পৌষ্টিকতন্ত্র কাকে বলে? পৌষ্টিকতন্ত্রের বিভিন্ন অংশ?

পৌষ্টিকতন্ত্র কাকে বলে :- 

মানবদেহে পরিপাক ও পরিশোষণ (Absorption) মূলত পৌষ্টিকতন্ত্রের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। এটি একটি স্বতন্ত্র তন্ত্র। অতএব যে তন্ত্রের সাহায্যে খাদ্য দ্রব্য ভেঙ্গে দেহের গ্রহণ উপযোগী উপাদানে পরিণত হয় তাকে পৌষ্টিকতন্ত্র (Digestive system) বলে।

এ তন্ত্রটি পৌষ্টিকনালি ও কয়েকটি গ্রন্থির সমন্বয়ে, মুখ থেকে শুরু করে পায়ুতে শেষ হয়। পরিপাকনালি মুখছিদ্র থেকে পায়ু পর্যন্তবিস্তৃত, দীর্ঘ নালিবিশেষ যা কোথাও থলির ন্যায় স্ফীত কোথাও কুণ্ডলীকৃত। এর প্রধান অংশগুলো হলো- মুখছিদ্র, মুখগহবর, গলবিল, অন্ননালি, পাকস্থলী, অস্ত্র (ক্ষুদ্রান্ত্র ও বৃহদন্ত) এবং পায়ু।

দেহে সাধারণত দুটি প্রক্রিয়ায় খাদ্য শোষিত হয়। যথা-

আরও পড়ুন :- পরাগায়ন কি?

(ক) যান্ত্রিক প্রক্রিয়া : মুখগহবরে খাদ্যদ্রব্য চিবানোর ফলে খাদ্যবস্তুগুলো ছোট আকারে পরিণত হয়ে পাকস্থলি ও অন্ত্রে খাদ্য দ্রব্যগুলো মন্ডে পরিণত হয়।

(খ) রাসায়নিক প্রক্রিয়া : এটি পরিপাকের দ্বিতীয় ধাপ। এক্ষেত্রে এনজাইম খাদ্যের রাসায়নিক ক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করতে সাহায্য করে। এতে জটিল উপাদানগুলো ভেঙ্গে দেহে গ্রহণযোগ্য সরল উপাদানে পরিণত হয়।

পৌষ্টিকতন্ত্রের বিভিন্ন অংশ :-

মুখ (Mouth)- এটি নাসারন্ধ্রের নিচে আড়াআড়ি একটি বড় ছিদ্র যা উপরে ও নিচে ঠোঁট দ্বারা বেষ্টিত থাকে।

মুখ গহ্বর (Buccal cavity)- মুখছিদ্রের ঠিক পেছনে অবস্থিত যার মাধ্যমে খাদ্য মুখ গহবরে প্রবেশ করে। মুখ গহ্বরের ভেতরে বিভিন্ন ধরনের দাঁত, জিহ্বা এবং তিন জোড়া লালাগ্রন্থি থাকে। লালাগ্রন্থি পৃথক পৃথক নালির মাধ্যমে মুখ গহ্বরের সাথে যুক্ত থাকে।

দাঁত- খাদ্যদ্রব্য ছেঁড়া, ছোট ছোট টুকরায় পরিণত করে এবং পেষণে অংশ নেয়।

জিহ্বা- খাদ্যের স্বাদ গ্রহণ এবং খাদ্যকে গিলতে সাহায্য করে।
পৌষ্টিকতন্ত্র কাকে বলে

লালাগ্রন্থিসমূহ - লালাগ্রন্থির নিঃসৃত রস মিউসিন খাদ্যকে ভিজিয়ে নরম এবং পিচ্ছিল করে খাদ্য গলাধঃ করতে অংশ নেয়।

গলবিল (Pharynx)- মুখ গহ্বর ও অন্ননালির মধ্যবর্তী ছোট অংশকে গলবিল বলে। গ্যালেট নামক ছিদ্রের মাধ্যমে মুখ গহ্বর গলবিলে যুক্ত হয়।

গলবিল এর কাজ- গলবিলের মাধ্যমে লালা মিশ্রিত আংশিক পরিপাককৃত খাদ্যদ্রব্য মুখ গহ্বর থেকে অন্ননালিতে পৌঁছায়।

অন্ননালি (Oesophagus)- গলবিলের পেছনে অবস্থিত নালিকে অন্ননালি বলে। এ নালী প্রায় ২৫ সেমি লম্বা।

কাজ- অন্ননালির মাধ্যমে খাদ্য দ্রব্য গলবিল থেকে পাকস্থলীর গহ্বরে প্রবেশ করে।

পাকস্থলী (Stomach)- অন্ননালির পেছনে অবস্থিত বৃহদাকার থলির ন্যায় অংশকে পাকস্থলী বলে। পাকস্থলীর প্রাচীর অত্যন্তপুর ও পেশিবহুল। পাকস্থলির প্রাচীরে অসংখ্য গ্যাস্ট্রিকগ্রন্থি থাকে। এর পেশি সংকোচন ও প্রসারণের মাধ্যমে খাদ্যবস্তুকে পিষে মন্ডে পরিণত করে।

কাজ- পাকস্থলিতে সাময়িকভাবে জমা খাদ্য থেকে অম্লীয় আমিষ জাতীয় খাদ্যের আংশিক পরিপাক হয়। গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত পাচক রস খাদ্য পরিপাকে সহায়তা করে।

আরও পড়ুন :- অঙ্গ ও তন্ত্র কাকে বলে?

ক্ষুদ্রান্ত্র (Small intestine)- পাকস্থলির পর থেকে বৃহদন্ত্র পর্যন্তবিস্তৃত লম্বা প্যাঁচানো নালিটিকে ক্ষুদ্রান্ত্র বলে। ক্ষুদ্রান্ত্র আবার তিনটি অংশে বিভক্ত। যথা-

১. ডিওডেনাম (১ম অংশ),

২. জুজেনাম (মধ্যম অংশ) ও

৩. ইলিয়াম (শেষ অংশ)।

ক্ষুদ্রান্ত্রের ডিওডেনাম পিত্তথলি থেকে পিত্তনালি এবং অগ্ন্যাশয় থেকে অগ্ন্যাশয়নালি এসে মিলিত হয়। পিত্তনালির মাধ্যমে পিত্তরস এবং অগ্ন্যাশয় থেকে অগ্ন্যাশয় রস ডিওডেনামে এসে পৌঁছে। ক্ষুদ্রান্ত্রের অন্তঃপ্রাচীরে আঙুলের মতো প্রক্ষেপিত অংশ থাকে যাকে ভিলাস বলে।

কাজ- পিত্তরস ক্ষুদ্রাস্ত্রের ডিওডেনামে ক্ষারীয় মাধ্যমে খাদ্য পরিপাকে সাহায্য করে। পরিপাককৃত খাদ্যসার ইলিয়ামের ভিলিইসমূহে শোষিত হয়।

বৃহদন্ত্র (Large intestine)-

ক্ষুদ্রাস্ত্রের পরবর্তী ইলিয়াম থেকে পায়ু পর্যন্তবিস্তৃত মোটা নলাকৃতির অংশ বৃহদন্ত্র। বৃহদন্ত্র তিনটি অংশে বিভক্ত। যথা- সিকাম, কোলন ও মলাশয়। সিকামের সাথে অ্যাপেনডিক্স নামক ক্ষুদ্র নলের মতো প্রবৃদ্ধি যুক্ত থাকে। বৃহদন্ত্রে মূলতঃ পানি শোষিত হয়, মল তৈরি হয় এবং মল জমা থাকে।

কাজ- মলাশয় বর্জ্য পদার্থ জমা রাখে। অপাচ্য খাদ্য থেকে প্রয়োজনীয় পানি এবং লবণ শোষণ করে।

পায়ু- পৌষ্টিকতন্ত্রের শেষ অংশে অবস্থিত ছিদ্রপথই পায়ু ।

কাজ- মলাশয় থেকে মল পায়ুপথে বাইরে নির্গত হয় ।

পৌষ্টিক গ্রন্থি (Digestive glands) :-

যে সব গ্রন্থির রস খাদ্য পরিপাকে অংশ নেয় তাদেরকে পরিপাক গ্রন্থি বলে। মানবদেহের পরিপাক গ্রন্থিগুলো হলো- লালা গ্রন্থি (Salivary gland), যকৃত (Liver), অগ্ন্যাশয় (Pancreas), গ্যাস্ট্রিক গ্রন্থি (Gastric glands)), আন্ত্রিক গ্রন্থি (Intestinal glands)।

লালাগ্রন্থি :-

লালাগ্রন্থি থেকে নিঃসৃত রস বা লালা রসে টায়ালিন নামক এনজাইম ও পানি থাকে, যা মুখগহ্বরের খাদ্য মন্ড তৈরিতে সাহায্য করে এবং খাদ্য সহজে গলাধঃকরণে সহায়তা করে।

মুখ গহবরের দু'পাশে তিন জোড়া লালাগ্রন্থি থাকে। যেমন- প্যারোটিড, সাবলিঙ্গুয়াল ও সাবম্যান্ডিবুলার।

আরও পড়ুন :- বৃক্ক কাকে বলে?

যকৃত :-

যকৃত মানবদেহের সর্ববৃহৎ গ্রন্থি। মধ্যচ্ছদার নিচে পাকস্থলীর ডানপাশে গাঢ় বাদামী বর্ণের ত্রিকোণাকার অঙ্গ।

যকৃতের সাথে কলস আকৃতির পিথেলি সংযুক্ত থাকে। যকৃত থেকে নিঃসৃত পিত্তরস পিত্তথলিতে জমা থাকে। পিত্তরস ক্ষারীয় গুণসম্পন্ন গাঢ় সবুজ বর্ণের এবং তিক্ত স্বাদবিশিষ্ট। পিত্তনালির মাধ্যমে পিত্তরস যকৃত থেকে ডিওডেনামে আসে। যকৃতে বিভিন্ন রকম জৈব রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটে, তাই একে রসায়ন গবেষণাগার বলা হয়।

কাজ-

যকৃত পিত্তরস তৈরি করে, ক্ষারীয় পিত্তরস পিত্তথলিতে জামা রাখে, পিত্তরসে কোন এনজাইম থাকে না, তাই যকৃত উদ্বৃত্ত গ্লুকোজ নিজ দেহে গ্লাইকোজেন হিসেবে সঞ্চিত রাখে, রক্তে গ্লুকোজের ঘাটতি হলে গ্লুকোজ সরবরাহ করে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে, পিত্তরস চর্বি জাতীয় খাদ্যকে ক্ষুদ্র দানায় পরিণত করে পরিপাকে সহায়তা করে।

অতিরিক্ত অ্যামাইনো অ্যাসিড যকৃতে আসার পর রাসায়নিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ইউরিয়া, ইউরিক অ্যাসিড ও নাইট্রোজনজনিত বর্জ্য পদার্থ তৈরি করে এবং স্নেহ জাতীয় পদার্থ শোষণে সাহায্য করে।

অগ্ন্যাশয় :-

পাকস্থলির পেছনে এবং ডিওডেনামের দু'বাহুর মধ্যে প্রায় আড়াআড়িভাবে অবস্থিত একটি গুরুত্বপূর্ণ মিশ্র গ্রন্থি।

অগ্ন্যাশয়নালি পিত্তনালির সাথে মিলিত হয়ে যকৃত অগ্ন্যাশয়নালি গঠন করে ডিওডেনামে উন্মুক্ত হয়। অগ্ন্যাশয়ে নালীযুক্ত ও নালিবিহীন উভয় প্রকার গ্রন্থি থাকে বলে একে মিশ্র গ্রন্থি বলা হয়।

নালিযুক্ত গ্রন্থির নিঃসৃত রসকে অগ্ন্যাশয় রস এবং নালিবিহীন গ্রন্থি থেকে ইনসুলিন ও গ্লুকাগন হরমোন তৈরি হয়।

কাজ-

অগ্ন্যাশয় রস খাদ্য পরিপাকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, খাদ্যের পরিপাকে অম্ল ক্ষারের সাম্যতা, পানির সাম্যতা, দেহ তাপ প্রভৃতি নিয়ন্ত্রণ করে, ইনসুলিন ও গ্লুকাগন রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে।

গ্যাস্ট্রিক গ্রন্থি :-

পাকস্থলির অন্তঃপ্রাচীরে অসংখ্য গ্রন্থি কোষ থাকে। এ গ্রন্থি কোষগুলোকে গ্যাস্ট্রিক গ্রন্থি বলা হয়।

এগুলো গ্যাস্ট্রিক রস নিঃসরণ করে। গ্যাস্ট্রিক রসে হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড, পেপসিন, গ্যাস্ট্রিক লাইপেজ নামক এনজাইম থাকে।

আন্ত্রিক গ্রন্থি :-

পাকস্থলীর অন্তঃপ্রাচীরের ন্যায় অস্ত্রের অন্তঃপ্রাচীরেও অসংখ্য গ্রন্থি কোষ থাকে। এ গ্রন্থি কোষগুলো থেকে আফ্রিক রস নিঃসৃত হয়। আন্ত্রিক রসে এনজাইম থাকে যা খাদ্য পরিপাকে বিশেষ ভূমিকা রাখে।

আন্ত্রিক সমস্যা- পৌষ্টিকতন্ত্রে পরিপাক প্রক্রিয়ায় ব্যাঘাতের কারণে নানা প্রকার আন্ত্রিক সমস্যা দেখা দেয়। ফলে নানান রোগ বা শারীরিক অসুবিধা দেখা দেয়।

যেমন- অজীর্ণতা/বদহজম, আমাশয়, কোষ্ঠকাঠিন্য, ব্যাসিলারি আমাশয়, অ্যামিবিক আমাশয়, গ্যাস্ট্রিক আলসার, অ্যাপেনডিসাইটিস, কৃমিজনিত রোগ, ডায়রিয়া ইত্যাদি।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ