তরঙ্গ কাকে বলে? তরঙ্গের বৈশিষ্ট্য? তরঙ্গ কত প্রকার ও কি কি?

পুকুর বা জলাশয়ের পানিতে এক টুকরো চিল ফেললে চারিদিকে পানির ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে। সমুদ্রের সৈকতে বা বিশাল জলাশয়ের পাড়ে পানির ঢেউ আছড়ে পড়ে। এই ঢেউ বিজ্ঞানের ভাষায় তরঙ্গ।

আমাদের চারিদিকে বিভিন্ন রকম তরঙ্গের মধ্যে একটি হলো পানির তরঙ্গ। অন্যান্য তরঙ্গ হলো শব্দ তরঙ্গ, আলোক তরঙ্গ, বেতার তরঙ্গ, বিভিন্ন ধরনের তাড়িতচুম্বকীয় তরঙ্গ ইত্যাদি। তরঙ্গের মাধ্যমে শক্তি সঞ্চারিত হয়। পুকুরের তরঙ্গ সম্পর্কে আমাদের কিছু ধারণা আছে সত্য, কিন্তু বিভিন্ন প্রকার তরঙ্গের পর্যাপ্ত এবং সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করতে হলে তরঙ্গ সম্পর্কে আমাদের আরও কিছু জানা দরকার।

এ পোস্টে প্রথমে তরঙ্গ সম্পর্কীয় কিছু মৌলিক বিষয় যেমন- পর্যাবৃত্ত গতি, স্পন্দন ও সরল ছন্দিত স্পন্দন, তরঙ্গ সম্পর্কিত রাশিসমূহ, তরঙ্গ দৈর্ঘ্য ও তরঙ্গ বেগের সম্পর্ক এবং তরঙ্গের প্রকারভেদ নিয়ে আলোচনা করা হবে।

তরঙ্গ কাকে বলে:-

শুধু পানি নয় যে কোন তরল, বায়বীয় এমনকি কঠিন পদার্থে কণা সমষ্টির মধ্যের কোনো একটি কণাকে তার স্থির অবস্থান থেকে সামান্য স্থানচ্যুত করলে মাধ্যমের স্থিতিস্থাপকতা এবং কণাটির গতি জড়তার জন্য তার সাম্য অবস্থার উভয় দিকে আন্দোলিত হতে থাকে।

আবার মাধ্যমের প্রত্যেকটি কণার সাথে অপর কণার সংসক্তি জনিত এমন একটি বন্ধন থাকে যে, একটি কণা আন্দোলিত হলে পার্শ্ববর্তী কণাও তাকে অনুসরণ করে এদিক ওদিক দুলতে বা আন্দোলিত হতে বাধা হয়।

এভাবে মাধ্যমের কোনো একটি কণার আন্দোলন শুরু হলে তা এক কণা থেকে অন্য কণায় সঞ্চারিত হয় এবং মাধ্যমের মধ্য দিয়ে বিস্তৃত হতে থাকে। এই গতিশীল আন্দোলনই তরঙ্গ।

বিভিন্ন কণার কম্পন থেকেই তরঙ্গ উৎপত্তি হয়। অর্থাৎ তরঙ্গ সৃষ্টির জন্য জড় মাধ্যম প্রয়োজন হয়।

জড় মাধ্যমের কণাগুলোর স্পন্দনের ফলে সৃষ্ট যে পর্যাবৃত্ত আন্দোলন ঐ মাধ্যমের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে শক্তি সঞ্চারিত করে কিন্তু মাধ্যমের কণাগুলো স্থানান্তরিত হয় না, সেই পর্যাবৃত্ত আন্দোলনকে তরঙ্গ বলে।

জড় মাধ্যমের কণার আন্দোলন ছাড়াও তরঙ্গ সৃষ্টি হতে পারে। কিন্তু জড় মাধ্যমের কণার আন্দোলনে সৃষ্ট তরঙ্গকে বলা হয় যান্ত্রিক তরঙ্গ।

আমরা কথা বলি, বিভিন্ন উপায়ে শব্দ সৃষ্টি করি বা শব্দ সৃষ্টি হয় তা বিভিন্ন জড় পদার্থের কম্পন থেকে। তাই পানির তরঙ্গ, শব্দ তরঙ্গ, ভূমি কম্পনের ফলে সৃষ্ট ভূ-তরঙ্গ ইত্যাদি যান্ত্রিক তরঙ্গ।

আমরা সূর্য থেকে আলো এবং তাপ পাই। সূর্য থেকে পৃথিবীতে আলো এবং তাপ আসে তরঙ্গাকারে। সূর্য এবং পৃথিবীর মধ্যে মহাশূন্য, কোন জড় মাধ্যম নেই। আলো, তাপ মাধ্যম ছাড়াই বিশেষ ধরনের তরঙ্গ আকারে সঞ্চারিত হয়। এ তরঙ্গকে বলা হয় তাড়িতচুম্বকীয় তরঙ্গ।

তাড়িতচুম্বকীয় তরঙ্গের উদাহরণ- বেতার তরঙ্গ, এক্সরশ্মি, গামারশ্মি ইত্যাদি।

তরঙ্গ কিভাবে সৃষ্টি হয়:-

পুকুরের মধ্যে স্থির পানিতে ঢিল ছুড়েছেন কখনও? কি! চোখে ভাসছে তাই তো? তরঙ্গ বলতে এ দৃশ্যটাই ভেসে ওঠে আমাদের মনে। কিন্তু কখনও কি ভেবে দেখেছেন কেন এমন হয়?

ঢিলটি পানিতে ফেললে ঐ স্থানের পানির কণাগুলোর উপর ধাক্কা বা চাপ পড়ে, ফলে পানির কণাগুলো নিচে নেমে যায়। আর চারপাশের কণাগুলো উপরেই থেকে যায়।

কিন্তু এ অবস্থা খুবই অল্প সময়ের জন্য, মুহুর্তের মধ্যে নিম্নগামী কণাগুলোর উপর থেকে ঢিলের চাপ সরে যায় ফলে কণাগুলো আগের জায়গায় ফিরে আসার জন্য বিপরীত অর্থাৎ ঊর্ধমুখী ধাক্কা দেয়।

কিছু কণা গতি জড়তার প্রভাবে আগের সাম্যাবস্থা থেকে উপরে উঠে যায়। এভাবে পানির কণাগুলোর মধ্যে এক ধরণের উপর নিচে গতিশীল সরল ছন্দিত স্পন্দন সৃষ্টি হয়। ক্রমশ এই স্পন্দন তার পার্শ্ববর্তী কণার মধ্যে সঞ্চারিত হয়। এভাবে পানির কণার উঠা নামা থেকেই পানি তলের ওঠা নামা তথা ঢেউ বা তরঙ্গ সৃষ্টি হয়।

আপনি অবশ্য লক্ষ্য করেছেন পুকুরের মাঝখানে উৎপন্ন এই তরঙ্গ ধীরে ধীরে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং এক সময় পাড়ে গিয়ে আছড়ে পড়ে। এতে শক্তি এক স্থান থেকে অন্য স্থানে সঞ্চারিত হয়।

শুধু পানি নয় যে কোন তরল, বায়বীয়, এমনকি কঠিন পদার্থ-কণার মধ্যেও এভাবে স্পন্দন বা কম্পন সৃষ্টি হলে তরঙ্গ সৃষ্টি হয়। অর্থাৎ তরঙ্গ সৃষ্টির জন্য জড় মাধ্যম প্রয়োজন হয় আর জড় মাধ্যমের কণাগুলোর স্পন্দনের ফলে সৃষ্ট।

তরঙ্গের বৈশিষ্ট্য :-

তরঙ্গের কিছু গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য নিম্নরূপ:

১. পর্যাবৃত্ত আন্দোলন: তরঙ্গ হল একটি পর্যাবৃত্ত আন্দোলন। মাধ্যমের কণাগুলো নির্দিষ্ট একটি অবস্থা থেকে শুরু করে সেই অবস্থায় ফিরে আসে।

২. শক্তি সঞ্চার: তরঙ্গ মাধ্যমের মধ্য দিয়ে শক্তি সঞ্চার করে কিন্তু মাধ্যমের কণাগুলো স্থানান্তরিত হয় না।

৩. দিক নির্ভরশীল: তরঙ্গের দিক ও গতিবেগ থাকে।

৪. আয়তন ও আবৃত্তি: প্রতিটি তরঙ্গের নির্দিষ্ট আয়তন ও আবৃত্তি থাকে।

৫. প্রক্ষেপণ বেগ: প্রতিটি মাধ্যমে তরঙ্গের একটি নির্দিষ্ট গতিবেগ থাকে যাকে প্রক্ষেপণ বেগ বলে।

৬. পরস্পর ক্রিয়া: তরঙ্গগুলো পরস্পরের সাথে ক্রিয়াকরানোর সক্ষমতা রাখে।

৭. তরঙ্গ মাধ্যমের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে শক্তি ও তথ্য সঞ্চারণ বা স্থানান্তর করে।

৮. এক স্থান থেকে অন্য স্থানে তরঙ্গ সঞ্চারণের জন্য সময় প্রয়োজন হয়।

৯. তরঙ্গের কণাগুলোর বিভিন্ন বেগে স্পন্দিত হয়। স্পন্দনের বেগ পর্যায়ক্রমে কমে বাড়ে। কিন্তু তরঙ্গ সুষম বেগে সঞ্চারিত হয়। অর্থাৎ কণাগুলোর স্পন্দন গতি এবং তরঙ্গ বেগ এক নয়।

১০. তরঙ্গ সৃষ্টিকারী কণাগুলোর স্পন্দনের দিক এবং তরঙ্গ সঞ্চারণের দিক এক নাও হতে পারে।

১১. তরঙ্গের প্রতিফলন, প্রতিসরণ, ব্যতিচার, অপবর্তন ঘটে।

তরঙ্গ কত প্রকার ও কি কি :-

উপরের আলোচনার আমরা দেখেছি এক ধরণের তরঙ্গ সঞ্চারণের জন্য জড় মাধ্যম প্রয়োজন হয়। অন্য এক ধরণের তরঙ্গের জন্য কোনো মাধ্যম প্রয়োজন হয় না। প্রথম প্রকার তরঙ্গকে যান্ত্রিক তরঙ্গ এবং দ্বিতীয় প্রকার তরঙ্গকে তাড়িত চুম্বকীয় তরঙ্গ বলে। মাধ্যমের কণাগুলোর স্পন্দনের ফলে যে যান্ত্রিক তরঙ্গ সৃষ্ট হয় তা দু'ধরণের যথা
  1. অনুপ্রস্থ তরঙ্গ (Transverse wave) ও
  2. অনুদৈর্ঘ্য তরঙ্গ (Longitudinal wave)।

অনুপ্রস্থ তরঙ্গ কাকে বলে :-

এককথায়, যে তরঙ্গ কম্পনের দিকের সাথে লম্বভাবে অগ্রসর হয় তাকে অনুপ্রস্থ তরঙ্গ বলে।

পানির মধ্যে তরঙ্গ সৃষ্টি হয় সে ক্ষেত্রে পানির কণাগুলো সাম্য অবস্থান পানির তল থেকে উপর-নিচে ওঠা নামা করে। কিন্তু তরঙ্গ পানি পৃষ্ঠ বা পানির তলের উপর দিয়ে সামনে ছড়িয়ে পড়ে। এধরণের তরঙ্গ অনুগ্রস্থ তরঙ্গ।

অর্থাৎ যে তরঙ্গ মাধ্যমের কণাগুলোর স্পন্দনের দিকের সাথে সমকোণে অগ্রসর হয়, তাকে অনুগ্রস্থ তরঙ্গ বলে।

চিত্র - ক একটি অনুপ্রস্থ তরঙ্গের মাধ্যমের কণার কম্পাঙ্ক এবং তরঙ্গ প্রবাহের দিক দেখান হয়েছে। চিত্র - খ একটি অনুপ্রস্থ তরঙ্গের A, B, C বিন্দুগুলো তরঙ্গ শীর্ষ। আবার P, Q, R বিন্দুগুলো তরঙ্গ পাদ। এখানে পর পর দুটি তরঙ্গ শীর্ষ A, B বা পরপর দুটি তরঙ্গ পান Q, R অথবা একই দশার পরপর দুটি বিন্দুর মধ্যের দূরত্ব যেমন b, d e g নিয়ে তরঙ্গ দৈর্ঘ্য À গঠিত হয়।
অনুপ্রস্থ তরঙ্গ কাকে বলে

এ তরঙ্গ মাধ্যমের কণাগুলোর স্পন্দনের দিকের সাথে সমকোণে বা আড়াআড়ি অগ্রসর হয় বলে একে অনুপ্রস্থ তরঙ্গ বা আড় তরঙ্গ বলে। আলোক তরঙ্গ, বেতার তরঙ্গ, পানির তরঙ্গ অনুপ্রস্থ তরঙ্গ।

অনুদৈর্ঘ্য তরঙ্গ কাকে বলে :-

এককথায়, যে তরঙ্গ কম্পনের দিকের সাথে সমান্তরালভাবে অগ্রসর হয় তাকে অনুদৈর্ঘ্য তরঙ্গ বলে।

একটি নমনীয় স্প্রিং এর এক প্রাপ্ত দেয়ালে বেঁধে অন্য প্রাপ্ত টান করে ধরে যে কোন প্রান্তে মৃদু আঘাত করলে দেখতে পাবেন স্প্রিংটির কিছু কুণ্ডলীকৃত অংশ সংকুচিত হয়েছে। কিন্তু পরবর্তি অংশ প্রসারিত রয়েছে।

এবং অতি দ্রুত এ সংকুচিত অংশ সামনে সরে গিয়ে পেছনের কুন্ডলীতে প্রসারিত অংশ সৃষ্টি হচ্ছে। এভাবে সংকোচন-প্রসারণ পর্যায়ক্রমে এক প্রাপ্ত থেকে অন্য প্রান্তের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

লক্ষ্য করলে দেখবেন, স্প্রিং এর কুন্ডলীগুলো নিজ নিজ অবস্থানের থেকে সামনে পেছেনে আন্দোলিত বা স্পন্দিত হচ্ছে কিন্তু কম্পন এক প্রাপ্ত থেকে অন্য প্রাপ্তে সঞ্চারিত হচ্ছে। এটি পর্যাবৃত্ত আন্দোলন।

এই আন্দোলন জড় মাধ্যমের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে শক্তি সঞ্চারিত করে, কিন্তু মাধ্যমের কণাগুলো স্থানান্তরিত হয় না, এটি এক প্রকার তরঙ্গ। এর নাম অনুদৈর্ঘ্য তরঙ্গ।

তাই যে তরঙ্গ মাধ্যমের কণাগুলোর স্পন্দনের দিকের সাথে সমান্তরালে অগ্রসর হয়, সেই তরঙ্গকে অনুদৈর্ঘ্য তরঙ্গ বলে।

অনুদৈর্ঘ্য তরঙ্গ মাধ্যমের কণাগুলোর সংকোচন ও প্রসারণের মাধ্যমে অগ্রসর হয়। একটি সংকোচন এবং একটি প্রসারণ অংশ নিয়ে একটি তরঙ্গ গঠিত হয়।

নীচের ছবিতে (R) এবং (C) অংশগুলো যথাক্রমে প্রসারিত এবং সংকুচিত অংশ। এক্ষেত্রে কোন তরঙ্গ শীর্ষ বা তরঙ্গ পাদ থাকে না। চিত্রে a থেকে b পর্যন্ত দৈর্ঘ্য À।
অনুদৈর্ঘ্য তরঙ্গ কাকে বলে

অনুদৈর্ঘ্য তরঙ্গ ও অনুপ্রস্থ তরঙ্গের পার্থক্য :-

অনুদৈর্ঘ্য তরঙ্গ ও অনুপ্রস্থ তরঙ্গের মধ্যে প্রধান পার্থক্যগুলো নিম্নরূপ:

কি বা কাকে বলে:

যে তরঙ্গ কম্পনের দিকের সাথে সমান্তরালভাবে অগ্রসর হয়, তাকে অনুদৈর্ঘ্য তরঙ্গ বলে।

যে তরঙ্গ কম্পনের দিকের সাথে লম্বভাবে অগ্রসর হয়, তাকে অনুপ্রস্থ তরঙ্গ বলে।

উদাহরণ:

উদাহরণ – বায়ু মাধ্যমে শব্দের তরঙ্গ, স্প্রিং তরঙ্গ। উদাহরণ – পানির তরঙ্গ, আলোক তরঙ্গ।

দিক:

অনুদৈর্ঘ্য তরঙ্গে কণার স্পন্দন তরঙ্গের অগ্রসরণ দিকের সমান্তরাল হয়।

অনুপ্রস্থ তরঙ্গে কণার স্পন্দন তরঙ্গের অগ্রসরণ দিকের লম্বাকার।

শক্তি সঞ্চার:

অনুদৈর্ঘ্যতে শক্তি তরঙ্গের দিকের সমান্তরালে সঞ্চারিত হয়।

অনুপ্রস্থতে শক্তি তরঙ্গের দিকের লম্বকারে সঞ্চারিত হয়।

প্রয়োগ:

অনুদৈর্ঘ্য তরঙ্গকে রেডিও ও মাইক্রোওয়েভে ব্যবহার করা হয়।

অনুপ্রস্থ তরঙ্গকে প্রকাশনা ও দৃশ্যমান আলোর জন্য ব্যবহার করা হয়।

অগ্রগামী তরঙ্গ কাকে বলে :-

যখন কোনো মাধ্যমের ভিতর দিয়ে আন্দোলন এক স্তর থেকে অন্য স্তরে তরঙ্গ আকারে সঞ্চারিত হতে হতে নির্দিষ্ট বেগে কেবল সামনের দিকে অগ্রসর হয় তখন তাকে অগ্রগামী তরঙ্গ বলে।
অগ্রগামী তরঙ্গ কাকে বলে

অগ্রগামী তরঙ্গের উদাহরণ:

পানিতে ঢিল ফেললে আড় তরঙ্গ সৃষ্টি হয়, তরঙ্গ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং কেবলই সামনের দিকে অগ্রসর হয়।

বাতাসের মধ্যে কোনো এক বিন্দুতে সৃষ্ট শব্দ দীঘল তরঙ্গাকারে সবদিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং কেবলই সামনের দিকে চলতে থাকে। এগুলো অগ্রগামী তরঙ্গ।

স্থির তরঙ্গ কাকে বলে:

একই রকম দুটি অগ্রগামী তরঙ্গ বিপরীত দিক থেকে সমভাবে অগ্রসর হয়ে একে অপরের উপর আপতিত হলে যে তরঙ্গের উদ্ভব হয় তাকে স্থির তরঙ্গ বলে।

একটি তারের বা মোটা দড়ির এক প্রান্ত একটি দৃঢ় অবলম্বনে বেঁধে অন্য প্রান্ত ধরে উপর নিচে দোলালে একটি তরঙ্গ তার বেয়ে অগ্রসর হবে এবং বন্ধ প্রান্তে প্রতিফলিত হয়ে আবার ফিরে আসবে। এই প্রতিফলিত তরঙ্গ যখন নতুন অগ্রগামী তরঙ্গের উপর আপতিত হবে তখন স্থির তরঙ্গ উদ্ভব হবে।

এই তরঙ্গ তার বা দড়ি বেয়ে অগ্রসর না হয়ে বরং তার বা দড়ির ঐ অংশের মধ্যে উৎপন্ন ও লুপ্ত হবে। তরঙ্গের উদ্ভবের সময় দেখা যাবে তারের কোনো কোনো বিন্দুতে কোনো স্পন্দন নাই, যেমন N¹, N², N³, ইত্যাদি।
স্থির তরঙ্গ কাকে বলে

আবার কোনো কোনো বিন্দুতে সব সময় সর্বাধিক স্পন্দন হতে থাকবে। যেমন A¹, A², A³ ইত্যাদি। প্রথমোক্ত বিন্দুগুলোকে নিস্পন্দ বিন্দু (Node) এবং শেষোক্ত বিন্দুগুলোকে সুস্পন্দ বিন্দু (Antinode) বলে।

নিস্পন্দ ও সুস্পন্দ বিন্দুগুলোর অবস্থানগুলো সব সময় স্থির। পরপর দুটো সুস্পন্দ বিন্দু বা দুটো নিস্পন্দ বিন্দুর মধ্যবর্তী দূরত্ব তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের অর্ধেক হয়। গীটার, একতারা, সেতার ইত্যাদি বাদ্য যন্ত্রের তারে স্থির তরঙ্গ উৎপন্ন হয়।

পূর্ণ তরঙ্গ কাকে বলে:

তরঙ্গ সৃষ্টিকারী কণা কোন বিন্দু থেকে যাত্রা শুরু করে একই দিক থেকে পুনরায় ঐ বিন্দুতে ফিরে এলে তাকে একটি পূর্ণ স্পন্দন (Complete Vibration) বলে।

নীচের চিত্রে একটি বস্তুকণা A ও B বিন্দুর মধ্যে নির্দিষ্ট সময় পর পর ওঠা নামা করছে। O বিন্দু বজ্রকণাটির সাম্যাবস্থান। ধরা যাক A বিন্দু থেকে কণাটি ঊর্ধ্বমুখী, O বিন্দু হয়ে B পর্যন্ত উঠে নিম্নমুখী হল, কণাটি O বিন্দুর মধ্য দিয়ে A বিন্দু পর্যন্ত নেমে গেল। এভাবে A বিন্দু থেকে O হয়ে পুনরায় A বিন্দুতে ফিরে আসা হল একটি পূর্ণ স্পন্দন।
পূর্ণ তরঙ্গ কাকে বলে

তরঙ্গ বিস্তার কাকে বলে:

তরঙ্গ সঞ্চারকারী কোনো কণা সাম্য অবস্থান থেকে যেকোনো একদিকে সর্বাধিক যে দূরত্ব অতিক্রম করে তাকে তরঙ্গের বিস্তার (Amplitude) বলে।

উপরের চিত্রে কণাটি সাম্যাবস্থান O থেকে সর্বোচ্চ বিন্দু B পর্যন্ত উপরে উঠছে অথবা সাম্যাবস্থান O" থেকে সর্বনিম্ন বিন্দু D পর্যন্ত O"D দূরত্ব অতিক্রম করছে। এই তরঙ্গের বিস্তার OB বা O'C বা O"D

তরঙ্গের পর্যায়কাল কাকে বলে:

তরঙ্গ সঞ্চারণকারী কোনো কণার একটি পূর্ণ স্পন্দন সম্পন্ন করতে যে সময় লাগে তাকে ঐ তরঙ্গের পর্যায় কাল (Time period) বলে।

পর্যায়কালকে T দ্বারা প্রকাশ করা হয়। পর্যায়কালের একক সেকেন্ড (s) ।

তরঙ্গের কম্পাঙ্ক কাকে বলে:

তরঙ্গ সঞ্চারণকারী কোনো কণা এক সেকেন্ডে যতগুলো পূর্ণ স্পন্দন সম্পন্ন করে তাকে ঐ কণার বা তরঙ্গের কম্পাঙ্ক (Frequency) বলে। কম্পাঙ্ককে সাধারণত f দ্বারা প্রকাশ করা হয়।

কোনো বস্তু বা কণা t সময়ে N সংখ্যক কম্পন বা স্পন্দন করলে তার কম্পাঙ্ক, f = N/t। কম্পাঙ্কের একক হার্জ। সংক্ষেপে লেখা হয়, Hz।

দশা কাকে বলে:

তরঙ্গ সঞ্চারকারী কোনো কণার যে কোনো মুহূর্তের গতির সম্যক অবস্থাকে তার দশা (Phase) বলে।

কোনো একটি মুহূর্তের গতির অবস্থা বলতে ঐ বিশেষ মুহূর্তে কণাটির সরণ, বেগ, ত্বরণ ইত্যাদি বুঝায়।

নীচের চিত্রে p ও q বিন্দুতে দুটি কণার সাম্য অবস্থান থেকে সরণ, বেগ, ত্বরণ সমান। এদের গতির বা সরণের দিকও একই। অর্থাৎ কণা দুটি সমদশায় অবস্থিত বা সমদশা সম্পন্ন।

অনুরূপভাবে চিত্রে R ও S বিন্দুর কণা দুটি সমদশা সম্পন্ন। চিত্রে আপনি এরূপ আরও অনেক সমদশা সম্পন্ন বিন্দু চিহ্নিত করতে পারেন।
দশা কাকে বলে

তরঙ্গ শীর্ষ ও তরঙ্গ পাদ কাকে বলে:

তরঙ্গের সাম্যাবস্থান থেকে সর্বোচ্চ (ধনাত্মক) বিস্তারের বিন্দুটিকে তরঙ্গ শীর্ষ (crest) এবং সর্বনিম্ন (ঋণাত্মক) বিস্তারের বিন্দুটিকে তরঙ্গ পাদ (trough) বলা হয়।

উপরের চিত্রে B, C তরঙ্গ শীর্ষ এবং D. E তরঙ্গ পাদ। অসংখ্য তরঙ্গ পাদ এবং তরঙ্গ শীর্ষ নিয়ে তরঙ্গ সৃষ্টি হয়।

তরঙ্গ দৈর্ঘ্য কাকে বলে:

একটি পূর্ণ স্পন্দন সম্পন্ন হতে যে সময় লাগে, সেই সময়ে তরঙ্গ যে দূরত্ব অতিক্রম করে তাকে তরঙ্গ দৈর্ঘ্য (Wave length) বলে।

তরঙ্গের উপর পরপর দুটি সমদশা সম্পন্ন কণার মধ্যবর্তী দূরত্বই ভরঙ্গ দৈর্ঘ্য । উপরের চিত্রে B ও C বিন্দুর মধ্যের দূরত্ব BC, D E এর মধ্যের দূরত্ব DE তরঙ্গ দৈর্ঘ্য। একে গ্রীক বর্ণ À (ল্যামডা) দ্বারা প্রকাশ করা হয়।

আপনি সুবিধামতো দুটি সমদৃশ্য সম্পন্ন বিন্দু নিয়ে তাদের মধ্যের দূরত্ব চিহ্নিত করে তরঙ্গ দৈর্ঘ্য নির্দেশ করতে পারেন। পর পর দুটি তরঙ্গ শীর্ষ বা পরপর দুটি তরঙ্গ পাদের মধ্যবর্তী দূরত্বও একটি তরঙ্গ দৈর্ঘ্য ।

তরঙ্গ মুখ কাকে বলে:

কোনো তরঙ্গের উপর অবস্থিত সমদশা সম্পন্ন কণাগুলোর গতি পথকে তরঙ্গ মুখ (Wave front) বলে।

তরঙ্গ বেগ কাকে বলে:

তরঙ্গ নির্দিষ্ট দিকে একক সময়ে যে দূরত্ব অতিক্রম করে তাকে ঐ তরঙ্গের বো বা সংক্ষেপে তরঙ্গ বেগ (Wave velocity) বলে।

কৌণিক কম্পাঙ্ক কাকে বলে:

সময়ের সাথে তরঙ্গের উপর অবস্থিত কোনো কণার দশার পরিবর্তনের হারকে কৌণিক কম্পাঙ্ক (Angular velocity) বলে।

তীব্রতা কাকে বলে:

তরঙ্গ গতির মাধ্যমে শক্তি এক স্থান থেকে অন্য স্থানে সঞ্চারিত হয়। তরঙ্গ সঞ্চালনের পথে লম্বভাবে অবস্থিত একক ক্ষেত্রফলের মধ্য দিয়ে প্রতি সেকেন্ডে যে পরিমাণ শক্তি প্রবাহিত হয় তাকে ঐ তরঙ্গের তীব্রতা (Intencity) বলে । একে I দ্বারা সূচিত করা হয়।

তরঙ্গ প্রশ্নত্তর এককথায়:

1. তরঙ্গের সংজ্ঞা কী?
উত্তর: জড় মাধ্যমে সৃষ্ট পর্যাবৃত্ত আন্দোলন।

2. তরঙ্গের মূল উৎস কী?
উত্তর: কণার স্পন্দন।

3. অনুদৈর্ঘ্য ও অনুপ্রস্থ তরঙ্গের পার্থক্য কী?
উত্তর: কণার স্পন্দনের দিক।

4. তরঙ্গের বৈশিষ্ট্য কী কী?
উত্তর: পর্যাবৃত্ত, শক্তি সঞ্চার, দিক নির্ভরশীল।

5. তরঙ্গের গতি কীরূপে সংজ্ঞায়িত হয়?
উত্তর: প্রক্ষেপণ বেগ।

6. ধ্বনির উৎস কী?
উত্তর: কম্পনশীল বস্তুর স্পন্দন।

7. ধ্বনির গতি কত?
উত্তর: প্রায় ৩৩০ মি/সেকেন্ড।

8. ধ্বনির মাধ্যম কী কী?
উত্তর: জল, বায়ু, জমির মধ্যে প্রচারিত হয়।

9. ধ্বনির উৎপাদন কিভাবে ঘটে?
উত্তর: কম্পনশীল বস্তুর স্পন্দন সৃষ্ট হাওয়ার কম্পনে।

10. ধ্বনির বৈশিষ্ট্য কী কী?
উত্তর: পর্যাবৃত্ত, অনুদৈর্ঘ্য, প্রক্ষেপণ বেগ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ