জৈব বিবর্তন কাকে বলে? ডারউইনবাদের মূলনীতি?

বিবর্তন :-

বিবর্তন একটি জৈবিক পদ্ধতি। এর প্রকৃত অর্থ হলো ক্রমবিকাশ। পৃথিবীতে বর্তমানে যত জীব রয়েছে তারা বিভিন্ন সময়ে এ ভূমণ্ডলে আবির্ভূত হয়েছে। আবার অনেক উদ্ভিদ ও প্রাণী সময়ের আবর্তে বিলুপ্ত হয়েছে।

ডাইনোসর আজ থেকে কয়েক মিলিয়ন বছর আগে বিলুপ্ত হয়েছে। আবার কোন কোন জীব ধীর গতিতে পরিবর্তন ঘটিয়ে এখনও টিকে আছে। কয়েক লক্ষ বা হাজার বছর সময়ের ব্যাপকতায় জীব প্রজাতির পৃথিবীতে আবির্ভাব ও টিকে থাকার জন্য যে পরিবর্তন ও অভিযোজন প্রক্রিয়া তাকে জৈব বিবর্তন বলা হয় ।

হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক স্টেফেন জে. গোল্ড (১৯৯১) এর মতে 'Evolution' পরিপদটি সর্বপ্রথম ব্যবহার করেন জার্মান জীববিদ Albrecht von Haller (১৭৭৪ সালে)।

তিনি বলেন ধীর অথচ ক্রমাগত ও পর্যায়ক্রমিক পরিবর্তনের মাধ্যমে কোন সত্ত্বা সরল থেকে জটিল হওয়ার ধারাবাহিক পরিবর্তনই বিবর্তন।

কোন প্রাণী বা উদ্ভিদ ধীরে ধীরে ধারাবাহিক রূপান্তরের মাধ্যমে একটি সম্পূর্ণ নতুন প্রাণী বা উদ্ভিদ এ পরিণত হওয়াকে অভিব্যক্তি বলা হয়।

অভিব্যক্তির মূল কথা হলো প্রজাতিগুলো পরিবর্তনযোগ্য অর্থাৎ দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে জীবের চেহারায় পরিবর্তন ঘটে।

আরও পড়ুন :- পৌষ্টিকতন্ত্র কাকে বলে?

ইংরেজ প্রকৃতি বিজ্ঞানী চার্লস রবার্ট ডারউইন অভিব্যক্তির কলাকৌশল সম্পর্কিত তাঁর মতামত ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে ২৮ নভেম্বর 'The Origin of Species by means of Natural Selection' নামক বইটিতে প্রকাশ করেন। তাঁর মতামত প্রাকৃতিক নির্বাচন মতামত নামে পরিচিত।

তিনি (১৮৩১) H.M.B.S. Beagle নামক জাহাজে প্রকৃতিবিদ হিসেবে চাকরি পেয়ে বিশ্ব ভ্রমণে বাহির হন। তিনি আটলান্টিক মহাসাগরে অবস্থিত দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন দ্বীপ, তাহিতি, নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, মরিশাস, মালদ্বীপ, ব্রাজিল ও গ্যালাপ্যাগোস দ্বীপপুঞ্জে প্রায় পাঁচ বছর ধরে পরিভ্রমণ করেন এবং বিভিন্ন প্রাণীর নমুনা সংগ্রহ করেন।

ডারউইনের দায়িত্ব ছিল বিভিন্ন স্থানের উদ্ভিদ ও প্রাণী পর্যবেক্ষণ করা এবং এদের নমুনা সংরক্ষণ করা। সমুদ্রে ভ্রমণকালীন সময়ে ডারউইন, চার্লস লায়েল লিখিত 'The Principles of Geology' নামক বইটিতে প্রস্তাবিত তত্ত্বের প্রতি আকৃষ্ট হন।

উক্ত বইটিতে দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে পৃথিবীর চেহারা পরিবর্তিত হওয়ার কথা উল্লেখ ছিল। দক্ষিণ আমেরিকার উপকূলে ডারউইন নিজেও প্রস্তাবিত ভূ-তত্ত্বীয় পরিবর্তন এর চিহ্ন লক্ষ করেন। গ্যালাপ্যাগোস দ্বীপপুঞ্জে ভ্রমণকালে ডারউইন প্রত্যেক দ্বীপের পাখি ও কচ্ছপকে কিছুটা ভিন্ন চেহারায় দেখতে পান। যদিও সকল পাখিরা একই প্রজাতি এবং সকল কচ্ছপ একই প্রজাতিভুক্ত ছিল।

ইংল্যান্ডে লিখিত জনসংখ্যা সম্বন্ধীয় একটি প্রবন্ধ পাঠ করে বিশেষভাবে প্রভাবিত হন। উল্লেখ্য যে, Malthus এর প্রস্তাব অনুযায়ী জীবের সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পায়, যদিও খাদ্য সম্ভার শুধু গাণিতিক হারেই বাড়ে। এর ফলশ্রুতি হিসেবে সীমিত খাদ্য দখলের জন্য তীব্র লড়াই দেখা দেয়।

উল্লিখিত তথ্যাবলি ডারউইনের নিজস্ব চিন্তাস্রোতকে তীব্রতর করে। ফলে ডারউইন দীর্ঘকাল ধরে তার যুক্তির স্বপক্ষে সাক্ষ্য প্রমাণ সংগ্রহ করতে থাকেন। তিনি লক্ষ করেন যে প্রজননবিদগণ সিলেকশন (Selection) এর মাধ্যমেই নতুন ভ্যারাইটি সৃষ্টি করতে সক্ষম হন। অথচ এ পরিবর্তন প্রাকৃতিক উপায়ে হয় তাহলে নতুন প্রজাতি সৃষ্টি করে। যেহেতু প্রাকৃতিক উপায়ে এ নির্বাচন ঘটে তাই একে প্রাকৃতিক নির্বাচন বলে।

অবশেষে নিজের অভিজ্ঞতালব্দ তথ্যের ভিত্তিতে গভীর নিষ্ঠার সাথে তার যুক্তিগুলোকে সরলভাবে ব্যাখ্যা করে তিনি ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে ১লা জুলাই লন্ডনের লিনিয়াস সোসাইটি এর সভায় পেশ করেন।

ডারউইনের মতবাদের মূলতত্ত্বগুলো সম্পূর্ণ পৃথকভাবে সংক্ষেপে ও তুলনামূলকভাবে কম নমুনা পর্যবেক্ষণর মাধ্যমে ওয়ালেস (Alfred Russel Wallace) আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছিলেন বলে বিবর্তনের মতবাদকে যৌথ নামে "Darwin Wallace's Theory" বলা হয়।

ডারউইনবাদের মূলনীতি :-

ডারউইনবাদের অপর নাম ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচন মতবাদ। ডারউইনবাদ এর মূলতত্ত্বটি যে কয়েকটি মূলনীতির উপর প্রতিষ্ঠিত সেগুলোকে প্রধানত দু'ভাগে ভাগ করা যায়। যথা-

(ক) প্রাকৃতিক ঘটনাবলি ও
(খ) ডারউইনের সিদ্ধান্ত।

উল্লিখিত বিষয়গুলো নিম্নে সংক্ষেপে বর্ণনা করা হলো-

১. পরিবৃত্তি (Variation) :

ডারউইন লক্ষ করেন যে, যৌন জননে উৎপন্ন দুটি প্রাণী বা প্রাণীগোষ্ঠী সম্পূর্ণভাবে এক রকম নয়। একই প্রজাতির মধ্যে এমনকি একই পিতা-মাতার সন্তানদের মধ্যেও পার্থক্য দেখা যায়। একে পরিবৃত্তি বলে।

এসব পরিবৃত্তির অনেকগুলো বংশানুসৃত হয়। ডারউইন মনে করেন যে কোনো জীবন সংগ্রামে টিকে থাকাটা দৈবাৎ ঘটনা নয়। এটি নির্ভর করে বংশধারার উপর। অর্থাৎ পরিবৃত্তিগুলোর মধ্যে যেগুলো বিরূপ পরিবেশের সাথে সর্বাধিক অভিযোজিত সেগুলো টিকে থাকে। একে প্রাকৃতিক নির্বাচন বলে।

২. অত্যধিক জন্মহার ( Prodigality of reproduction) :

ডারউইন লক্ষ করেন যে, প্রত্যেক প্রজাতির প্রাণী। প্রাকৃতিক পরিবেশে প্রজনন অত্যধিক। যেমন- একটি সন্তান বেঁচে থাকলে এবং পরস্পরের মধ্যে প্রজনন করলে একজোড়া হাতি হতে ৭৫০ বৎসরে ১ কোটি ৯০টি হাতির সৃষ্টি হবে।

প্রকৃতিতে প্রতিটি জীবের প্রজনন ক্ষমতা, জন্মহার ও শেষ পর্যন্ত টিকে থাকার সংখ্যার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। প্রজন্মকে টিকিয়ে রাখার জন্যে এটি জীবের সহজাত ক্ষমতা। এর ফলে বেঁচে থাকা প্রাণী অপেক্ষা প্রজননকৃত প্রাণীর সংখ্যা বহুগুণ বেশি হয়।

একটি কাতলা মাছ চট্টগ্রামের হালদা নদীতে এক ঋতুতে প্রায় ৩ থেকে ৫ লক্ষ ডিম দিয়ে থাকে। অনুকূল পরিবেশে এখান থেকে জন্ম নেয়া পোনার মাত্র কয়েক হাজার বেঁচে থেকে বড় হবার সুযোগ পায়।

৩. সীমিত আহার্য ও বাসস্থান ( Limitation of food and space) :

একটি সুস্থিত পরিবেশে প্রাকৃতিক সম্পদ সর্বদা সীমিত থাকে যাহা নির্দিষ্ট সংখ্যক জীবকে বেঁচে থাকতে সাহায্য করে।

৪. জীবন ধারণের জন্য সংগ্রাম (Struggle for life) :

প্রতিটি প্রাণী অপেক্ষাকৃত অনেক বেশি পরিমাণে সন্তান জন্ম দেয়ার ফলে বেঁচে থাকার জন্য প্রাণীর মধ্যে সংগ্রাম অবধারিত। আর এ সংগ্রাম খাদ্য ও নিরাপদ আশ্রয় এবং প্রজননক্ষেত্রকে কেন্দ্র করে।

আরও পড়ুন :- রেচন ও রেচনতন্ত্র কি?

আর উক্ত যুক্তিগুলো ডারউইন দিয়েছেন যা ডারউইন কর্তৃক জীবন-সংগ্রাম নামে এবং হার্ভার্ড স্পেনসার 'Struggle for existence' আখ্যায়িত করেন। জীবের বেঁচে থাকার জন্য নিচের বিষয়গুলো বিবেচ্য।

(ক) প্রতিটি প্রাণীর জন্য খাদ্য ও বাসস্থান সীমিত। ফলে অধিক জনসংখ্যার একটা অংশ খাদ্যাভাবে মারা যায়। দেখা গেছে- কোন দ্বীপাঞ্চলে হরিণ ছেড়ে দিলে এরা বড় হয়, বংশবৃদ্ধি করে দ্রুত সংখ্যাবৃদ্ধি করে। পরে অতিরিক্ত হরিণ গাছের পাতা বা ঘাস খেয়ে এমন অবস্থার সৃষ্টি করে যে, অনাহারে তাদের মড়ক দেখা যায় এবং হরিণ সংখ্যা নিয়ন্ত্রিত হয়।

(খ) বিশ্বে প্রতিটি জীব আজীবন সংগ্রামে লিপ্ত। একই প্রজাতির বিভিন্ন সদস্যদের পরস্পরের মধ্যে অন্তঃপ্রজাতিক প্রতিযোগিতা যেমন রুইমাছ-রুইমাছ, বিড়াল-বিড়াল, বাঘ বাঘ কিংবা বানর বানর সংগ্রাম অথবা ভিন্ন দুটি প্রজাতির মধ্যে অর্থাৎ আন্তঃপ্রজাতিক প্রতিযোগিতা যেমন সাপ-বেজী, প্রজাপতি-মৌমাছি ইত্যাদি পারস্পরিক সংগ্রামে লিপ্ত হয়।

প্রতিটি প্রাণী প্রতিকূল পরিবেশের সাথে সংগ্রাম করছে। বন্যা, খরা, ঝড়, বৃষ্টি, অত্যধিক গরম, শীত, আগ্নেয়গিরি, সুনামি, জলোচ্ছ্বাস, ভূমিকম্প ইত্যাদি একটি পরিবেশের জীবের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত করে।

প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে বহু জীবের জীবন ধ্বংস হয়। সুতরাং জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে প্রাকৃতিক দুর্যোগ গুরুত্বপূর্ণ কার্যকরী ভূমিকা পালন করে।

৫. যোগ্যতমের টিকে থাকা (Survival of the fittest) :

জীবের মধ্যে অবস্থিত অনুকূল পরিবৃত্তিগুলো জীবন সংগ্রামে জয়ী হওয়াকে সহজ করে অর্থাৎ যাদের মধ্যে প্রয়োজনীয় পরিবৃত্তি থাকবে তারাই জীবন সংগ্রামে জয় লাভ করবে এবং অবশেষে টিকে থাকবে।

হার্বার্ট স্পেনসার একে যোগ্যতমের টিকে থাকা এবং ডারউইন প্রাকৃতিক নির্বাচন বলে উল্লেখ করেন।

৬. প্রাকৃতিক নির্বাচন (Natural selection) :

ডারউইনের ধারণা অনুযায়ী জীবন সংগ্রামে জয়ী হয়ে যারা টিকে থাকে তাদের মধ্যে প্রয়োজনীয় পরিবৃত্তি থাকে। অর্থাৎ প্রকৃতি কোন কোন জীবকে অনুকূল পরিবৃত্তি সরবরাহ করে এবং জীবন সংগ্রামে টিকে থাকতে পরোক্ষভাবে সহায়তা করে।

৭. নতুন প্রজাতি সৃষ্টি (Origin of new species) :

ডারউইনের ধারণা অনুযায়ী, অনুকূল পরিবৃত্তিসম্পন্ন জীবন। সংগ্রামে বিজয়ী জীবগণ দ্রুত এবং দক্ষতার সাথে পরিবর্তিত পরিবেশে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। ফলে তারা টিকে থাকে এবং প্রজনন করার সুযোগ পায়। এর সাথে সাথে তারা সন্তানদের মধ্যে পরিবৃত্তিগুলো সঞ্চারিত করে।

বংশানুক্রমে এভাবে বৈশিষ্ট্যের যোগ-বিয়োগ ঘটতে থাকলে এক সময়ে এমন কিছু বংশধর পাওয়া যাবে যাদের দেহের আকার ও আকৃতি আদি পূর্ব পুরুষ হতে সম্পূর্ণ ভিন্নতর হবে। এ সময়ে যদি এরা পূর্ব পুরুষদের মধ্যে প্রজননের সীমাবদ্ধতা অর্জন করে তবে এদেরকে নতুন প্রজাতি নামে অভিহিত করা যাবে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ