মানচিত্র স্কেল কাকে বলে? স্কেল কত প্রকার ও কি কি? স্কেলের প্রয়োজনীয়তা?

মানচিত্র স্কেল কাকে বলে :-

সাধারণ আভিধানিক অর্থে স্কেল বা মাপনি মানে হচ্ছে- মানদন্ড, অর্থাৎ যা দ্বারা পরিমাপ করা হয়। কিন্তু ভূগোলে জেলের মাধ্যমে মানচিত্রের দূরত্ব এবং ভূমির প্রকৃত দূরত্বের মধ্যবর্তী অনুপাতকে বোঝায়। স্কেল মানচিত্রের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। স্কেল ছাড়া অংকিত ভূপৃষ্ঠের কোন অংশকে নকশা বলা হয়।

মানচিত্রের দু'টি স্থানের দূরত্ব এবং ভূমিতে তাদের মধ্যেকার প্রকৃত দূরত্বের সম্পর্ক বা অনুপাতকে স্কেল বলে।

অন্যভাবে বলা যায় মানচিত্রে ভূ-পৃষ্ঠের বিষয়াদিসমূহ যে অনুপাতে কমানো হয় তাকে মানচিত্রের স্কেল বলে।

উদাহরণ দেয়া যাক, কোন মানচিত্রে যদি দু'টি থানার দূরত্ব ২ (দুই ইঞ্চি) এবং ভূমিতে ঐ দু'টি থানার মধ্যে প্রকৃত দূরত্ব ২০ মাইল হয় তাহলে ঐ মানচিত্রের স্কেল ১ : ৬৩৩৬০০ হবে।

স্কেলের প্রয়োজনীয়তা :-

ভূগোল পঠন-পাঠনে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই স্কেলের প্রয়োজন হয়। মানচিত্রের সাথে যে স্কেল দেয়া থাকে তার সাহায্যে আমরা ঐ মানচিত্রের দু'টি স্থানের মধ্যবর্তী দূরত্ব নির্ণয় করতে পারি। নকশা বা মানচিত্র তৈরির ক্ষেত্রে ভূমিতে অবস্থিত ভৌগোলিক উপাদানসমূহকে সঠিক অনুপাতে প্রকাশ করতে হয়।

যে কারণে কাগজের উপর বৃহৎ এলাকা বা সমগ্র পৃথিবীর মানচিত্র অংকনের জন্য স্কেলের দরকার হয়। অনেক সময় বিদ্যমান মানচিত্রকে একটি নির্দিষ্ট পরিমানে বা অনুপাতে ছোট অথবা বড় করে অংকন করতে হয়। এক্ষেত্রে মানচিত্রকে ছোট বা বড় আকারে পুনরায় অংকন করার জন্য স্কেলের সাহায্য নেয়া হয়।

আরও পড়ুন :- সমোন্নতি রেখা কাকে বলে?

বিভিন্ন ধরনের ভৌগোলিক জরিপ কাজে স্কেলের ব্যবহার অপরিহার্য। তাছাড়া মানচিত্রের আয়তন বা ক্ষেত্রফল পরিমাপের জন্যও স্কেলের প্রয়োজন হয়।

স্কেল কত প্রকার ও কি কি :-

ব্যবহারিক প্রয়োজনীয়তা এবং অংকন পদ্ধতির পার্থক্যের কারনে মানচিত্রে বিভিন্ন ধরণের স্কেলের উপস্থাপন লক্ষ্য করা যায়। আবার কিছু স্কেল আছে যেগুলো সচরাচর মানচিত্রে ব্যবহৃত হয় না, তবে ভৌগোলিক তথ্য উপস্থাপন এবং অনুধাবনে প্রয়োজনীয়।

ব্যবহারিক দিক ও প্রয়োগের ভিন্নতার উপর ভিত্তি করে স্কেলকে প্রাথমিকভাবে পাঁচটি শ্রেণীতে ভাগ করা হয়েছে। বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে এই প্রধান শ্রেণীগুলোর কোন কোনটি আবার কয়েকটি উপ-শ্রেণীতে বিভক্ত। 
মানচিত্র স্কেল কাকে বলে

ক) সরল স্কেল (Simple Scale) :

কোন নির্দিষ্ট মাপ বা হিসাব অনুসারে একটি সরল রেখাকে কতিপয় ভাগে ভাগ করলে তাকে সরল স্কেল বলে।

সরল স্কেলের সাহায্যে মূখ্য ভাগ অপেক্ষাকৃত বৃহৎ এবং গৌণ ভাগ ক্ষুদ্র ইউনিটের মাপ নির্ণয় করা যায়।

এ স্কেলের মাধ্যমে মানচিত্রের উপরিস্থিত দু'টি স্থানের মধ্যবর্তী দূরত্ব সহজে জানা যায়। তাছাড়া, এ স্কেল সাধারণ মানুষের বুঝবার জন্য একটি সহজ পদ্ধতি। সরল স্কেলবিশিষ্ট মানচিত্র ফটোষ্ট্যাট মেশিন বা ক্যামেরার সাহায্যে ছোট বা বড় আকার করলে স্কেল আনুপাতিক হারে ছোট বা বড় হয়। ফলে পরিবর্তিত মানচিত্রেও এই স্কেল কার্যকর থাকে। এ কারণে মানচিত্রে এ ধরনের স্কেল বহুলভাবে ব্যবহৃত হয়।

খ) তুলনামূলক স্কেল (Comparative Scale) :

বিভিন্ন পরিমাপ এককের স্কেলের একটির সাথে অপরটির তুলনা করার জন্য পাশাপাশি একাধিক স্কেল অংকন করা হলে, তাকে তুলনামূলক স্কেল বলে।

আরও পড়ুন :- মানচিত্র কাকে বলে?

সাধারণত এই ধরনের স্কেলের মাধ্যমে ভিন্ন এককে দূরত্বের সাথে দূরত্ব, দূরত্বের সাথে সময়, দূরত্বের সাথে পদক্ষেপ বা দূরত্বের সাথে গাড়ির চাকার আবর্তন প্রভৃতির তুলনা দেখানো হয়। তুলনামূলক স্কেল এক ধরনের সরল স্কেল। শুধুমাত্র ভিন্ন এককের একাধিক স্কেলের মধ্যে সম্পর্ক তুলনা করার জন্য এ স্কেলের ব্যবহৃত হয়। এ ধরনের স্কেলের বিভিন্ন উপ শ্রেণী নীচে আলোচনা করা হল।

. বিভিন্ন দৈর্ঘ্য এককের তুলনামূলক স্কেল (Comparative Scale of Different Units):

বিভিন্ন পরিমাপ এককের স্কেলের একটির সাথে অপরটির তুলনা করার জন্য যখন একই মূলবিন্দু এবং প্রতিভূ অনুপাতে পাশাপাশি একাধিক স্কেল অংকন করা হয়, তখন তাকে বিভিন্ন দৈর্ঘ্য এককের তুলনামূলক স্কেল বলে।

এই ধরনের স্কেলের মাধ্যমে মাইলের সাথে কিলোমিটার, ফুটের সাথে ডেসিমিটার, গজের সাথে মিটার, মাইল বা কিলোমিটারের সাথে ভার্স্ট (Versis) প্রভৃতি এককের মধ্যে তুলনা দেখানো হয়।

২. টাইম স্কেল (Time Scale) :

যে স্কেলের মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি, দল বা গতিশীল বস্তু নির্দিষ্ট সময়ে কতটুকু দূরত্ব অতিক্রম করে তা দেখানো হয় তাকে টাইম স্কেল বলে। যেমন একজন স্কাউট ঘন্টায় তিন মাইল গতিতে মার্চ করছে।

৩. পদক্ষেপ দূরত্ব (Pace Scale) :

নির্দিষ্ট দূরত্ব এবং নির্দিষ্ট দূরত্ব অতিক্রমে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ সংখ্যা দেখিয়ে যে তুলনামূলক স্কেল অংকন করা হয় তাকে পদক্ষেপ স্কেল বলে।

সময়ের স্বল্পতার কারণে অথবা দ্রুত জরিপের প্রয়োজনে যেখানে চেইন বা টেপ দিয়ে পরিমাপ করা সম্ভব হয় না সেই সকল ক্ষেত্রে পদক্ষেপ স্কেল ব্যবহৃত হয়।

সৈনিকদের পদক্ষেপের দূরত্ব ৩০" বা ৭৫ সে.মি ধরা হয়। তবে ব্যক্তি বিশেষে পদক্ষেপের দৈর্ঘ্য পরিবর্তিত হয়। তাই জরিপের পূর্বে জরিপকর্মীর পদক্ষেপের দূরত্ব পরিমাপ করা প্রয়োজন।

৪. আবর্তন স্কেল (Revolution Scale) :

পদক্ষেপ স্কেলের ন্যায় সাইকেল বা গাড়ির চাকার আবর্তনের মাধমে দূরত্ব পরিমাপ করা হয়। নির্দিষ্ট দূরত্ব অতিক্রমে প্রয়োজনীয় আবর্তন সংখ্যা দেখিয়ে যে স্কেল অংকন করা হয় তাকে আবর্তন স্কেল বলে। এই ক্ষেত্রে প্রথমেই চাকার পরিধি নির্ণয় করা হয়।

গ) কর্ণীয় স্কেল (Diagonal Scale):

সুক্ষ্ম পরিমাপের জন্য আয়তক্ষেত্রের পরস্পর বিপরীত কোণদ্বয়ের সংযোজক সরল রেখার সাহায্যে যে স্কেল অংকন করা হয়, তাকে কর্ণীয় স্কেল (Diagonal Scale) বলে।

এই স্কেলের মাধ্যমে প্রাথমিক ও দ্বিতীয় পর্যায়ের ক্ষুদ্রতর দূরত্ব পরিমাপ করা হয়। আয়তক্ষেত্রের কর্ণ দ্বারা একটি ক্ষুদ্র রেখাকে প্রয়োজন অনুযায়ী সমান সংখ্যক ভাগে বিভক্ত করা যায়। এই মূলনীতি হতেই কর্ণীয় স্কেলের উদ্ভব।

ঘ) ভার্নিয়ার স্কেল (Vernier Scale) :

সূক্ষ্ম পরিমাপের জন্য সরল স্কেলের পাশে সংযুক্ত যে ছোট চলনশীল স্কেল ব্যবহার করা হয় তাকে ভার্নিয়ার স্কেল বলে।

ভার্নিয়ার স্কেল একটি যান্ত্রিক স্কেল। এই স্কেলের দু'টি অংশ থাকে চলমান ছোট স্কেলটি হচ্ছে ভার্নিয়ার স্কেল (Vernier Scale) এবং যে মূল স্কেলের পাশে ভার্নিয়ার স্কেলটি সংযুক্ত থাকে তাকে প্রাথমিক (Primary Scale) স্কেল বলে।
 
আরও পড়ুন :- ভূগোল কাকে বলে?

ফ্রান্সের বিখ্যাত গণিতবিদ পিয়েরে ভার্নিয়ার এই ফেল উদ্ভাবন করেন। এই স্কেলের সাহায্যে ক্ষুদ্র দৈর্ঘ্য বিশিষ্ট রেখা বা বস্তুর সঠিক দৈর্ঘ্য সূক্ষ্মভাবে নির্ণয় করা যায়।

ঙ) বিশেষ ধরনের স্কেল (Seales of Special Types) :

অক্ষাংশভেদে সরল স্কেলের পরিবর্তন দেখাতে এবং মানচিত্র বা নকশার ভূমি বন্ধুরতা এবং পরিসংখ্যানিক উপাত্ত প্রদর্শণ করতে কিছু বিশেষ ধরনের স্কেল ব্যবহার করা হয়ে থাকে এগুলো নীচে আলোচনা করা হল।

১. পরিবর্তনশীল স্কেল (Variable Scale) :

অক্ষাংশ পরিবর্তনের সাপেক্ষে সঠিক দূরত্ব পরিমাপের জন্য যে যৌগিক স্কেল অংকন করা হয় তাকে পরিবর্তনশীল স্কেল বলে।

২. ঢালের স্কেল :

সমোন্নতি মানচিত্রে বিভিন্ন সমোন্নতি রেখার মধ্যবর্তী ঢালের পরিমাণ পরিমাপ করার জন্য যে স্কেল ব্যবহার করা হয় তাকে ঢালের স্কেল বলে। এই স্কেলে নির্দিষ্ট উলম বিরতিতে (সাধারণত ১০০ফুট বা ৫০ ফুট) প্রতি ডিগ্রী ঢালের পরিবর্তনের জন্য আনুভূমিক দূরত্বের পরিমাণ দেখানো হয়।

৩. বর্গমূলের স্কেল (Square Root Scale ) :

মানচিত্রে পরিসংখ্যানিক উপাত্ত দেখানোর জন্যে বিভিন্ন আনুপাতিক চিহ্ন ব্যবহার করা হয়। বিভিন্ন দেশ বা শহরের জনসংখ্যা, জমির পরিমাণ ও উৎপাদন প্রভৃতি উপাত্তকে আনুপাতিক বর্গক্ষেত্র, আয়তক্ষেত্র বা বৃত্তের ক্ষেত্রফলের মাধ্যমে প্রদর্শন করা হয়।

৪. ঘনমূলের স্কেল (Cube Root Scale) :

বর্গমূলের স্কেলের মতই মানচিত্রে পরিসংখ্যানিক উপাত্তকে বিভিন্ন ঘন (Cube) বা গোলকের আয়তনের মাধ্যমে প্রদর্শন করা হয়।

৫. চিত্রানুপাত স্কেল (Perspective Scale) :

অনুচিত্র, ভূমি ব্যবহারের প্রতিকী নকশা, ব্লক প্রভৃতি অংকনের সময় প্রয়োজন অনুসারে বিষয়বস্তুকে ছোট বা বড় যে স্কেলে অংকন করা হয় তাকে চিত্রানুপাত স্কেল বলে।

৬. উলম্ব স্কেল (Vertical Scale) :

আকাশ চিত্রের স্কেল নির্ণয়ের জন্য মানচিত্রের স্কেল নির্ধারণের পদ্ধতি ব্যতিক্রম। এক্ষেত্রে স্কেলের সাথে ক্যামেরার ফোকাল দৈর্ঘ্য এবং বিমান উড্ডয়ন উচ্চতার সম্পর্ক নির্ণয় করা হয়।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ