সমভূমি কাকে বলে? সমভূমির শ্রেণিবিভাগ? সমভূমির বৈশিষ্ট্য?

সমভূমি কাকে বলে :-

সমুদ্র সমতল থেকে প্রায় সম উচ্চতায় সুবিস্তৃত স্থলভাগকে সমভূমি বলা হয়।

তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে কয়েকশো মিটার উঁচুতেও সমভূমি গঠিত হতে পারে। সমভূমি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে কয়েকশত ফুট পর্যন্ত উচ্চতায় অবস্থিত হতে পারে।

সমভূমিতে মৃদু ঢাল বিশিষ্ট ভূমি, ছোট ছোট টিলা, পাহাড় এবং নদী উপত্যকার উপস্থিতিও লক্ষ্য করা যায়। পৃথিবীর মোট স্থলভাগের প্রায় অর্ধেক সমভূমি। মানুষের আবাস এবং অর্থনৈতিক কামকাণ্ড সমভূমিতে সংঘটিত হয়।

সমগ্র পৃথিবীর মধ্যে এশিয়া, ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকা মহাদেশে সমভূমির পরিমাণ সবচেয়ে বেশি আফ্রিকা মহাদেশে সমভূমির পরিমাণ সবচেয়ে কম। ইউরেশিয়ার উত্তরাংশ জুড়ে পৃথিবীর বৃহত্তম সমভূমি অবস্থিত। ভূ-তাত্ত্বিক গঠনের দিক দিয়ে সমভূমিগুলো যথেষ্ট বৈচিত্র্যপূর্ণ।

সমভূমির বৈশিষ্ট্য :-

সমভূমিতে সাধারণত কোনো উচ্চভূমি, নিম্নভূমি বা খাড়া ঢাল থাকে না। তবে সামান্য উঁচু-নিচু বা বন্ধুর হতে পারে। সমভূমিসমূহ সাধারণত মহাদেশের সীমান্তে মহাসাগরের তীরে অথবা মহাদেশীয় ভূ-ভাগের অভ্যন্তরে হতে পারে।

সমভূমির শ্রেণিবিভাগ :-

অবস্থান ও গঠনপ্রণালির ওপর ভিত্তি করে পৃথিবীর সমভূমিকে নিম্নলিখিত ভাগে বিভক্ত করা যায়।
সমভূমি কাকে বলে

১. ক্ষয়জাত সমভূমি :

বহু উচ্চভূমি দীর্ঘদিন ধরে নানা প্রকার প্রাকৃতিক শক্তি যেমন- বায়ুপ্রবাহ, সৌরতাপ, বৃষ্টিপাত, পানিস্রোত, হিমবাহ প্রভৃতি দ্বারা ক্ষয় হয়ে ধীরে ধীরে অপেক্ষাকৃত নিম্নভূমিতে পরিণত হয়। এ জাতীয় সমভূমিকে ক্ষয়জাত সমভূমি বলে।

ইউরোপের ফিনল্যান্ড ও উত্তর আমেরিকার হাডসন উপসাগর তীরবর্তী সমভূমি ক্ষয়জাত সমভূমির উদাহরণ।

২. হৈমবাহিক সমভূমি :

উচ্চ পর্বতগাত্র হতে বরফের প্রবাহ বা হিমবাহ নিচের দিকে নেমে আসার সময় প্রবল বর্ষণে ভূমি ক্ষয় হয়ে সমভূমিতে রূপান্তরিত হয়। আবার হিমবাহের সাথে যে সকল শিলা, কাঁকর ও নানাবিধ প্রস্তরখন্ড নিচে নেমে আসে সেগুলো সঞ্চিত হতে হতে অসমান ভূমিকে সমভূমিতে পরিণত করে। এভাবে হিমবাহের মাধ্যমে এ জাতীয় সমভূমি সৃষ্টি হয় বলে একে হৈমবাহিক সমভূমি বলে।

এ জাতীয় সুবিস্তৃত সমভূমি উত্তর-পশ্চিম ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার উত্তরাংশ, ফিনল্যান্ড, পূর্ব কানাডা এবং সুইডেনে দেখা যায়।

আরও পড়ুন :- মালভূমি কাকে বলে?

৩. কার্স্ট সমভূমি :

চুনাপাথরের বৈশিষ্ট্যমন্ডিত অঞ্চলে ভূ-গর্ভস্থ জলধারার মাধ্যমে সৃষ্ট সমভূমিকে কার্স্ট সমভূমি বলে।

যুগোশ্লোভিয়ার কার্স্ট অঞ্চলে এ জাতীয় সমভূমি দেখা যায়। এ কার্স্ট অঞ্চলটি আড্রিয়াটিক সাগরের পূর্ব তীরের সাথে সমান্তরালভাবে প্রায় ৮০ কি. মি. দীর্ঘ এলাকা জুড়ে অবস্থিত। ভূ-গর্ভস্থ জলধারা দ্বারা খড়িমাটি বা চুনাপাথর দ্রবীভূত হয়ে কার্স্ট সমভূমি সৃষ্টি হয়।

৪. সঞ্চয়জাত সমভূমি :

বিভিন্ন প্রকার প্রাকৃতিক শক্তি যেমন- নদী, বায়ুপ্রবাহ ও হিমবাহের মাধ্যমে উচ্চভূমি ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে পলিমাটি, কাঁকর, বালু, কর্দম প্রভৃতি নিম্নস্থানে সঞ্চিত হয়ে যে সমভূমির সৃষ্টি হয় তাকে সঞ্চয়জাত সমভূমি বলে।

এ জাতীয় সমভূমি যে কোনো ভূমির তুলনায় অধিক উর্বরতাসম্পন্ন। অবস্থান ও গঠনপ্রণালির উপর ভিত্তি করে সঞ্চয়জাত সমভূমিকে নিম্নলিখিত কয়েকটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। যথা

ক. লাভা সমভূমি :

আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের ফলে নির্গত গলিত লাভা দ্বারা ভূ-পৃষ্ঠের যে সমভূমির সৃষ্টি হয়, তাকে লাভা সমভূমি বলে। দাক্ষিণাত্যের উত্তর-পশ্চিমাংশের কৃষ্ণ মৃত্তিকাময় সমভূমিটি লাভা সমভূমির উদাহরণ।


খ. পলিজ সমভূমি :

নদীবাহিত কাঁকর, বালি, পলি প্রভৃতি সঞ্চিত হয়ে যে সমভূমি সৃষ্টি হয় তাকে পলিজ সমভূমি বলে। পৃথিবীর সবচেয়ে বিস্তীর্ণ সমভূমিগুলো এভাবে গঠিত হয়েছে।

যেমন- মিসিসিপি অববাহিকা, নীল নদের অববাহিকা, গঙ্গা অববাহিকা, হোয়াংহো অববাহিকা প্রভৃতি সমভূমি দীর্ঘদিন যাবৎ পলি সঞ্চিত হয়ে গঠিত হয়েছে। এ জাতীয় সমভূমি কৃষিকাজের জন্য বিশেষভাবে উপযোগী।

পলিজ সমভূমিকে আবার তিন ভাগে ভাগ করা যায়। যথা

i) পাদদেশীয় সমভূমি :

পাহাড়ী নদী দ্বারা পর্বতের ঢাল হতে ক্ষয়প্রাপ্ত নানা আকৃতির প্রস্তর ও শিলাখন্ড, কাঁকর, নুড়ি ও বালুকণা প্রভৃতি পর্বতের পাদদেশে সঞ্চিত হয়। এভাবে নদী দ্বারা অবক্ষেপণের ফলে পর্বতের পাদদেশে যে সমভূমির সৃষ্টি হয় তাকে পাদদেশীয় সমভূমি বলে।

যেমন- বাংলাদেশের দিনাজপুর এবং রংপুর জেলার অধিকাংশই পাদদেশীয় সমভূমি।

ii) প্লাবন সমভূমি :

নদীর পরিণত অবস্থাতে বন্যার সময় পানি স্রোতের সাথে বালি, কাঁকর প্রভৃতি এর গতিপথের দু'দিকে অবস্থিত অপেক্ষাকৃত নিম্নভূমিতে জমা হয়ে যে সমভূমির সৃষ্টি হয় তাকে প্লাবন সমভূমি বলে।

iii) ব-দ্বীপ :

নদীর গতিপথের সর্বশেষ পর্যায়ে অর্থাৎ সমুদ্রে পতিত হওয়ার পূর্বে নদীর গতি সর্বাধিক মন্থর থাকে এবং পানিতে পলির পরিমাণ থাকে সর্বাধিক। ফলে নদীর মোহনাতে প্রচুর পরিমাণে পলি সঞ্চিত হয়। এ পলি সঞ্চিত হতে হতে বাংলা মাত্রাহীন 'ব' এর মতো যে সমভূমির সৃষ্টি হয় তাকে ব-দ্বীপ বলে।

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাংশ, পাকিস্তানের সিন্ধু, মিশরের নীল, ব্রহ্মদেশের ইরাবতী, চীনের ইয়াংসি, হোয়াংহো, উত্তর আমেরিকার মিসিসিপি, ইতালির পো প্রভৃতি নদীর মোহনায় বিস্তীর্ণ ব-দ্বীপ গঠিত হয়েছে।

গ. লোয়েস সমভূমি :

বায়ুপ্রবাহের মাধ্যমে ধূলিকণা, বালুকা, মাটি প্রভৃতি একস্থান থেকে অন্যস্থানে সঞ্চিত হয়। ভূমির ক্ষয় ও গঠনের ক্রিয়াশীল। বায়ুর দ্বারা দীর্ঘদিনের স্যাক্রিয়ার ফলে ধীরে ধীরে যে সমভূমি গঠিত হয় তাকে লোয়েস সমভূমি বলে।

চীনের পূর্বদিকে হোয়াংহো নদীর উপত্যকায় বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত গোবি মরুভূমির বালুরাশি সঞ্চিত হয়ে লোয়েস সমভূমি সৃষ্টি হয়েছে।

ঘ. উপকূলীয় সমভূমি :

ভূ-আন্দোলনের ফলে মহীসোপান বা মহীঢাল অঞ্চলে অর্থাৎ সমুদ্র তীরের মহাদেশগুলোর প্রাস্তভাগে যে সমভূমির সৃষ্টি হয় তাকে উপকূলীয় সমভূমি বলা হয়।

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাংশের উপকূলে সরু অথচ সুদীর্ঘ উপকূলীয় সমভূমির উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ