গ্রামীণ হাট ও বাজার কাকে বলে? গ্রামীণ হাট বাজারের বৈশিষ্ট্য ও গুরুত্ব?

যে কোনো দেশের জাতীয় অর্থনীতিতে হাট ও বাজার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি হাট ও বাজার সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক মিলন কেন্দ্র হিসেবেও কাজ করে। গ্রামীণ সমাজ জীবনে হাট ও বাজারের ভূমিকা তাৎপর্যপূর্ণ।

কোনো অঞ্চলে হাট ও বাজার গড়ে উঠার পিছনে সেই অঞ্চলের অবস্থান, মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থা, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি নিয়ামক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকা পালন করে। এসব হাট ও বাজার নিম্নমানের সেবাকেন্দ্র বা সেন্ট্রাল প্লেস।

গ্রামীণ হাট ও বাজার কাকে বলে :-

গ্রামীণ হাট ও বাজার এমন একটি নির্দিষ্ট স্থান যেখানে নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট সময়ে মানুষ নিজেদের উৎপাদিত উদ্বৃত্ত পণ্যদ্রব্য বিক্রয় এবং প্রয়োজনীয় পণ্যদ্রব্য ক্রয় করতে পারে।

অর্থাৎ- গ্রামীণ হাট ও বাজারে মানুষ প্রয়োজনীয় পণ্যদ্রব্য বিনিময় করতে পারে। তবে হাট ও বাজার শব্দ দুটি ভিন্ন অর্থ এবং কার্য বহন করে।


হাট বলতে নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে, নির্দিষ্ট দিনে এবং নির্ধারিত স্থানে ক্রেতা ও বিক্রেতার একটি সমাবেশ। নির্দিষ্ট দিন ছাড়া অন্যান্য দিন হাটের স্থান সাধারণত ফাঁকা থাকে।

অন্যদিকে, বাজার হচ্ছে দৈনন্দিন পণ্যদ্রব্য বিনিময়ের স্থান। এখানে প্রতিদিন সীমিত পরিসরে পণ্যদ্রব্য ক্রয়-বিক্রয় দেখা যায়। এ ধরনের বাজারে হাট অপেক্ষা কম ক্রেতা-বিক্রেতা থাকে। ফলে বাজার আকারে ছোট হয়।

বাজারে মানুষ সাধারণত দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় পণ্যদ্রব্যই ক্রয়-বিক্রয় করে থাকে। এখানে দ্রুত পচনশীল পণ্য সরবরাহের আধিক্য লক্ষ্য করা যায়।

সাম্প্রতিক সময়ে অধিকাংশ গ্রামীণ এলাকাতে বিদ্যুৎ পৌঁছে যাওয়ায়। এসব বাজার রাত পর্যন্ত জমজমাট থাকে। এছাড়া মোবাইল ফোন এবং প্রযুক্তি ব্যবহার গ্রামীণ এলাকার উন্নয়নে মাইলফলক হিসেবে কাজ করছে। যা গ্রামীণ অর্থনীতিকে গতিশীল করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
গ্রামীণ হাট ও বাজার কাকে বলে

গ্রামীণ হাটের বৈশিষ্ট্য :-

সব গ্রামে হাট না থাকলেও বৃহৎ গ্রামে হাট দেখা যায়। অনেক সময় কয়েকটি গ্রামকে কেন্দ্র করে একটি হাট গড়ে উঠে। নিন্মে গ্রামীণ হাটের সাধারণ বৈশিষ্ট্যসমূহ তুলে ধরা হলো:

১. গ্রামীণ হাট সাধারণত সপ্তাহে ১ বা ২ দিন বসে।

২. আশেপাশের গ্রামগুলোর লোকজনের যাতায়াতের সুবিধা বিবেচনা করে সুবিধাজনক স্থানে গড়ে উঠে।

৩. হাটের দিন আকার বড় হয় এবং অধিক লোক সমাগম হয়।

৪. পাইকারি ও খুচরা পণ্যদ্রব্য ক্রয়-বিক্রয় করা হয়।

৫. দূর-দূরান্ত থেকে ক্রেতা-বিক্রেতার আগমন ঘটে ।

৬. ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, প্রশাসনিক কেন্দ্র, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠে।

৭. বেশিরভাগ হাটে অস্থায়ী কাঁচা ঘর থাকে। তবে বড় বড় হাটে স্থায়ী অবকাঠামোও দেখা যায়।

৮. নিকটবর্তী দুইটি হাট একই দিন বসে না। এক্ষেত্রে উভয় হাটের কর্তৃপক্ষ সমঝোতার মাধ্যমে দিন ঠিক করে থাকে।

৯. বড় হাটগুলেতে একেকটি পণ্যের জন্য পৃথক পৃথক স্থান নির্দিষ্ট করা থাকে। যেমন- গরু, ছাগল, ধান, পাট ইত্যাদির জন্য জায়গা নির্ধারণ করা থাকে।

১০. শাকসবজি, ফলমূল, চা, বিড়ি ইত্যাদি ক্রয়-বিক্রয়ের জন্য চট, পলিথিন ইত্যাদি দ্বারা অস্থায়ী ছাউনি বা উন্মুক্ত থাকে ।

আরও পড়ুন :- জনপদ কাকে বলে?

১১. উন্মুক্ত জায়গায় খোলামেলা পরিবেশে স্বত:স্ফুর্তভাবে ক্রেতা-বিক্রেতার সমাগম ঘটে।

১২. গ্রামীণ হাট সাধারণত দুপুরের পরে বসে।

১৩. কোনো বিশেষ ঘোষণা বা বার্তা থাকলে তা ঢোল পিটিয়ে হাটে প্রচার করা হয়।

গ্রামীণ বাজারের বৈশিষ্ট্য :-

গ্রামীণ বাজারের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যসমূহ নিম্নরূপ :

১. সাধারণত গ্রামীণ রাস্তার পাশে বা কোনো প্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠে।

২. প্রতিদিন পণ্যদ্রব্য বিক্রয় করে থাকে।

৩. কিছু কিছু স্থায়ী দোকানঘর দেখা যায়।

৪. সকালে শুরু হয়ে রাতে শেষ হয়। মহাসড়কের পাশে গ্রামীণ বাজার গভীর রাত পর্যন্ত খোলা থাকে।

৫. সাধারণত পচনশীল পণ্যদ্রব্য যেমন- মাছ, মাংস, শাকসবজি, দুধ ইত্যাদি ক্রয়-বিক্রয় হয়। এছাড়া নিত্য ব্যবহার্য পণ্যদ্রব্য যেমন-তেল, চিনি, সাবান ইত্যাদি পাওয়া যায়।

৬. গ্রামীণ মানুষের চাহিদা বিবেচনা করে পণ্যদ্রব্য ক্রয়-বিক্রয় করা হয়।

৭. গ্রামীণ বাজার কর্মজীবি মানুষের প্রতিদিনের বিনোদনের মিলন কেন্দ্র হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

গ্রামীণ হাট ও বাজারের গুরুত্ব :-

ভারত ও বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ গ্রামীণ এলাকায় বসবাস করে। গ্রামের মানুষের প্রয়োজনীয় পণদ্রেব্য ক্রয়-বিক্রয়ের অন্যতম উপায় হাট ও বাজার। এটি গ্রামীণ মানুষের জীবনযাত্রাকে বহুভাবে প্রভাবিত করে। নিম্নে গ্রামীণ হাট ও বাজারের উল্লেখযোগ্য গুরুত্বসমূহ তুলে ধরা হলো:

১. কেন্দ্রীয় স্থান :

সাধারণত যাতায়াত এবং পণ্যদ্রব্য আনা-নেওয়ার সুবিধা বিবেচনা করে গ্রামের কোনো কেন্দ্রীয় স্থান হাট ও বাজারের জন্য নির্ধারণ করা হয়। এর মূল লক্ষ্য হলো পার্শ্ববর্তী একাধিক ক্রেতা-বিক্রেতাকে আকৃষ্ট করা।

২. পণ্যদ্রব্য ক্রয়-বিক্রয় :

গ্রামের মানুষ কৃষি উৎপাদিত পণ্যদ্রব্যে নিজের চাহিদা মিটিয়ে উদ্বৃত্ত অংশ হাট ও বাজারে বিক্রয় করে। বিশেষ করে পচনশীল পণ্যদ্রব্য দ্রুত বিক্রয় করতে হয়। এক্ষেত্রে হাট ও বাজার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পক্ষান্তরে, প্রয়োজনীয় পণ্য গ্রামের হাট ও বাজার থেকে ক্রয় করে থাকে। এতে গ্রামীণ মানুষ আর্থিক এবং সময়ের দিক থেকে সাশ্রয়ী হয়।

আরও পড়ুন :- অ-ব্যবসায়ী কাকে বলে?

৩. অর্থনৈতিক :

গ্রামীণ হাট ও বাজারে পণ্যদ্রব্য বিক্রয়ের মাধ্যমে গ্রামের মানুষ যে অর্থ আয় করে তা দিয়ে অন্যান্য পণ্যদ্রব্য ক্রয় করে এবং অবশিষ্ট অর্থ সঞ্চয় করে। অর্থাৎ গ্রামের মানুষের অর্থনীতির চাকা আবর্তিত হয় হাট ও বাজারকে কেন্দ্র করে। গ্রামীন অর্থনীতির ভিত্তি সুসংহত হলে তা জাতীয় অর্থনীতিকে গতিশীল করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

৪. পণদ্রেব্যের আন্ত:বিনিময় :

পণ্যদ্রব্যের আন্ত:বিনিময়ের অন্যতম মাধ্যম হাট ও বাজার। অনেক পণ্যদ্রব্য রয়েছে যেগুলো গ্রামে উৎপাদিত হয় না। যেমন-তেল, চিনি, লবণ, সাবান, ঔষধ, হাড়ি, পাতিল, শাড়ি, কাপড়, জুতা ইত্যাদি। গ্রামীণ মানুষের এসব পণ্যদ্রব্যের চাহিদা পূরণ করা হয় গ্রামীণ হাট ও বাজারে আন্ত:বিনিময়ের মাধ্যমে।

৫. বিশেষ পণ্যদ্রব্যের চাহিদা পূরণ :

গ্রামের মানুষের বিশেষ চাহিদা বিবেচনায় নিয়ে ব্যবসায়ীগণ পণ্য সরবরাহ করে থাকে। এতে গ্রামের মানুষ সহজেই হাট ও বাজার থেকে এসব পণ্যদ্রব্য ক্রয় করতে পারে।

৬. পণ্যদ্রব্যের সমাহার :

গ্রামের কৃষকের উৎপাদিত পণ্যদ্রব্যের উদ্বৃত্ত অংশ হাট ও বাজারের মাধ্যমে শহরসহ সারা দেশে এমনকি বিদেশেও পৌঁছায়। এছাড়া দুর্গম অঞ্চল বা যেসব অঞ্চলে পণ্যঘাটতি থাকে সেখানে গ্রামীণ হাট ও বাজার থেকে পণ্যদ্রব্য সংগ্রহ করে সরবরাহ করা হয়। এতে করে দেশের সর্বত্র কৃষিপণ্যের সুষম বন্টন নিশ্চিতে গ্রামীণ হাট ও বাজার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। একই সঙ্গে গ্রামীণ ঐসব পণ্যদ্রব্যের প্রসার ঘটে এবং কৃষক লাভবান হয়।

৭. বহুমুখী কর্মকাণ্ডের কেন্দ্র :

গ্রামীণ হাট ও বাজার পণ্যদ্রব্য ক্রয়-বিক্রয়ের পাশাপাশি বহুমুখী কর্মকাণ্ডের কেন্দ্র হিসেবে কাজ করে। কারো সঙ্গে যোগাযোগ করা, জমিজমা ও কৃষি সংক্রান্ত বিষয়াদি, রাজনৈতিক সভা ও সমাবেশ প্রভৃতি কর্মকাণ্ড সম্পাদনের অন্যতম কেন্দ্র হিসেবে হাট ও বাজার ভূমিকা রাখে।

৮. বিনোদন ও মিলন কেন্দ্র :

গ্রামের মানুষ অবসর সময়ে হাট ও বাজারে গিয়ে একে অন্যের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাত, কুশল বিনিময়, আড্ডা, বন্ধু-বান্ধব ও অন্যান্য লোকজনের সঙ্গে গল্পগুজব করে থাকে। এতে করে পারস্পরিক সৌহার্দ্যতা বৃদ্ধি পায় এবং বন্ধন দৃঢ় হয়। এছাড়া গ্রামীণ হাট ও বাজারে মাঝে মধ্যে সার্কাস, ম্যাজিক শো, গানের আসর বসে। এসব আয়োজন বিনোদনের মাধ্যমে গ্রামের মানুষের মনকে প্রফুল্ল রাখে।

৯. সামাজিক :

গ্রামীণ হাট ও বাজারের সামাজিক গুরুত্ব অপরিসীম। অনেক সময় গ্রামের মানুষের ঝগড়া-বিবাদের মীমাংসা, সামাজিক জটিলতা প্রভৃতি হাট ও বাজারে বসে সমাধান করা হয়। কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে প্রচার-প্রচারনা হাটে ঢোল পিটিয়ে সবাইকে জানানো হয়। হাট ও বাজারে বিভিন্ন গ্রামের মানুষের আগমন ঘটায় এক গ্রামের সাথে অন্য গ্রামের মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক দৃঢ় হয়। এক গ্রামের বিপদে আপদে অন্যগ্রামের মানুষ ছুটে আসে।

পরিশেষে বলা যায় যে, গ্রামীণ মানুষের জীবনযাত্রা এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে হাট ও বাজার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যা জাতীয় উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ