বাচ্য কাকে বলে? কত প্রকার ও কি কি? | ভাববাচ্য ও কর্তৃবাচ্য কাকে বলে

বাচ্য কাকে বলে :-

মানুষ বাক্যের সাহায্যে মনের বিভিন্ন ভাব প্রকাশ করে। প্রত্যেক মানুষের কথা বলার ভঙ্গি স্বতন্ত্র। তাই বাক্যে কথা বলার ভঙ্গি বা প্রকৃতিও বিভিন্ন প্রকারের হয়। বাক্যে কথা বলার যে বিশিষ্ট ভঙ্গি, তাকেই বাচ্য বলে।

কথা বলার বিভিন্ন ভঙ্গি অনুসারে বাক্যে ক্রিয়াপদের রূপভেদ ঘটে। বাক্যে ক্রিয়ার সমৃদ্ধ কর্তার সঙ্গে না কর্মের সঙ্গে অথবা কর্তা তথবা কর্ম কারও সঙ্গে না হয়ে কেবল ক্রিয়ার কাজটিকেই প্রকাশ করছে—এরকম ক্রিয়ার রূপভেদকে বাচ্য বলে।

মনে রাখা দরকার, একই বক্তব্যকে বাচ্যভেদে বিভিন্ন রূপে প্রকাশ করা যায়—সেজন্য অর্থের কোনো তারতম্য ঘটে না। কিন্তু বাক্যের গঠনগত কাঠামোর তারতম্য ঘটে। যেমন-

বাচ্যের উদাহরণ :-

আমি বাবাকে চিঠি লিখেছি।
আমা কর্তৃক বাবাকে চিঠি লেখা হয়েছে।

মহাশয়ের থাকা হয় কোথায়?
মহাশয় কোথায় থাকেন?

আরও পড়ুন  :- স্বরসংগতি কি ও কয়টি?

আমার বই পড়া হয়েছে।
আমি বই পড়েছি।

তুমি কবে ফিরছ?
তোমার কবে ফেরা হচ্ছে?

পুলিশ চোর ধরেছে।
পুলিশের হাতে চোর ধরা পড়েছে।

বাচ্যের শ্রেণিবিভাগ বা প্রকারভেদ :-

বাচ্যকে সাধারণভাবে চার শ্রেণিতে ভাগ করা যায় : যথা-

১) কর্তৃবাচ্য;

২) কর্মবাচ্য;

৩) ভাববাচ্য এবং

৪) কর্ম-কর্তৃবাচ্য।
বাচ্য কাকে বলে

বিভিন্ন প্রকার বাচ্যের সংজ্ঞা :-

১. কৰ্তৃবাচ্য কাকে বলে :-

যে বাক্যে কর্তাই ক্রিয়ার কার্য সম্পন্ন করে, ক্রিয়াপদটি সরাসরি কর্তার সঙ্গে অন্বিত থাকে এবং ক্রিয়াপদটি কর্তারই অনুগামী হয়, তাকে কর্তৃবাচ্য বলে।

এখানে মনে রাখা দরকার, কর্তৃবাচ্যের কর্তা মানুষ ও অন্যান্য জীবজন্তু অর্থাৎ প্রাণীবাচক হতে পারে, আবার উদ্ভিদবাচক ও অপ্রাণীবাচক ক্ষেত্রবিশেষে হতে পারে। বিশেষভাবে মনে রাখা দরকার, কর্তৃবাচ্যে কর্তাই বাচ্য অর্থাৎ বক্তব্যকে ধারণ করে।

কর্তৃবাচ্যে কর্তাকে অনুসরণ করে ক্রিয়ার রূপ উত্তম, মধ্যম অথবা প্রথম পুরুষের হয়।

যেমন :
  • মহিম গান জানে।
  • সুধীরবাবু কলকাতা গেছেন।
  • জীবন পড়াশুনা করে না।
  • সূর্যের চারদিকে পৃথিবী ঘুরছে।
  • বুলবুলিতে ধান খেয়েছে।
  • হরিণটি বাঘের ভয়ে জঙ্গলে আশ্রয় নিয়েছে।

কর্তৃবাচ্যের বৈশিষ্ট্য :-

১) কর্তৃবাচ্যে কর্তার প্রাধান্য থাকে।

২) কর্তৃবাচ্যে ক্রিয়া কর্তার অনুগামী হয়। কর্তার যে পুরুষ তদনুযায়ী ক্রিয়ারও পুরুষবাচক বিভক্তি হয়ে থাকে।

৩) কর্তৃবাচ্যে সাধারণত শূন্য বিভক্তি হয়। অবশ্য কর্তৃবাচ্যে ‘এ’, ‘তে’, ‘য়’ বিভক্তি হতেও দেখা যায়।

আরও পড়ুন :- অনুবাদ কি?

২. কর্মবাচ্য কাকে বলে :-

যে বাক্যে কর্মই মুখ্য রূপে প্রতীয়মান হয়, তাকে কর্মবাচ্য বলে।

কর্মবাচ্যে কৰ্মই বাক্যকে প্রকাশ করে। সেখানে কর্তা অপেক্ষা কর্মের সঙ্গে ক্রিয়ার ঘটনার প্রধান যোগ কল্পনা করা হয়। কর্মবাচ্যে ক্রিয়াপদটি প্রায়শই সংযোগমূলক ক্রিয়ায় রূপান্তরিত হয়।

যেমন :
  • রবীন্দ্রনাথ কর্তৃক গীতাঞ্জলি রচিত হয়।
  • আমার দ্বারা এ কাজটি হয়েছে।
  • রমার বইটি পড়া হয়ে গেছে।
  • শিক্ষক কর্তৃক ছাত্রদিগকে পড়াটি বুঝিয়ে দেওয়া হল।
  • এই বালকের হস্তে রাজচক্রবর্তী-লক্ষণ লক্ষিত হচ্ছে।

কর্মবাচ্যের বৈশিষ্ট্য : -

১) কর্মবাচ্যে কর্তৃবাচ্যের কর্মপদটি কর্তার মর্যাদা পায়। তখন সমাপিকা ক্রিয়াটি তার অনুগত হয়।

যেমন :

পিতা পুত্রকে একটি পুস্তক দিলেন (কর্তৃবাচ্য) > পিতা কর্তৃক পুত্রকে একটি পুস্তক দেওয়া হল (কর্মবাচ্য, মুখ্য কর্ম কর্তা হয়েছে) বা পিতা কর্তৃক পুত্র একটি পুস্তক প্রাপ্ত হল (কর্মবাচ্য গৌণ কর্ম কর্তা হয়েছে)।

২) কর্ম যখন কর্তা হয়, তখন বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শূন্য-বিভক্তি হয়, অন্য কোনো বিভক্তি থাকলে, তা লোপ পায়।

যেমন :
  • আমি চিঠি পেয়েছি > আমার চিঠি পাওয়া হয়েছে।
  • সে অর্থকে তুচ্ছ জ্ঞান করে > তার কাছে অর্থ তুচ্ছ।
  • শিক্ষক রমাকে আদেশ দিয়েছেন > রমা শিক্ষকের আদেশ পেয়েছে।
মনে রাখা দরকার, অনুজ্ঞাবাচক বাক্যে এর ব্যতিক্রম ঘটে :
  • বেলাকে বলো > বেলাকে বলা হোক।
  • চোরটাকে শাস্তি দাও > চোরের শাস্তি হোক।

৩) কর্তৃবাচ্যের কর্তা কর্মবাচ্যে এসে কিছুটা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। তখন তার নাম হয় অনুক্ত কর্তা। কর্তৃবাচ্যের কর্তা যখন কর্মবাচ্যে আসে, তখন তার বিভক্তি হয়—দ্বারা/ দিয়া/দিয়ে, কর্তৃক, র, এর, কে।

যেমন :
  • সে এ কাজ পারবে না > তার দ্বারা এ কাজ হবে না।
  • রবীন্দ্রনাথ ‘ভারততীর্থ’ কবিতা লেখেন > ভারততীর্থ কবিতাটি রবীন্দ্রনাথের লেখা।

৪) কর্তৃবাচ্যের ক্রিয়াপদটি সাধারণত মৌলিক অথবা যৌগিক ক্রিয়া হয়, কর্মবাচ্যে তা সংযোগমূলক ক্রিয়ায় পরিণত হয়। অর্থাৎ, মূল ক্রিয়াপদটি বিশেষ্য বা বিশেষণে পরিণত হয় এবং তার সঙ্গে হ-ধাতু যুক্ত থাকে।

যেমন :
  • রাম রাবণকে নিহত করেন > রাম কর্তৃক রাবণ নিহত হন।
  • যা জানবার তা জানলাম > যা জানবার তা জানা হল।
  • কখনো কখনো যৌগিক ক্রিয়া হয়। যেমন :
  • মাতাপিতাকে ভক্তি করবে > মাতাপিতাকে ভক্তি করা উচিত।

কখনো কখনো ক্রিয়া সম্পূর্ণ বদলে যায়। যেমন :
  • আমি চিঠি পেয়েছি > আমার চিঠি পাওয়া হয়েছে।
  • তারা সভা করছেন > তাদের সভা চলছে।
  • আমায় টাকা দাও > আমার টাকা চাই।

৩. ভাববাচ্য কাকে বলে :-

যে বাক্যে ক্রিয়াই বাক্যের মধ্যে প্রধান বক্তব্য বলে প্রতীত হয় ও বক্তার নিকট ক্রিয়ার ঘটনাই প্রধান, কর্তা বা কর্ম প্রধান নয়-সেখানে ভাববাচ্য হয়।

ভাববাচ্যে ক্রিয়াপদের প্রাধান্য। মূল ক্রিয়া ভাববাচ্যে ভাববাচক বা ক্রিয়াবাচক বিশেষ্য পদে পরিণত হয়ে আর একটি ক্রিয়া গ্রহণ করে।

যেমন :

ছেলেটি খেলছে > ছেলেটির খেলা হচ্ছে। মুল ক্রিয়াপদ ‘খেলছে'। কিন্তু ভাববাচ্যে খেলা ভাববাচক বিশেষ্য, নূতন ক্রিয়া ‘হচ্ছে’ তার সঙ্গে যোগ হয়েছে। এরকম :
  • কখন খাবে > খাওয়া হবে কখন?
  • থাক কোথায় > থাকা হয় কোথায়?
  • মা রেগে গেছেন > মায়ের রাগ হয়েছে।
  • মন্ত্রীমশাই সরে পড়লেন > মন্ত্রীমশাইকে সরে পড়তে হল। 
  • আজ তুমি কলেজ যাবে > আজ তোমাকে কলেজ যেতে হবে।

ভাববাচ্যের বৈশিষ্ট্য :-

১) ভাববাচ্যে ক্রিয়ার অর্থই প্রধান হয়।

২) ভাববাচ্যের উদ্দেশ্য পদটি বিধেয় ক্রিয়াজাত কৃদন্ত পদ হয়ে থাকে।

৩) ভাববাচ্যে কর্তায় সম্বন্ধ বিভক্তি যোগ হয়।

৪) ভাববাচ্যের মধ্যে ক্রিয়া অকর্মক হয় এবং তা সবসময় প্রথম পুরুষের অন্তর্ভুক্ত হয়।

৫) ভাববাচ্যের ক্রিয়া সর্বদা ‘হ’ ধাতু বা ‘যা' ধাতু নিষ্পন্ন।

৪. কর্ম-কর্তৃবাচ্য কাকে বলে :-

কতকগুলি বাক্যে ক্রিয়ার কর্তা কে তা বোঝা যায় না। কর্মই যেন নিজের উপরে ক্রিয়া করে—তখন কর্ম-কর্তৃবাচ্য হয়।

কর্ম-কর্তৃবাচ্যে ক্রিয়াপদটি অনেক সময় কোনো অপ্রাণীবাচক কর্তৃপদের সঙ্গে সরাসরি অন্বিত হয়, যদিও সেই কর্তৃপদের উক্ত ক্রিয়া সম্পাদনের ক্ষমতা নেই।

আরও পড়ুন :- কারক কাকে বলে? 

যেমন :

কাপড় ছিঁড়ছে; খুড়ি উড়ছে; কলসী ভরে; ফল পাকে; বাঁশ ভাঙে; শাঁখ বাজে; শীত করে প্রভৃতি।

বিশেষভাবে মনে রাখা দরকার যে, কর্ম-কর্তৃবাচ্যে প্রাণীবাচক কিছু হবে না। যেমন-

ঘুড়ি উড়ছে—কর্ম-কর্তৃবাচ্য। কারণ ঘুড়ি নিজে উড়ে না। কেউ-না-কেউ তাকে উড়াচ্ছে।

কিন্তু পাখি উড়ছে—কর্ম-কর্তৃবাচ্য নয়। পাখিকে কেউ উড়াচ্ছে না। সে নিজেই উড়ছে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ