মানচিত্র কাকে বলে? মানচিত্রের প্রকারভেদ? মানচিত্রের ব্যবহার ও গুরুত্ব?

আজ থেকে বহুকাল আগে মানচিত্র অঙ্কন প্রচলিত হয়েছিল। এমনকি আদিম মানুষও লেখার কৌশল আবিষ্কারের পূর্বেই মানচিত্র জাতীয় একটা কিছু অঙ্কন করতে শিখেছিল। তখনকার দিনে বিভিন্ন এলাকার মানুষ নিজেদের সুবিধার জন্য বহু নকশা অঙ্কন করতেন। তাতে কোনো স্কেল বা অন্য কোনো নির্দেশক থাকতো না।

পরবর্তীতে যেসব মানচিত্র তৈরি করা হতো সেগুলো ধারণার ওপর ভিত্তি করে করা হতো। পৃথিবীতে মানচিত্র সর্বপ্রথম কখন ব্যবহৃত হয় সে সম্পর্কে সঠিকভাবে জানা না গেলেও ধারণা করা হয় আজ থেকে প্রায় ৩,০০০ বছর পূর্বে মিশরে বিশ্বের প্রথম মানচিত্র তৈরি করা হয়। নীল নদে প্রতি বছর বন্যার ফলে জমির সীমানা ঠিক থাকত না বলে সীমানা নির্ধারনের জন্য প্রথম মানচিত্র অঙ্কন করা প্রয়োজন হয়। কালের বিবর্তনে আধুনিক মানচিত্র ব্যাপক উন্নতি লাভ করেছে এবং বহুমুখী ব্যবহারের প্রচলন হয়েছে।

মানচিত্র শব্দটির উৎপত্তি :-

এখন আমরা জানব মানচিত্র শব্দটি কীভাবে উৎপত্তি লাভ করেছে। মানচিত্র শব্দটির ইংরেজি প্রতিশব্দ Map ল্যাটিন শব্দ Mappa থেকে Map শব্দের উৎপত্তি। এ শব্দ দ্বারা একখন্ড কাপড়কে বুঝানো হতো। একখণ্ড কাপড় যেমন কোনো কিছুকে আবৃত বা ঢেকে রাখে ঠিক তেমনি একটি মানচিত্র ছোট একটি কাগজে সমগ্র পৃথিবী বা এর কোনো অংশকে অন্তর্ভুক্ত করে।

মানচিত্র কাকে বলে :-

মানচিত্র বলতে আমরা কোনো এলাকার মানসম্মত চিত্রকে বলতে পারি। অর্থাৎ আন্তর্জাতিকভাবে প্রচলিত সাংকেতিক চিহ্ন, নির্দিষ্ট স্কেল এবং অক্ষরেখা ও দ্রাঘিমারেখার সাহায্যে সমতল কাগজের উপর বা অন্য কোনো সমতলের উপর অংকিত সমগ্র পৃথিবী অথবা এর কোনো অংশের প্রতিরূপই হলো মানচিত্র।

আরও পড়ুন:- জলবায়ু কাকে বলে?

সংক্ষেপে বলতে গেলে সমগ্র পৃথিবী অথবা পৃথিবীর কোনো অংশকে কাগজে দেখানোই মানচিত্র।

পৃথিবীর মহাদেশ এবং মহাসাগরসমূহের বিভিন্ন অংশের সীমা, আয়তন, অবস্থান এবং তাদের মধ্যকার পারস্পরিক দূরত্ব বুঝানোর জন্য নির্দিষ্ট মাপনীর (Scale) প্রেক্ষিতে সমগ্র ভূ-পৃষ্ঠের অংশবিশেষের যে নকশা প্রস্তুত করা হয়, তাকে মানচিত্র বলে।

ভূগোলবিদদের মতে- "প্রচলিত সাংকেতিক চিহ্ন, নির্দিষ্ট স্কেল ও অভিক্ষেপের সাহায্যে সমতল কাগজের উপর অঙ্কিত সমগ্র পৃথিবী বা এর অংশবিশেষের প্রতিরূপকে মানচিত্র বলে"।
মানচিত্র কাকে বলে

মানচিত্রের প্রকারভেদ :-

সাধারণত অবস্থানসহ বিভিন্ন বিষয় দেখানোর উদ্দেশ্য মানচিত্র অঙ্কন করা হয়। যেসব বিষয় মানচিত্রে দেখানো হয় সে সকল তথ্যের ওপরই নির্ভর করে মানচিত্রের প্রকৃতি। স্বতন্ত্র বিষয়গুলো আলাদা মানচিত্রে তুলে ধরা হয় বলে বিভিন্ন প্রকার মানচিত্রের প্রচলন হয়েছে। এ সকল বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে মানচিত্রকে প্রধানত দুইভাগে ভাগ করা যায়। যথা

ক. স্কেলের ভিত্তিতে (According to Scale) :

খ. উদ্দেশ্যের ভিত্তিতে (According to Purposes)

আরও পড়ুন :- সৌরজগৎ কাকে বলে?

ক. স্কেলের ভিত্তিতে মানচিত্রের প্রকারভেদ :-

স্কেল অনুসারে মানচিত্র চার প্রকার। যথা

১. মৌজা মানচিত্র (Cadastral Map);

২. ভূ-সংস্থানিক মানচিত্র (Topographical Map);

৩. দেওয়াল মানচিত্র (Wall Map) এবং

৪. ভূ-চিত্রাবলী (Chorographical or Atlas Map)।

এগুলো সম্পর্কে নীচে আলোচনা করা হলো -

১. মৌজা মানচিত্র :


মৌজা বা Cadastral শব্দটির আভিধানিক অর্থ সম্পত্তি নথিভুক্ত করা। সুতরাং সম্পত্তির মালিকানার হিসাব রাখার জন্য যে মানচিত্র তৈরি করা হয় তাকে মৌজা মানচিত্র বলে। এ ধরনের মানচিত্র সাধারণত গ্রামে ব্যবহৃত হয়। মৌজা মানচিত্র একটি, দুইটি বা তিনটি গ্রাম নিয়ে হতে পারে। আবার একটি গ্রামের অংশবিশেষ নিয়েও হতে পারে। এই মানচিত্রের স্কেল সাধারণত ১৬ = ১ মাইল থেকে ৩২ = ১ মাইল পর্যন্ত হয়।

২. ভূ-সংস্থানিক মানচিত্র :

ভূ-সংস্থানিক মানচিত্রে ভূমির বন্ধুরতা, বনভূমি, নদ-নদী, শহর, বন্দর, ঘর-বাড়ি, ভূমির ব্যবহার, পরিবহন প্রভৃতি দেখানো হয়। এ ধরনের মানচিত্রে প্রতীক বিন্দু এবং বিভিন্ন রং দিয়ে দেখানো হয়। ভূ-সংস্থানিক মানচিত্রের সুবিধা হলো কোনো এলাকা সম্পর্কে একসঙ্গে সবকিছু জানা যায়। এ ধরনের মানচিত্রের স্কেল ১=১ মাইল থেকে ১৪" = ১ মাইল পর্যন্ত হতে পারে।।

৩. দেওয়াল মানচিত্র :

সমগ্র পৃথিবী, মহাদেশ বা দেশের তথ্যাদি বড় কাগজে সহজে উপস্থাপনের জন্য দেওয়াল মানচিত্র ব্যবহার করা হয়। দেওয়াল মানচিত্র বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শ্রেণিকক্ষ বা অফিসের দেওয়ালে অথবা বাড়ির দেওয়ালে লাগানো হয়। এ ধরনের মানচিত্রে সাধারণত ১ = ৩০০ মাইল পর্যন্ত দেখানো হয়ে থাকে।

আরও পড়ুন :- মানচিত্র স্কেল কাকে বলে?

৪. ভূ-চিত্রাবলী :

ভূ-প্রকৃতি, জলবায়ু, উদ্ভিজ্জ, কৃষিজ, খনিজ, শিল্প, শহর, যোগাযোগ ইত্যাদি বিষয়ে তথ্যাদি বিভিন্ন রং ও চিহ্নের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়। একে মানচিত্রের সংকলন গ্রন্থ বলা হয়ে থাকে। ভূ-চিত্রাবলী সবচেয়ে ছোট স্কেলে অঙ্কন করা হয়। এ মানচিত্রের স্কেল সাধারণত ১: ১,০০,০০০ বা ১: ১০,০০,০০০ হিসেবে দেখানো হয়।

খ. উদ্দেশ্যের ভিত্তিতে মানচিত্রের শ্রেনীবিভাগ :-

উদ্দেশ্যের ভিত্তিতে মানচিত্রকে নিম্নলিখিতভাবে ভাগ করা যায়

১. বন্ধুরতা মানচিত্র (Relief Map) :

যে মানচিত্রের সাহায্যে ভূ-পৃষ্ঠের সমতার ঢাল, পাহাড়, পর্বত, হ্রদ এবং পৃথিবীর কোনো স্থান কত উঁচু বা কত নিচু এক কথায় পৃথিবীর কাঠামো প্রদর্শন করে তাকে বন্ধুরতা মানচিত্র বলে।

২. ভূ-তাত্ত্বিক মানচিত্র (Geological Map) :

ভূ-তাত্ত্বিক মানচিত্রে কোনো অঞ্চলের মৃত্তিকা ও অভ্যন্তরস্থ স্তর গঠন দেখানো হয়।

৩. উদ্ভিজ্জ মানচিত্র (Vegetation Map) :

পৃথিবীর প্রাকৃতিক উদ্ভিজ্জের বন্টন এ মানচিত্রে দেখানো হয়।

৪. জ্যোতিষ্ক মানচিত্র (Astronomical Map) :

আকাশের বিভিন্ন গ্রহ, উপগ্রহ, নক্ষত্র প্রভৃতির অবস্থান যে মানচিত্রে দেখানো হয় তা হলো জ্যোতিষ্ক মানচিত্র।

৫. জলবায়ু মানচিত্র (Climate Map) :

যে মানচিত্রে একটি দেশ বা মহাদেশের বহু বছরের আবহাওয়ার গড় অবস্থা দেখানো হয় তাকে জলবায়ু মানচিত্র বলে। যেমন- মৌসুমী জলবায়ুর মানচিত্র।

৬. আবহাওয়া মানচিত্র (Weather Map) :

এই মানচিত্রে কোনো দেশ বা অঞ্চলের আবহাওয়ার স্বল্পকালীন অবস্থা প্রদর্শন করা হয়। যেমন- দৈনন্দিন তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত ।

৭. মৃত্তিকা মানচিত্র (Soil Map) :

এ ধরনের মানচিত্রে কোনো অঞ্চলের বা দেশের মৃত্তিকার প্রকারভেদ, শিলার পারস্পরিক সম্বন্ধ ইত্যাদি দেখানো হয়।

৮. সামরিক মানচিত্র (Military Map) :

সামরিক গুরুত্বপূর্ণ স্থান ও যুদ্ধক্ষেত্র সম্পর্কে সুষ্ঠু ধারণা জন্মায় যে মানচিত্র তাকে সামরিক মানচিত্র বলে ।

৯. সাংস্কৃতিক মানচিত্র (Cultural Map) :

এ ধরনের মানচিত্রে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ধারার বন্টন দেখানো হয়। ঐতিহাসিক জাতি-ধর্ম বিন্যাস প্রভৃতি সাংস্কৃতিক মানচিত্রের অন্তর্গত।

১০. অর্থনৈতিক মানচিত্র (Economic Map) :

এ ধরনের মানচিত্রে অর্থ উপার্জনের উৎসভিত্তিক বিষয়গুলো দেখানো হয়। যেমন- কৃষি, প্রাণিজ, বনজ, শিল্প ও খনিজ দ্রব্য সম্পর্কিত তথ্য।

আরও পড়ুন :- সমভূমি কাকে বলে?  

১১. রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক মানচিত্র (Political and Administrative Map) :

যেসব মানচিত্রে বিভিন্ন দেশের সীমানা, অবস্থান, প্রশাসনিক ইউনিট ইত্যাদি দেখানো হয় সেগুলো রাজনৈতিক মানচিত্র।

উপরিউক্ত মানচিত্রগুলো ছাড়াও যোগাযোগ, ভূমি ব্যবহার, সামাজিক, জনসংখ্যা ইত্যাদি মানচিত্র রয়েছে।

মানচিত্রের উপাদান :-

মানচিত্রের প্রধান উপাদান ৫টি। যেমন-

১) সীমানা (Boundary);

২) উত্তরদিক (North Line);

৩) অক্ষরেখা ও দ্রাঘিমারেখা (Latitude and Longitude);

৪) স্কেল (Scale) এবং

৫) শিরোনাম ও সাংকেতিক চিহ্ন (Headings and Symbols)।


১. সীমানা : প্রতিটি মানচিত্রের চারিপাশে নির্দিষ্ট সীমানা থাকবে।

২. উত্তরদিক : প্রতিটি মানচিত্রের উত্তর দিক N বা উত্তর বা (⬆️) এই অ্যারোচিহ্নের মাধ্যমে দেখাতে হবে। অ্যারোচিহ্ন সর্বদা মানচিত্রের উপরের দিকে থাকবে।

৩. অক্ষরেখা ও দ্রাঘিমারেখা : যে এলাকার মানচিত্র সেই এলাকার অক্ষরেখা ও দ্রাঘিমারেখা সঠিকভাবে দেখাতে হবে।

৪. স্কেল : মানচিত্রটি অবশ্যই নির্দিষ্ট ফেলে অঙ্কন করতে হবে। মানচিত্রে যে কোনো দুটি স্থানের মধ্যে দূরত্ব এবং ভূ-পৃষ্ঠে বা ভূমিভাগে ঐ দুটি স্থানের মধ্যে প্রকৃত দূরত্বের যে অনুপাত বা সম্পর্ক তাকে মাপনী বা স্কেল বলে।

৫. শিরোনাম ও সাংকেতিক চিহ্ন : মানচিত্রের শিরোনাম উল্লেখ করে বিষয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট মানচিত্রের বিষয়াদি সঠিক সংকেতের সাহায্যে উল্লেখ করতে হবে।

আরও পড়ুন:- মানব ভূগোল কাকে বলে?

মানচিত্রের ব্যবহার এবং গুরুত্ব :-

ভূগোল ও পরিবেশসহ অন্যান্য প্রায় সকল ক্ষেত্রে মানচিত্রের ব্যবহার দেখা যায়। বই-পুস্তকে লেখনির মাধ্যমে আমাদের এই পৃথিবীর বিভিন্ন তথ্য যেমন তুলে ধরা হয় ঠিক তেমনি মানচিত্রের মাধ্যমেও বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরা যায়। তাই মানচিত্রের ব্যবহার এবং গুরুত্ব দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। মানচিত্রের প্রধান ব্যবহারগুলো নিম্নরূপ :

১. যে কোনো অঞ্চল বা দেশের ভৌগোলিক তথ্যসমূহ সঠিকভাবে, স্বল্প সময়ে এবং বাস্তবসম্মতভাবে জানার জন্য মানচিত্র ব্যবহার করা হয়। এছাড়া কোনো স্থানের অনেক তথ্য একই সঙ্গে জানা যায়।

২. মানচিত্রে স্কেল দেওয়া থাকে বলে দুইটি স্থানের দূরত্ব যে কোনো ব্যক্তি নিজেই নির্ণয় করতে পারেন। ফলে দূরত্ব অনুযায়ী পরিকল্পনা করে প্রয়োজনীয় কার্যাদি সম্পন করা যায়।

৩. যে কোনো অঞ্চলের গ্রাম, শহর বা যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রভৃতি তথ্য সম্পর্কে জানা যায়।

৪. কোনো স্থানের নদ-নদী, পাহাড়-পর্বত, বনভূমি ইত্যাদির অবস্থান জানার জন্য মানচিত্র ব্যবহার করা হয়।

৫. বিভিন্ন ধরনের তথ্য তুলে ধরার জন্য যেমন- কোনো স্থানের আবহাওয়া সম্পর্কে আবহাওয়া মানচিত্র, খনিজ সম্পদের অবস্থান দেখানোর জন্য খনিজ মানচিত্র, জনসংখ্যার বিস্তরণ দেখানোর জন্য জনসংখ্যা মানচিত্র ব্যবহার করা হয়।

৬. সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে কোনো স্থান কত উচ্চতায় অবস্থিত তা তুলে ধরার জন্য মানচিত্র ব্যবহার করা হয়।

৭. সমুদ্রে জাহাজ চালাতে কিংবা আকাশ পথে বিমান চালাতে মানচিত্র ব্যবহার করা হয়।

৮. যুদ্ধ ক্ষেত্রের কৌশল নির্ধারণ, শত্রুর অবস্থান নির্ণয় করার জন্যও মানচিত্র প্রয়োজন। এছাড়া ভ্রমণের জন্য মানচিত্র ব্যবহার করা হয়। মানচিত্র ভ্রমণ পরিকল্পনার পাশাপাশি গাইডের ভূমিকা পালন করে।

৯. বিভিন্ন ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড যেমন: শিল্প-কারখানার অবস্থান মানচিত্রের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়।

১০. যে কোনো ধরনের উন্নয়ন পরিকল্পনার জন্য মানচিত্র ব্যবহার করা হয়।

এছাড়াও কোনো দেশের প্রশাসনিক, রাজনৈতিক, আর্থ-সামাজিকসহ বিভিন্ন পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের জন্য মানচিত্র ব্যবহার করা হয়। সুতরাং আমরা সহজেই অনুমান করতে পারি যে, আমাদের দৈনন্দিন জীবনে মানচিত্রের ব্যবহার এবং গুরুত্ব ক্রমেই বাড়ছে। একই সাথে মানচিত্র পঠন ও পাঠন বৃদ্ধি পাচ্ছে।

আরও পড়ুন:- মালভূমি কি?

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ