জল দূষণ কাকে বলে? জল দূষণের কারণ ও ফলাফল? জল দূষণ নিয়ন্ত্রণের উপায় ও প্রতিকার?

জল দূষণ কাকে বলে :-

জল দূষণ বলতে জলের সঙ্গে কোনো অবাঞ্চিত পদার্থ মিশে যাওয়ার ফলে যদি জলের ভৌত রাসায়নিক ও জৈব বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তন হয় এবং জলজ উদ্ভিদ, প্রাণি, মানুষ তথা জীবজগতের ক্ষতির আশঙ্কাকে বুঝায়।

আমরা জানি জলের অপর নাম জীবন। বিশ্বের মোট জলের ৯৭% সাগর এবং মহাসাগরে অবস্থিত যা মানুষের ব্যবহারের উপযোগী নয়। অবশিষ্ট মাত্র ৩% স্বাদু জল যা নদী, হ্রদ, পুকুর, ভূ-অভ্যন্তর উদ্ভিদ প্রভৃতিতে রয়েছে।

অর্থাৎ বিশুদ্ধ জলের পরিমাণ সীমিত এবং বিশুদ্ধ জলের উৎসগুলো মানবীয় বিভিন্ন কর্মকান্ড ও অতিমাত্রায় ব্যবহারের ফলে দূষিত হচ্ছে।

জল দূষণের প্রকারভেদ :-

জল দূষণকে পাঁচ ভাগে ভাগ করা যায়। যথা

১. ভূ-গর্ভস্থ জল দূষণ,

২.হ্রদের জল দূষণ,

৩. সামুদ্রিক জল দূষণ,

৪. নদীর জল দূষণ এবং

৫. জলাশয়ের জল দূষণ ।
জল দূষণ কাকে বলে

জল দূষণের কারণ :-

প্রতিনিয়ত নানা কারণে জল দুষিত হচ্ছে। বায়ু দূষণের ন্যায় জল দূষণেরও প্রধান কারণ মানুষের বহুমুখী কর্মকান্ড। জল দূষণের প্রধান কারণগুলো নিয়ে তুলে ধরা হলো

১. জলাধারের সাথে নর্দমার সংযোগ :

বিভিন্ন জলাধার যেমন- নদী, পুকুর, খাল, বিল প্রভৃতির সাথে ময়লা জলবাহিত নর্দমার সংযোগ থাকলে জল দূষিত হয়।

২. কল-কারখানার বর্জ্য :

কল-কারখানা থেকে নির্গত বিভিন্ন প্রকার গ্যাসীয় পদার্থ, ক্ষারীয় পদার্থ, তেলজাতীয় পদার্থ প্রভৃতি জলাধারে পতিত হলে জল দূষিত হয়।

আরও পড়ুন :- জল চক্র কাকে বলে?

৩. গৃহস্থালি বর্জ্য :

সংমিশ্রণ গৃহস্থালির আবর্জনা থেকে নির্গত বিভিন্ন ধরনের পদার্থ যেমন- ভাসমান কঠিন কণা, সালফেট, ক্লোরাইড, অ্যামোনিয়া প্রভৃতি জলকে দূষিত করে।

গৃহস্থালি বর্জ্যের মধ্যে রয়েছে রান্নার ধৌত কাজে ব্যবহৃত জল, উচ্ছিষ্ট খাবার, ডিটারজেন্ট, মলমূত্র ইত্যাদি।

৪. কৃষিজাত দূষক :

কৃষিতে ব্যবহৃত অতিরিক্ত সার, কীটনাশক, আগাছানাশক প্রভৃতি থেকে উৎপন্ন বিভিন্ন রাসায়নিক গ্যাস জলকে দূষিত করে। এছাড়া শস্যক্ষেতের পরিত্যক্ত গাছপালার অবশিষ্টাংশ, পাতা প্রভৃতি জলের সংস্পর্শে পচে জলকে দূষিত করে।

৫. ক্ষতিকারক খনিজ পদার্থ :

জলেতেে আর্সেনিক, সীসা, ক্রোমিয়াম, ক্যাডমিয়াম প্রভৃতি মিশে জল দূষিত করে।

৬. পাইপ লাইন লিকেজ :

নর্দমা ও স্যুয়ারেজ লাইনের পাশ দিয়ে জলের পাইপ গেলে দুর্ঘটনাজনিত কারণে জল দূষিত হতে পারে। কারণ নর্দমা বা স্যুয়ারেজের লাইন কোনোভাবে লিকেজ হয়ে জলের লাইনে সংযুক্ত হয়ে গেলে জল দূষিত হয়।

৭. তেলবাহিত দূষণ :

তেলবাহী জাহাজ দুর্ঘটনা কবলিত হলে তেল জলেতেে ছড়িয়ে পড়ে জল দূষিত করতে পারে।

৮. তেজস্ক্রিয় বর্জ্য :

পারমানবিক চুল্লী, তেজস্ক্রিয় পদার্থের প্রক্রিয়াকেন্দ্র বা চিকিৎসা কেন্দ্রে ব্যবহৃত তেজস্ক্রিয় পদার্থের বর্জ্যসমূহ জলেতেে মিশ্রিত হলে জল দূষিত হয়। এছাড়া রাসায়নিক ও বিস্ফোরক দ্রব্য ব্যবহারের ফলেও জল দূষিত হয়।

৯. মৃত জীবজন্ত :

জলেতেে মৃত জীবজন্তু ভাসিয়ে দিলে জল দূষিত হয়। এছাড়া বন্যার সময় অনেক জীবজন্তু মরে গিয়ে জলেতেে ভেসে যায় যা জল দূষণ ঘটায়।

১০. চিকিৎসা বর্জ্য :

জল দূষণের অন্যতম আরেকটি কারণ চিকিৎসা বর্জ্য। হাসপাতালেই চিকিৎসা বর্জ্য পরিশোধন না করে সরাসরি জলেতেে ফেললে জল দুষিত হয়। ফলে বিভিন্ন রোগের জীবাণু জলেতেে ছড়িয়ে পড়ে জল দূষিত করে।

আরও পড়ুন :- বায়ুমণ্ডল কাকে বলে?

জল দূষণের ফলাফল ও প্রভাবসমূহ :-

নীচে জল দূষণের ক্ষতিকর প্রভাবসমূহ সংক্ষেপে দেওয়া হলো

• জল দূষণের কারণে সর্বপেক্ষা এবং সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত হয় মানুষ। বিভিন্ন ধরনের জলবাহিত রোগ যেমন- জন্ডিস, টাইফয়েড, কলেরা, ডায়রিয়া, হেপাটাইটিস, আর্সেনিকোসিস এবং চর্মরোগের শিকার হয় মানুষ।

• জল দূষণের বিরাট প্রভাব রয়েছে জলাশয়ের প্রতিবেশীর। জল দূষণের কারণে সমুদ্র, নদী, হাওড়, বাওড়, বিল প্রভৃতি জলাশয়ের মৎস সম্পদ ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং জলাশয়ের প্রতিবেশ বিনষ্ট হয়।

• জল দূষণ কৃষিক্ষেত্রকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে। জল দূষণের কারণে মৃত্তিকার উর্বরতা হ্রাস পায়, উপকারী ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস হয় এবং অনেক ক্ষেত্রে মৃত্তিকায় ক্ষয়ের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। ফলশ্রুতিতে উৎপাদন ব্যহত হয়।

• জল দূষণ জীবজগতের পরিবেশ-প্রতিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। এ কারণে জল ব্যবস্থাপনার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে।

জল দূষণ নিয়ন্ত্রণের উপায় ও প্রতিকার :-

জল দূষণ জীবজগতের জন্য মারাত্মক হুমকির কারণ। তাই জল যেন দূষিত না হয় সেদিকে সচেতন থাকতে হবে এবং দূষিত জলকে নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। নিম্নে জল দূষণ নিয়ন্ত্রণের উপায়গুলো তুলে ধরা হলো।

১. নদী, খাল, বিল, পুকুর, হ্রদসহ বিভিন্ন জলাশয়ের জলেতেে সরাসরি আবর্জনা না ফেলা।

২. শিল্প-কারখানার জল শোধন করে জলাশয়ে স্থানান্তর করা।

৩. পয়:নিষ্কাশনের নালা জলাশয়ে সরাসরি সংযুক্ত না করে পরিশোধন করা।

8. কৃষিক্ষেত্রে পরিমিত মাত্রায় সার এবং কীটনাশক ব্যবহার করা।

৫. জীবজন্তুর মৃতদেহ জলেতেে না ফেলা।

৬. রোগাক্রান্ত ব্যক্তির কাপড়-চোপড় জীবাণুনাশক ব্যবহার করে ধৌত করা।

৭. তেলবাহী জাহাজ যাতে দুর্ঘটনা কবলিত না হয় সেদিকে সতর্ক থাকা।

৮. কল-কারখানা স্থাপনের পূর্বে বর্জ্য পরিশোধন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। পারমানবিক বর্জ্য সরাসরি জলেতেে না ফেলা।

উপরিউক্ত পদক্ষেপগুলো ছাড়াও জনগণকে সচেতন করা, আইনের যথাযথ প্রয়োগ এবং পাঠ্যপুস্তকে জল দূষণ সম্পর্কে সচেতনতামূলক পাঠ্যসূচি অর্ন্তভুক্ত করে দূষণ নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ