বায়ু দূষণ কাকে বলে? বায়ু দূষণের কারণ? বায়ু দূষণের প্রভাব ও প্রতিকার?

প্রাকৃতিক পরিবেশের উপাদানগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো বায়ু বা বাতাস। প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট কারণে বাতাস তার স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য থেকে পরিবর্তিত হচ্ছে। অথচ জীবনধারণের জন্য বায়ু অত্যাবশ্যক। বায়ু না থাকলে পৃথিবী শূন্যতায় পর্যবসিত হতো। অন্যান্য দূষণের চেয়ে বায়ু দূষণের পরিধি এবং ব্যাপকতা সবচেয়ে বেশি। কারণ বাতাস স্বল্প সময়ে দূষিত পদার্থকে চতুর্দিকে ছড়িয়ে দিতে পারে।

বায়ু দূষণ কাকে বলে :-

বায়ুর উপাদানসমুহের পরিবর্তন যখন উদ্ভিদ ও জীবকূলের ক্ষতির কারণ হয় তখন তাকে বায়ু দূষণ বলে।

World Health Organization (WHO) বা বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মতে, “পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের মধ্যে অনিষ্টকর পদার্থের সমাবেশ যখন মানুষ ও তার পরিবেশের ক্ষতি করে সেই অবস্থাকে বায়ু দূষণ বলে”।

বায়ুর দূষকসমূহ (Pollutants of Air) :-

বায়ুর দূষক হিসেবে কতিপয় গ্যাস ও পদার্থ শনাক্ত করা হয়েছে। নিম্নের ছকে। বায়ুর প্রধান দৃষকসমূহ দেখানো হলো।
বায়ুর দূষকসমূহ

বায়ু দূষণের কারণ :-

বায়ু দূষণের কারণসমূহকে দুইটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যথা-

ক. মানব সৃষ্ট কারণ এবং

খ. প্রাকৃতিক কারণ।

ক. মানব সৃষ্ট কারণ :-

১. জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানো :

ভূ-অভ্যন্তর হতে উত্তোলিত জ্বালানি যেমন-ডিজেল, পেট্রোল, কেরোসিন তেল ইত্যাদি পোড়ানোর কারণে ছোট-বড় বিভিন্ন ধরনের কণা বাতাসে মিশে বায়ু দূষণ ঘটায়।

যানবাহন থেকে নির্গত কালো ধোঁয়ায় থাকে কার্বন মনোক্সাইড, কার্বন ডাই-অক্সাইড, নাইট্রোজেনের অক্সাইডসমূহ প্রভৃতি গ্যাস যা মানুষের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।

আরও পড়ুন :- তাপবলয় কাকে বলে?

২. শিল্প-কারখানার নির্গত ধোঁয়া :

শিল্প-কারখানার নির্গত ধোঁয়ার বিভিন্ন প্রকার গ্যাস ও ধাতব কণা যেমন- কার্বন মনোক্সাইড, কার্বন ডাই-অক্সাইড, সালফার ডাই-অক্সাইড ইত্যাদি দুর্গন্ধময় বিষাক্ত পদার্থ যা বাতাসের সাথে মিশে বাতাসকে দূষিত করে।

৩. পরিত্যক্ত বর্জ্য :

পদার্থের দহন বিশেষ করে শহরাঞ্চলে পরিত্যক্ত বর্জ্য পদার্থসমূহ আবর্জনামুক্ত করার জন্য পোড়ানো হয়। এ থেকে নির্গত ধোঁয়াতেও কার্বন মনোক্সাইড, কার্বন ডাই-অক্সাইড, সালফার ডাই-অক্সাইড ইত্যাদি গ্যাস থাকে যা বাতাসকে দূষিত করে।

৪. বন উজার :

অপরিকল্পিতভাবে গাছপালা কর্তনের ফলে বাতাসে কার্বন ডাই-অক্সাইড এর মাত্রা বেড়ে গিয়ে বাতাসকে দূষিত করে। এতে প্রাণি ও উদ্ভিদের শ্বাসকার্যে ব্যবহৃত অক্সিজেন ও কার্বন ডাই-অক্সাইড এর ভারসাম্য বিনষ্ট হয়।


৫. তেজস্ক্রিয় পদার্থ :

যুদ্ধক্ষেত্র অথবা পারমানবিক চুল্লিতে দুর্ঘটনার ফলে তেজস্ক্রিয় পদার্থের বিকিরণ হলে বায়ু দূষিত হয়।

উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ১৯৪৫ সালে হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পারমানবিক বোমার বিস্ফোরণ।

৬. ইটভাটা :

ইটভাটায় কাঠ ও কয়লা পোড়ানোর ফলে প্রচুর ধোঁয়া নির্গত হয় যা বায়ুর সাথে মিশে দূষণ ঘটায় ।

৭. কৃষিক্ষেত্রে :

কৃষিক্ষেত্রে আগাছা, কীটনাশক, জৈব ফসফেট এবং ক্লোরিনযুক্ত হাইড্রোকার্বন বায়ু দূষণ ঘটায়।

বায়ু দূষণের উপরিউক্ত মানব সৃষ্ট কারণ ছাড়াও ভবন নির্মাণ, খোলা স্থানে আবর্জনা, ধূমপান, লোহা, টায়ার ইত্যাদির দহনে বায়ু দূষিত হয়।

খ. প্রাকৃতিক কারণ :-

১. আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত :

আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের ফলে নির্গত সালফার ডাই-অক্সাইড, কার্বন মনোঅক্সাইড, হাইড্রোজেন সালফাইড গ্যাস প্রভৃতি বায়ুর সাথে মিশে বায়ুকে দূষিত করে।

২. জৈব ও অজৈব পদার্থ :

বিভিন্ন প্রকার জৈব ও অজৈব পদার্থের স্বাভাবিক পচনের ফলে যে গ্যাস সৃষ্টি হয় তা বায়ুকে দূষিত করে।

৩. দাবানল ও ধূলিঝড় :

বিস্তৃত বনাঞ্চলে দাবানল হলে তা ব্যাপক এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে বায়ুকে দূষিত করে। এছাড়া মরু এলাকায় ধূলিঝড়ও বায়ু দূষণ ঘটায় ।

৪. গ্যাসক্ষেত্রের বিস্ফোরণ :

গ্যাসক্ষেত্র বিস্ফোরণ বা দুর্ঘটনাজনিত কারণে যে গ্যাস ছড়িয়ে পড়ে তা বায়ুকে দূষিত করে।

আরও পড়ুন :- জল দূষণ কাকে বলে?

বায়ু দূষণের প্রভাব :-

জগতের প্রতিটি প্রাণের অস্তিত্বের জন্য অত্যাবশ্যকীয় উপাদান বায়ু। বায়ু দূষণের ফলে জীবজগতের উপর যে প্রভাব পড়ে তা নিম্নে বর্ণনা করা হলো।

১. মানব স্বাস্থ্যের উপর প্রভাব :

বায়ু দূষণের ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয় মানব স্বাস্থ্য। দূষিত বায়ু গ্রহণের মাধ্যমে শুধুমাত্র শ্বাস-প্রশ্বাসই নয় এর মাধ্যমে জীবনও বিপন্ন হতে পারে।

বায়ু দূষণের ফলে শ্বাসনালীতে জ্বালা, কাশি ও দম বন্ধ হয়ে যেতে পারে। বিশেষ করে সালফারের অক্সাইডগুলো ফুসফুসে নানা ধরনের রোগ সৃষ্টির প্রধান কারণ।

নাইট্রোজেনের অক্সাইডগুলোর বিষাক্ত প্রতিক্রিয়ায় ফুসফুস ফুলে যায় এবং ফুসফুসে পানি জমে রোগীর মৃত্যুও হতে পারে। অতিমাত্রায় বায়ু দূষণ দীর্ঘস্থায়ী হাঁপানি, শ্বাসনালীর প্রদাহ ও কন্ঠস্বর ভঙ্গের কারণ হতে পারে।

২. পশুপাখির উপর প্রভাব :

দূষিত বায়ু পশুপাখির খাদ্যকে দূষিত করে। পশুপাখি এসব দুষিত খাবার গ্রহণ করলে বিভিন্ন জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হয় এবং অসুস্থ হয়ে পড়ে।

৩. উদ্ভিদের উপর প্রভাব :

দীর্ঘ সময় ধরে বায়ু দূষণ হলে উদ্ভিদের ক্ষতি করে। সালফার ডাই-অক্সাইড গাছের ক্লোরোফিলের ক্ষতি করে। ফলে খাদ্য উৎপাদন ক্ষমতা কমে গিয়ে উদ্ভিদের জীবনীশক্তি কমে যায়। বায়ুতে অতিমাত্রায় এ গ্যাস থাকলে পাতার কোষ মরে যায় এবং পাতা শুকিয়ে যায়।

৪. বাস্তুসংস্থানের উপর প্রভাব :


দূষিত বায়ু বাস্তুসংস্থানের উপরও প্রভাব ফেলে। বায়ু দূষণ স্থলজ এবং জলজ উভয় প্রকার বাস্তুসংস্থানকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।

বায়ু দূষণের আরেকটি উল্লেখযোগ্য প্রভাব হলো এসিড বৃষ্টি (Acid Rain)। এসিড বৃষ্টির ফলে প্রাণি, উদ্ভিদ এবং দালানকোঠার ক্ষতি হয়। এছাড়া বায়ু দূষণ গ্রিন হাউজ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টিরও একটি কারণ।

বায়ু দূষণ প্রতিরোধের উপায় :-

বায়ু আমাদের বেঁচে থাকার জন্য আবশ্যকীয় উপাদান তা একটু আগেই আলোচনা হলো। বায়ুর গুণগত মান বজায় থাকলে মানব স্বাস্থ্য ভালো থাকে, গাছের বর্ধন যথাযথভাবে হয়, কৃষি ফলন বৃদ্ধি পায়। তাই বায়ু দূষণ প্রতিরোধ করা জরুরি।

বায়ু দূষণ প্রতিরোধের প্রথম পদক্ষেপ হলো বায়ুমন্ডলে নির্গমনের পূর্বেই বায়ু দূষক উৎসের নির্গমন নিয়ন্ত্রণ করা। বায়ু দূষণ বিভিন্নভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োগ, জ্বালানি পরিশোধন, মোটরগাড়ি চালনায় জনসচেতনতা প্রভৃতি প্রয়োগ করা যেতে পারে। বায়ু দূষণ প্রতিরোধের উপায়সমূহ নিয়ে আলোচনা করা হলো।

১. যানবাহন থেকে ধোঁয়া নির্গমন নিয়ন্ত্রণ :

যানবাহন থেকে নির্গত বায়ু দূষকগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো কার্বন মনোঅক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড, সালফার ডাই-অক্সাইড, অদাহা হাইড্রোকার্বন। এগুলো নির্গমন নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

এক্ষেত্রে ডিজেল বা পেট্রোল চালিত যানের তুলনায় সিএনজি চালিত যানের দূষণমাত্রা অনেক কম।

২. কল-কারখানার ধোঁয়া নিয়ন্ত্রণ :

কল-কারখানার ধোঁয়া নির্গমন নল ও চিমনি থেকে নির্গত বস্তুকণা পৃথক করার জন্য ছাকনি বা অন্য কোনো প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে। এর ফলে দূষকগুলো বায়ুতে মিশে যাওয়ার পূর্বেই আলাদা হয়ে যাবে।

৩. দূষণ পদার্থ শোষণ :

বায়ু দূষণ প্রতিরোধের একটি আধুনিক পদ্ধতি দূষণ পদার্থের শোষণ। এই পদ্ধতিতে কৃষক পদার্থগুলো মুক্ত বায়ুতে ছড়িয়ে পড়ার পূর্বেই বিশেষ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দূষক পদার্থ আলাদা করে নেওয়া যায়।

৪. বিকল্প জ্বালানি প্রয়োগ :

বিকল্প জ্বালানি অর্থাৎ প্রচলিত জীবাশ্ম জ্বালানির পরিমাণ ক্রমান্বয়ে হ্রাস করে অপ্রচলিত শক্তি যেমন- সৌরশক্তি, বায়োগ্যাস ইত্যাদির ব্যবহার বৃদ্ধি করতে হবে। এর ফলে বায়ু দূষণ অনেক কমে যাবে।

৫. পরিত্যক্ত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা :

বিভিন্ন পরিত্যক্ত বর্জ্য যেগুলো কোনো কাজে লাগেনা সেগুলো না পুড়িয়ে মাটির নিচে পুঁতে ফেলা যেতে পারে।

৬. কীটনাশকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ :

যথেচ্ছ মাত্রায় কীটনাশক ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। পরিমিত পরিমাণে কীটনাশকের পাশাপাশি বিকল্প উপায়ে রোগ-ব্যাধি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

৭. পচনযোগ্য দ্রব্য দ্রুত অপসারণ :

হাটবাজার, দোকানপাট, বসতবাড়ি প্রভৃতি থেকে পচা বা পচনশীল দ্রব্য দ্রুত অপসারণ করতে হবে। এছাড়া শহরের ডাস্টবিনের ময়লা দীর্ঘ সময় ধরে না রেখে যতদূর সম্ভব তা দ্রুত শোধনাগারে পাঠাতে হবে অথবা মাটিতে পুতে ফেলে বাতাস দূষণ রোধ করতে হবে।

৮. অঞ্চল ভাগ :

বড় বড় শহরের আবাসিক, শিল্প, বাণিজ্যিক, অফিস-আদালত প্রভৃতি পরিকল্পিতভাবে স্থাপন করতে হবে। এতে শিল্প-কারখানার দূষিত বাতাস মানব জীবন ও অন্যান্য প্রাণির ক্ষতি করতে পারবে না।

৯. বৃক্ষরোপন :

উদ্ভিদ প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা করে। উদ্ভিদ জীবজগতের জন্য অক্সিজেন ত্যাগ করে এবং জীবজগতের ত্যাগকৃত কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে ভারসাম্য বজায় রাখে। তাই প্রচুর পরিমাণে বৃক্ষরোপন করতে হবে এবং অন্যদেরও উৎসাহিত করতে হবে।

১০. সচেতনতা বৃদ্ধি :

বায়ু দূষণের কুফল সম্পর্কে জনগণকে সচেতন হতে হবে। এক্ষেত্রে জনসচেতনামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ