হৃদচক্র বা কার্ডিয়াক চক্র কাকে বলে? এর পর্যায়, নিয়ন্ত্রণ ও কৌশল?

হৃদচক্র কাকে বলে :

হৃদপিন্ডের সংকোচন ও প্রসারণের ফলে রক্ত দেহের অভ্যন্তরে গতিশীল থাকে। এমনকি বিশ্রামরত অবস্থায়ও এর সংকোচন ও প্রসারণ চক্রাকারে চলতে থাকে। হৃদপিণ্ডের প্রকোষ্ঠগুলোর সংকোচনকে সিস্টোল এবং সম্প্রসারণকে ডায়াস্টোল বলে।

এক বারের সিস্টোল ও ডায়াস্টোলকে একত্রে হৃদস্পন্দন বা হার্টবিট (Heart Beat) বলে।

একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের হৃদপিন্ডের স্বাভাবিক স্পন্দনের হার প্রতি মিনিটে ৭০-৮০ বার, গড়ে ৭৫ বার।

হৃদপিন্ডের প্রতি স্পন্দনে হৃদপিন্ডের সংকোচন ও প্রসারণের যে চক্রাকার প্রক্রিয়ার পুনরাবৃত্তি ঘটে তাকে হৃদচক্র বা কার্ডিয়াক চক্র বলে।

কার্ডিয়াক চক্র চলাকালীন হৃদপিন্ডের মধ্যে কিভাবে রক্ত সংবহন হয় তা পর্যায়ক্রমিক ৪টি দশায় সম্পন্ন হয়। যেমন-

ক. অলিন্দের সংকোচন (Atrial diastole)

গ. অলিন্দের সম্প্রসারণ (Atrial systole)

গ. নিলয়ের সংকোচন (Ventricular diastole) এবং

ঘ. নিলয়ের সম্প্রসারণ (Ventricular systole)

আরও পড়ুন:- জীবন বিজ্ঞান কাকে বলে?

ক. অলিন্দের সংকোচন :

এটি ০.১ সেকেন্ড স্থায়ী হয়। এ সময় অলিন্দ দু'টি সংকুচিত অবস্থায় থাকে। বাইকাসপিড ও ট্রাইকাসপিড কপাটিকা খুলে যায়। ফলে ডান অলিন্দ থেকে CO2, সমৃদ্ধ রক্ত ডান নিলয়ে এবং বাম অলিন্দ থেকে O2- সমৃদ্ধ রক্ত বাম নিলয়ে প্রবেশ করে। এই সময় পালমোনারি ও অ্যাওর্টিক সেমিলুনার কপাটিকাগুলো বন্ধ থাকে।

খ. অলিন্দের সম্প্রসারণ :

এর স্থিতি ০.৭ সেকেন্ড। এ সময় অলিন্দ দুটি প্রসারিত অবস্থায় থাকে। এতে ডান অলিন্দটি সুপিরিয়র ভেনাক্যাভা ও ইনফিরিয়র ভেনাক্যাভা এর মাধ্যমে এবং বাম অলিন্দটি পালমোনারি শিরার মাধ্যমে রক্ত গ্রহণ করে। এ সময় অলিন্দ নিলয়ী কপাটিকাগুলো বন্ধ থাকে। অলিন্দের প্রসারণ সমাপ্তি হওয়ার পরপরই আবার অলিন্দের সংকোচন প্রক্রিয়া শুরু হয়।

গ. নিলয়ের সংকোচন :

নিলয় দুটি রক্তপূর্ণ অবস্থায় সংকুচিত হয়। এর স্থিতিকাল ০.৩ সেকেন্ড। এতে ডান নিলয় থেকে রক্ত পালমোনারি মহাধমনিতে এবং বাম নিলয় থেকে রক্ত অ্যাওর্টাতে নিক্ষিপ্ত হয়। এ সময় ট্রাইকাসপিড ও বাইকাসপিড কপাটিকা সজোরে বন্ধ হয় এবং সেমিলুনার কপাটিকা খুলে যায়। নিলয়ের মধ্যবর্তী চাপ বৃদ্ধি পায় এবং নিলয় থেকে রক্ত নিলয়ের বাইরে নির্গত হয়। ডান নিলয় থেকে CO2 সমৃদ্ধ রক্ত পালমোনারী ধমনিতে এবং বাম নিলয় থেকে O2 সমৃদ্ধ রক্ত অ্যাওর্টায় প্রবেশ করে।

আরও পড়ুন :- শ্বাসনালি সংক্রান্ত রোগ ?

ঘ. নিলয়ের সম্প্রসারণ :


নিলয়ের সংকোচনের পরই নিলয়ের সম্প্রসারণ ঘটে। এ দশার স্থিতিকাল ০.৫ সেকেন্ড। এ দশা অলিন্দ থেকে রক্ত বাইকাসপিড ও ট্রাইকাসপিড কপাটিকা খুলে নিলয়ে প্রবেশ করে। পক্ষান্তরে সেমিলুনার কপাটিকা দুটি বন্ধ হয়ে যায়। নিলয়ের প্রসারণ অব্যাহত থাকায় এর অভ্যন্তরের চাপ ক্রমশ কমতে থাকে এবং তা যখন অলিন্দের চাপে নিচে নেমে যায় তখন অ্যাট্রিওভেন্ট্রিকুলার কপাটিকা খুলে যায়। নিলয় তখন অলিন্দ থেকে আগত রক্ত দ্বারা পূর্ণ হতে থাকে।

যেহেতু একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের হৃদপিণ্ড প্রতি মিনিটে ৭০-৮০ বার সংকুচিত সম্প্রসারিত হয়, সেহেতু হৃদচক্রের স্থিতিকাল ০.৮ সেকেন্ড। স্বাভাবিকভাবে অলিন্দ চক্র এবং নিলয় চক্র উভয়ের স্থিতিকাল ০.৮ সেকেন্ড ।

কার্ডিয়াক চক্রের নিয়ন্ত্রণ :-

বাইরের কোন উদ্দীপনা ছাড়াই মানুষের হৃদপিণ্ড নিজেই হৃদস্পন্দন সৃষ্টি করতে পারে। হৃদস্পন্দন হৃদপিণ্ডের বিভিন্ন প্রকোষ্ঠের কিছু রূপান্তরিত পেশি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। ডান অলিন্দের প্রাচীরে সুপিরিয়র ভেনাক্যাভার কাছে অবস্থিত সাইনো অ্যাট্রিয়াস নোড (SAN) নামক বিশেষ ধরনের কলা থেকে সৃষ্ট ইলেকট্রিক্যাল সিগন্যালের মাধ্যমে হৃদস্পন্দন শুরু হয়। একে পেসমেকার বা ছন্দ নিয়ামত বলে।

SAN থেকে উৎপন্ন ইলেকট্রিক্যাল সিগনাল মসৃণভাবে অলিন্দের প্রাচীরে ছড়িয়ে গিয়ে অলিন্দের সংকোচন কমায়। এ প্রক্রিয়াকে নিলয়ের সম্প্রসারণ বলে। এর ফলে নিলয় রক্তে পূর্ণ হয়।

আরও পড়ুন:- অঙ্গ ও তন্ত্র কাকে বলে?

SAN থেকে সিগনাল ডান আট্রিওভেন্ট্রিকুলার প্রাচীরে অবস্থিত, অ্যাট্রিওভেন্ট্রিকলার নোড (AVN) কর্তৃক গৃহীত হয়। এই সিগনাল আন্তঃভেন্ট্রিকল প্রাচীরে অবস্থিত, বান্ডল অব হিজ (Bundle of His) নামক হৃদপেশী তন্তুতে পৌঁছে। এখান থেকে সিগনাল পার্কিনজি ও তন্ত্রর জালকের মাধ্যমে নিলয় প্রাচীরে সঞ্চারিত হয়। ফলে বান্ডল অব হিজ এর ডান ও বাম শাখা ধরে হৃদপিন্ডের গোড়ায় পৌঁছায় এবং রক্ত পূর্ণ হয়ে ভেন্ট্রিকুলের তন্ত্রর জালকের সংকোচন ঘটে।

নিয়ন্ত্রণ কৌশল :-

হৃদস্পন্দন হৃদপিন্ডের ডান অলিন্দের SAN থেকে উৎপন্ন হয়। SAN থেকে প্রতি মিনিটে ৭২ বার যে স্পন্দন উৎপন্ন হয় তা খুব মন্থর গতিতে নোডের মধ্য দিয়ে এবং পরে অলিন্দ পেশির মধ্য দিয়ে দ্রুত AVN-এ পৌঁছায়।

এভাবে AVN-এর উৎপন্ন স্পন্দন কেন্দ্রিভূত হয়ে SAN-এর উপস্থিতিতে প্রতি মিনিটে ৫০ বার উদ্দীপিত হয় এবং সমহারে স্পন্দন আবেগ (৫০% মিনিটে) উৎপন্ন করে।

AVN থেকে স্পন্দন হিজের বান্ডলের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়ে ডান ও বাম শাখার মাধ্যমে স্পন্দন পারকিনজি তন্ত্রতে চলে যায়। এই হিজের বান্ডলের স্পন্দন হার প্রতি মিনিটে ৩৬ বার। হিজের বান্ডল থেকে পারকিজ তন্তুর মাধ্যমে সমগ্র নিলয় পেশিতে ছড়িয়ে পড়ে। এই তন্তু প্রতি মিনিটে ৩০-৩৫ স্পন্দন আবেগ উৎপন্ন করে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ