচরা ব্যবসায়ীরা সীমিত পণ্য সারির বৈচিত্র্যময় পণ্যসম্ভার চূড়ান্ত ভোক্তার জন্য উপস্থাপন করে তাকে বিশিষ্ট পণ্যের দোকান বলে।

২. বিভাগীয় বিপণি (Departmental stores) :-

একই দালানে অবস্থিত ও একই মলিকানা ও ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত বিভিন্ন পণ্য পৃথক পৃথক বিভাগের মাধ্যমে চূড়ান্ত ভোক্তার নিকট বিক্রয়ের ব্যবস্থাসংবলিত খুচরা ব্যবসায়কে বিভাগীয় বিপণি বলে। যেমন: Infinity Mega Mall.

৩. সুপার মার্কেট (Supermarket) :-

যে বৃহদায়তন খুচরা ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান খাদ্যজাতীয় পণ্য বিক্রির পাশাপাশি অন্যান্য পণ্য বিক্রয় করে থাকে তাকে সুপার মার্কেট বলে। যেমন: আমেরিকান স্টোর, আগোরা (Agora), স্বপ্ন (Swapno) ইত্যাদি সুপার মার্কেট।

৪. সুবিধাজনক স্টোরস (Convenience stores) :-

যে গুচরা ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে সীমিত পণ্য সারির উচ্চ মুনাফা অর্জনযোগ্য পণ্য বিক্রয় করা হয় এবং যার অবস্থান সাধারণত আবাসিক এলাকার কাছাকাছি হয় তাকে সুবিধাজনক স্টোরস বলে। যেমন ফ্যামিলি মার্ট (Family Mart), সেভেন-ইলেভেন (Seven Eleven)

৫. সুপারস্টোরস (Superstories) :-

যে বৃহদায়তন খুচরা ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান সুপার মর্কেটের চেয়ে বড় হয় এবং বৈচিত্র্যময় খাদ্য ও ব্যবহার্য পণ্যের সম্ভার থাকে সেই প্রতিষ্ঠানকে সুপারস্টোরস বলে।

৬. ক্যাটাগরি কিলার (Category killer) :-

যে বিশেষায়িত খুচরা ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে বিশেষ পণ্য সারির বিপুল পণ্যসম্ভার উপস্থাপন করা হয় এবং বিক্রয়কর্মীরা সাধারণত সকল পণ্য সম্পর্কে ব্যাপক ধারণা রাখে তাকে ক্যাটাগরি কিলার বলে। যেমন: আইকিয়া (IKEA), স্পোর্টমার্ট (Sports Marn) ইত্যাদি কাটগরি কিলার।

গ. তুলনামূলক মূল্যের ভিত্তিতে খুচরা ব্যবসায় (Retailing on the basis of related price) :-

অধিকাংশ খুচরা ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান স্বাভাবিক মূল্যের সাধারণ মানের পণ্য ও সেবা ব্যবহার করে থাকে। নিচে তুলনামূলক মূল্যের ভিত্তিতে মুচরা ব্যবসায়ের শ্রেণিবিভাগ বর্ণনা করা হলো

১. অফার স্টোরস (Discount stores) :-

যে খুচরা ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে কম মূল্যে কাঙ্ক্ষিত মুনাফা অর্জনের মাধ্যমে অধিক পরিমাণ পণ্য বিক্রির প্রচেষ্টায় নিয়োজিত থাকে তাকে অফার স্টোরস বলে।

২. অফ প্রাইস খুচরা ব্যবসায়ী (Off-price retailers) :-

যে খুচরা ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান পাইকারি মূল্যের তুলনায় কম মূল্যে চূড়ান্ত ভোক্তার নিকট পণ্য বিক্রয় করে তাকে অফ প্রাইস খুচরা ব্যবসায়ী বলে।

৩. ওয়্যারহাউজ ক্লাব (Warehouse clubs) :-

যে খুচরা ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান তার সদস্যদের একটি বিশেষ হারে কমিশন প্রদান করে ওয়্যারহাউজ ক্লাবের নামে মুদি পণ্য, কাপড়, যন্ত্রপাতি বিক্রয় করে তাকে ওয়্যারহাউজ ক্লাব বলে। যেমন: প্রাইসক্লাব, সামস হোলসোদ ক্লাব হলো ওয়্যারহাউজ ক্লাব।

আরও পড়ুন :- নির্দেশনা কাকে বলে?

ঘ. সংগঠনের ভিত্তিতে খুচরা কারবার (Organization based retailing) :-

খুচরা ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান মালিকানার ভিত্তিতে পরিচালিত হলেও কর্পোরেট অথবা চুক্তিভিত্তিক খুচরা ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। নিচে সংগঠনের ভিত্তিতে খুচরা ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের শ্রেণিবিভাগ দেখানো হলো

১. বিপণিমালা (Chain stores) :-

যে সকল খুচরা ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান একই মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণাধীনে দুই বা ততোধিক শাখার মাধ্যমে যখন একই ধরনের পণ্য বিক্রয় করে তাকে বিপণিমালা বলে। এই ব্যবসায় আবার দুই প্রকার।

স্বেচ্ছামূলক চেইন স্টোরস (Voluntary chain stores ) :-

যে সকল খুচরা ব্যবসায়ী পাইকারি বাজারিদের সৌজন্যে সম্মিলিতভাবে পণ্য ক্রয় করে সাধারণভাবে চূড়ান্ত ভোক্তাদের নিকট বিক্রয় করে থাকে তাদের স্বেচ্ছামূলক চেইন স্টোরস বলে

সমবায় খুচরা ব্যবসায়ী ( Retailer cooperative) :-

যে সকল স্বাধীন খুচরা ব্যবসায়ী দলীয়ভাবে কেন্দ্রীয় ক্রয় সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে যৌথভাবে চূড়ান্ত ভোক্তার নিকট বিক্রয় ও বাজার প্রসারমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করে তাকে সমবায় খুচরা ব্যবসায়ী বলে।

২. ফ্রাঞ্চাইজ সংগঠন (Franchise organization) :-

যে খুচরা ব্যবসায়ী উৎপাদনকারী, পাইকারি বিক্রেতা, সেবা প্রতিষ্ঠান ইত্যাদির সাথে একটি চুক্তির মাধ্যমে স্বাধীনভাবে এক বা একাধিক দোকানের মালিকানা ও পরিচালনার অধিকার লাভ করে তাকে ফ্রাঞ্চাইজ সংগঠন বলে।

৩. মার্চেন্ডাইজিং একত্রীকরণ (Merchandising conglomerates) :-

কেন্দ্রীয় মালিকানায় বিভিন্ন খুচরা ব্যবসায়ীর সমন্বয়ে গঠিত কর্পোরেশনকে মার্চেন্ডাইজিং একত্রীকরণ বলে।

8. বহুশাখা বিপণি (Multiple stores) :-

নিজেস্ব মালিকানা ও পরিচালনায় দেশের বিভিন্ন স্থানে শাখা খুলে উৎপাদনকারী যখন তার উৎপাদিত পণ্যসামগ্রী ভোক্তাদের নিকট বিক্রয় করে তখন তাকে বহুশাখা বিপণী বলে।

যেমন: আমাদের দেশে বাটা শু কোম্পনি, ইকরা সিরামিক, সাধনা ঔষধালয় (প্রাঃ) লিঃ ইত্যাদি।

৫. বিপণিবিহীন খুচরা ব্যবসায় (Non-stores retailing) :-

খুচরা দোকান ছাড়াই যখন ভোক্তার নিকট পণ্য বিক্রয় করা হয়। তখন তাকে বিপণিবিহীন খুচরা ব্যবসায় বলে।

আরও পড়ুন :- খতিয়ান কাকে বলে?

এছাড়াও আরো কিছু বিভাগ রয়েছে -

১. সরাসরি বিক্রয় (Direct selling) :-


ক্রেতার নিকট পণ্যসংক্রান্ত প্রয়োজনীয় তথ্য তুলে ধরে সরাসরি পণ্য বিক্রয় প্রক্রিয়াকে সরাসরি বিক্রয় বা প্রত্যক্ষ বাজারজাতকরণ বলা হয়। যেমন: বিভিন্ন ধরনের অনলাইন শপের মাধ্যমে খুচরা ব্যবসায়ীরা ক্রেতার নিকট সরাসরি পণ্য বিক্রয় করে।

২. টেলি-মার্কেটিং (Tele-marketing) :-

টেলিফোনের মাধ্যমে ক্রেতাদের সাথে যোগাযোগ প্রক্রিয়াকে টেলি মার্কেটিং বলা হয়।

৩. অটোমেটিক ভেল্ডিং (Automatic vending) :-


ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যে ব্যক্তিগত যোগাযোগ বাতীত যন্ত্রের মাধ্যমে পণ্য বিক্রয় করার প্রক্রিয়াকে অটোমেটিক ভেন্ডিং বলে। সাধারণত চা, কফি, কোমল পানীয় ইত্যাদি এ পদ্ধতিতে বিক্রয় করা হয়।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ