গীতিকবিতার বৈশিষ্ট্য - গীতিকবিতা কাকে বলে, কত প্রকার, উদ্ভব ও বিকাশ এবং ইতিহাস

গীতিকবিতার উদ্ভব ও বিকাশ :-


বাংলা গীতিকবিতার উদ্ভব ও বিকাশ এবং তার স্রষ্টা সম্পর্কে কবিদের কথা এখানে অপরিহার্যভাবে এসে পড়ে। সাধারণ বিশ্বাস, পাশ্চত্য গীতিকাব্যের প্রভাবেই বাংলা গীতিকবিতার সূচনা হয়। এই মত কত শতাংশে সত্য হলেও, সবটাই তা কিন্তু নয়।

পাশ্চাত্য গীতিকাব্যের প্রভাবের সঙ্গে দেশীয় সাহিত্যের এই দিকগুলিকে স্বীকার না করলে ইতিহাসকেও অস্বীকার করা হবে। মাইকেল মহাকাব্যের ধারার সূচনা করলেও সেই মহাকাব্যের মধ্যেই কোথাও কোথাও গীতিকবিতার আভাস ছিল। পরে আত্মভাবমূখ্য সনেট –‘আত্মবিলাপ', 'বলগভূমির প্রতি' এবং কবিতার মাধ্যমে তিনি গীতিকাব্যের পূর্ণ প্রবর্তন করেন।

গীতিকবিতা কাকে বলে বিহারীলাল চক্রবর্তীর অবদান ;

বিহারীলাল চক্রবর্তীই বাংলা গীতিকবিতার বিশিষ্ট সুরটিকে প্রথম অনুধাবন করেন। রবীন্দ্রনাথ এই জন্যেই তাকে 'ভোরের পাখি' বলেছেন।

বিহারীলাল চক্রবর্তীর 'সারদামঙ্গল' কাব্যটির নাম এপ্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। আদর্শ গীতিকাব্যের মতো বিহারীলাল এ কাব্যে একটি আলো-আঁধারির স্বপ্নালু পরিবেশ রচনা করেছেন।

বলা যায় এখানে রোমান্স ও অতিন্দ্রীয় জগতের এক অদ্ভুত সমন্বয় ঘটেছে। দেবী সারদা কবির সৌন্দর্যলক্ষ্মী। তার সঙ্গে মিলনের জন্য আকুলতা একাব্যে ধ্বনিত হয়েছে। বিষাদ, বিরহ, আনন্দ সমস্ত অনুভূতির স্তর পেরিয়ে কবি শেষ পর্যন্ত উপস্থিত হয়েছেন সব ভুল ও সংশয়ের অবসানে।

এখানে বিহারীলালের সৌন্দর্যলক্ষ্মী অনেকটাই শেলীর 'Hymn to intellectual beauty'-র মতো। গীতিকাব্যের অন্যতম প্রধান লক্ষণ মিষ্টিসিজম। 'সারদামঙ্গলে' বিহারীলালের সেই মিষ্টিক চেতনার পরিচয় পাওয়া যায়।


হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, নবীনচন্দ্র সেন, অক্ষয়কুমার বড়াল, দেবেন্দ্রনাথ সেন এঁরা হলেন ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকের কবি। শ্রেষ্ঠ গীতিকবি অবশ্যই রবীন্দ্রনাথ।

এই যুগের অপর বিশেষত্ব হল, বাঙালি মহিলা কবিদলের গীতিকবিতা রচনা। গিরীন্দ্রমোহিনী দাসী, মানকুমারী বসু, বিনয়কুমার ধর, কামিনী রায় প্রমুখের নাম এবিষয়ে উল্লেখযোগ্য। গার্হস্থ্য জীবনকেই এই মহিলা কবিদল বিশেষভাবে গ্রহণ করেছিলেন।

পুরুষ কবিগণ নিসর্গ জগৎ এবং রোমান্টিক জগৎকে ধীরে ধীরে গ্রহণ করে বিচিত্র বিষয়ের গীতিকবিতা রচনা করতে থাকেন। ফলে বাংলা গীতিকবিতা বিশেষ উন্নত ও সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। গীতিকবিতার সঙ্গে বাঙালির গানও উল্লেখযোগ্য।

অন্যান্য কবিরাও তখন নানা ভাবের গান লিখেছেন এবং সেগুলিও কাব্যগত দিকটিও ছিল সবিশেষ সমৃদ্ধ। এই কাব্যের দিকটির কথা মনে রেখেই এইসব গানকে বলা হত—'কাব্যগীতি'।

বিংশ শতাব্দীতে বাংলা গীতিকাব্য অবিস্মরণীয় সাফল্য অর্জন করে। বাংলা নাট্যসাহিত্যকে আশ্রয় করেও গান-গীতিকবিতার বিকাশ ঘটেছে। বাংলা গীতিকবিতার পরিণতির দুটি দিকে : এক, গদ্যকবিতায়; দুই কাব্যনাট্যে। দুটি ক্ষেত্রেই বাঙালি কবিরা উল্লেখযোগ্য কৃতিত্ব দেখিয়েছেন।
গীতিকবিতা

গীতিকবিতার ইতিহাস :-

উনিশ শতকে এদেশে যে নবজাগরণের সূত্রপাত হয়েছিল তা সাহিত্যের ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন আনয়ন করে। কাব্যের ক্ষেত্রে এই পরিবর্তন কাহিনিকাব্য ও গীতিকবিতার বিকাশে সহায়ক হয়েছিল। দুটি ধারা পাশাপাশি চললেও গীতিকবিতার ধারাটি অস্তিত্ব রক্ষা করেছে। কাহিনিকাব্য রচনার প্রবণতা বিলুপ্ত হয়েছে।

আরও পড়ুন :- সনেট কবিতা কি?

আধুনিক বিশ্বের চাঞ্চল্যে প্রভাবিত কবিরা গীতিকবিতার মধ্যেই প্রতিভা বিকাশের স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করেছেন। আধুনিক কালে গীতিকবিতা উপজীব্য বিষয়ের বৈচিত্র্যে বর্ণাঢ্য হয়ে উঠেছে। আধুনিক মানুষের জীবনের নানা রকম দিক, মনো জগতের নানা রকম ভাবনা অবলম্বনে গীতিকবিতা তৈরি হয় বলে এতে অন্তহীন বৈচিত্র্যের সৃষ্টি হয়েছে। আর এই বিষয় বৈচিত্র্যের হাত ধরেই বৈচিত্র্য এসেছে আঙ্গিকে, ভাষা ব্যবহারে ক্ষেত্রে, রূপ-ছন্দে ইত্যাদি নানা ক্ষেত্রে।

গীতিকবিতা কি ও কাকে বলে :-

রবীন্দ্রনাথ গীতিকবিতা সম্পর্কে বলেছিলেন যে -
'একটু খানির মধ্যে একটি মাত্র ভাবের বিকাশ'

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর গীতিকাব্যা নামক প্রবন্ধে গীতিকবিতা সম্পর্কে বলেছেন-
“বক্তার ভাব উচ্ছাসের পরিস্ফুটন মাত্র যার উদ্দেশ্য, সেই কাব্যই গীতিকাব্য।"
R. J. Rees-এর কথায় গীতিকবিতা—
'the poems in question are reasonably short, and have a definite unity of thought and feeling'

ইংরেজ কবি উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ বলেছিলেন -
“Poetry is the spontaneous overflow of powerful feelings, it takes its origin from emotion recollected in tranquility."

অন্যদিকে পি. বি. শেলি বলেছেন-
“Poetry is indeed something divine"

গীতিকবিতার লক্ষণ :-

গীতিকবিতার লক্ষণগুলি সূত্রাকারে এভাবে সাজানো যেতে পারে।

প্রথমত, গীতিকবিতা কবির একান্ত ব্যক্তিগত কথা। তাঁর নিজস্ব উপলব্ধির সঙ্গে সাধারণ ধর্ম বা তত্ত্বের কোনো সম্পর্ক থাকে না।

দ্বিতীয়ত, ব্যক্তিগত অনুভূতির তীব্রতার জন্যই গীতিকবিতায় এমন এক নিবিড় আত্মময়তা থাকে যা অনুভূতিশীল চিত্তকে ভীষণভাবে স্পর্শ করে, এবং এখানেই গীতিকবিতার সৌন্দর্য ফুটে ওঠে। কবির সঙ্গে পাঠকের এই নিবিড় রসগত সংযোগ গীতিকবিতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

তৃতীয়ত, ব্যক্তিগত অনুভূতি বা উপলব্ধির সার্থক স্ফুরণ ঘটলেও গীতিকবিতার একটা সার্বজনীন আবেদন থাকে। যা চিরন্তন ও শাশ্বত। অনুভূতিশীল সকল মানুষই এজাতীয় কবিতার আবেদনে আন্দোলিত হয়।

চতুর্থত, আবেগের সংযত ও সংহত পরিণতিতেই গীতিকবিতা লেখা যায়। ফলে এর প্রকাশরূপ অনেক বেশি সাবলীল, ব্যঞ্জনাময় ও সংহত।

আকারগত দিক থেকে এটি সংক্ষিপ্ত হলেও অনুভূতির প্রগাঢ় সম্মেলন এই শ্রেণির কবিতায় দেখা যায়।

একটি সার্থক গীতিকবিতার উদাহরণ দাও :-

সার্থক গীতিকবিতার একটি উদাহরণ হতে পারে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা’ কবিতাটি। অথবা আমরা বিহারীলাল চক্রবর্তীর 'সারদামঙ্গল' কাব্যটি নিতে পারি না আমরা উপরে আলোচনা করেছি।

এই কবিতায় কবি তাঁর মাতৃভূমি বাংলাকে স্নেহ ও গর্বের সাথে তুলে ধরেছেন। স্বাধীনতা সংগ্রামীদের স্মরণ করে বাংলার ঐতিহ্য ও সমৃদ্ধির কথা বলেছেন। এছাড়াও নারীর ক্ষমতায়ন, শিক্ষার গুরুত্ব ইত্যাদি বিষয়ে মন্তব্য রয়েছে।

সামাজিক প্রাসঙ্গিকতা, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধা, উন্নয়নের পথ সম্পর্কে ধারণা প্রকাশ - এসবের সমন্বয়ে এই কবিতাটি খুবই সার্থক। এছাড়াও কবির ভাষাগত দক্ষতা ও সহজ বোধ্যতার কারণেও এটি একটি উজ্জ্বল নমূনা।

সংক্ষেপে, বাংলার ঐতিহ্যকে সম্মান জানিয়ে এবং উন্নয়নের পথ নির্দেশ করে রবীন্দ্রনাথের এই কবিতাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং সার্থক।

গীতিকবিতা কয় প্রকার ও কি কি :-

গীতিকবিতা কয় প্রকার এই প্রশ্নের উত্তর অনেক রকম ভাবে দিয়েছে। তবে যেই দিকদিয়ে গীতিকবিতার শ্রেনীবিভাগ করা হোক না কেন তা নিন্মোক্ত গীতিকবিতার অন্তর্ভুক্ত হবে।


১ - ভাবকেন্দ্রিক গীতিকবিতা :-

নাম থেকেই বোঝা যায়, ভাবকেন্দ্রিক গীতিকবিতা (Subjective Poetry) হল সেই ধরনের গীতিকবিতা, যা কোনো ব্যক্তির নিজস্ব ভাবানুভুতিকে ভিত্তি করে প্রকাশিত হয়। অর্থাৎ বিষয়ের চেয়ে বিষয়ী যেখানে বড় বস্তুর চেয়ে বস্তুকে (বিষয়কে) আশ্রয় করে গড়ে ওঠা কোনো ব্যক্তিগত ভাবনাই যেখানে প্রধান হয়ে উঠে। এই ধরনের গীতিকবিতা হল :

i) আত্মচিন্তামূলক (Reflective) গীতিকবিতা।

ii) ভক্তিভাবমূলক (Devotional) গীতিকবিতা 

iii) স্বদেশপ্রেমমূলক (Patriotic) গীতিকবিতা

iv) প্রকৃতি বা নিসর্গকে আশ্রয় করে রচিত গীতিকবিতা

v) প্রেমমূলক গীতিকবিতা

vi) শোককাব্য (Elegy)

২ - রূপকেন্দ্রিক গীতিকবিতা :-

কেবল ভাবকে ভিত্তি করে যেমন গীতিকবিতার শ্রেণীবিভাগ করা যায়, তেমনি রূপ বা Form কেও ভিত্তি করে এই বিভাগ করা যায়।

i) 'ওড' (Ode) কবিতা।

ii) সনেট কবিতা।

গীতিকবিতার বৈশিষ্ট্য :-

নিন্মে গীতিকবিতার বৈশিষ্ট্য সমূহ আলোচনা করা হলো -

১ - ভাবগত বৈশিষ্ট্য :

গীতিকবিতা নির্জন এককের গান। একলা কবির ব্যক্তি অনুভূতির চিত্রলিপি গীতিকবিতা। কবি নিজেকে উন্মুক্ত করে দেন এখানে। হৃদয়ের উৎসমুখ থেকে বাণী নিঃসৃত হয়। কবির হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা, জ্বালা-যন্ত্রণা, হতাশা-আক্রোশ, অভিমান - অভিযোগ, ক্ষোভ-ঘৃণা, চাওয়া-পাওয়া না পাওয়া- সবকিছু শব্দের অক্ষরে ছন্দোবদ্ধ হয় গীতিকবিতায়।

২ - অঙ্গিকগত বৈশিষ্ট্য :

গীতিকবিতা হবে সংহত, সংযত। অল্প একটুর মধ্যে বৃহতের ইশারা ধ্বনিত হবে। কবিতা হবে সংগীতধর্মী। প্রাচীনকালে Lyre বা বীনাজাতীয় বাদ্যযন্ত্র যেমন Lyric এর সঙ্গী ছিল। তেমনি আজও গীতিকবিতার অন্তরে একটা সুর ধ্বনিত হয়। আখ্যানকাব্য বা মহাকাব্যের মতো বৃহদায়তন তো নয়ই, এমনকী আদি-মধ্য-অন্ত্য বিশিষ্ট হবে না।

অন্য ভাবে বললে উপরোক্ত গীতিকবিতার বৈশিষ্ট্য সমূহ ছাড়াও আরো কিছু বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়।

১ - কবির হৃদয়ের একান্ত ব্যক্তিগত ভাব আবেগের প্রকাশ হলো গীতিকবিতা।

২ - গীতিকবিতার একক আত্মমগ্ন অনুভবের তীব্রতা, সংবেদনশীল ভাষা ও সুরের অন্তর্লীন স্পর্শ পাঠক চিত্তকে অভিভূত করে। অর্থাৎ কবি ও পাঠকের নিবিড় রস সংযোগই গীতিকবিতার প্রধান আকর্ষণ।

৩ - কবির ব্যক্তিগত অনুভূতি ও সংবেদনের মন্ময়তা সত্ত্বেও গীতি কবিতার এক সর্বজনীন আবেদন ও মূল্য থাকে।

8 - গীতিকবিতা যতটা আবেগ অনুভূতি মূলক, সাধারণ ভাবে ততটা চিন্তা মূলক নয়।

৫ - সংহত ও সংক্ষিপ্ত অবয়ব বিন্যাসে সার্থক গীতিকবিতা শব্দ-ছন্দ-সুর-তান-ব্যঞ্জনায় এক সুসমন্বিত শিল্পরূপ। প্রেম, প্রকৃতি, স্বদেশ প্রীতি, ধর্মীয় বা ভক্তিমূলক ইত্যাদি নানা বিষয় নিয়েই গীতিকবিতা রচিত হতে পারে।

মহাকাব্য ও গীতিকবিতার পার্থক্য :-

মহাকাব্য ও গীতিকবিতার মধ্যে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য রয়েছে:

১. আকার ও বিস্তারের দিক থেকে:
  • - মহাকাব্যগুলো অত্যন্ত বিশাল আকারের। এগুলোতে বহু পাতার কবিতা থাকে।
  • - গীতিকবিতাগুলো খুব ছোট আকারের, কয়েক লাইন বা পাতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ।

২. বিষয় বিশ্লেষণের দিক থেকে:
  • - মহাকাব্যে বিস্তৃতভাবে কোন একটি বিষয় বা ঘটনাকে তুলে ধরা হয়।
  • - গীতিকবিতায় সাধারণত একটি নির্দিষ্ট ভাব বা অনুভূতিকে তুলে ধরা হয়।

৩. ভাষার ব্যবহারের দিক থেকে:
  • - মহাকাব্যের ভাষা সাধারণত বিস্তৃত, সমৃদ্ধ ও বর্ণনামূলক।
  • - গীতিকবিতায় সংক্ষিপ্ত ও সরল ভাষার ব্যবহার হয়।

৪. গঠন ও কাঠামোর দিক থেকে:
  • - মহাকাব্যের বিভিন্ন খণ্ড, সর্গ থাকে।
  • - গীতিকবিতা সাধারণত একটি খণ্ডেই সমাপ্ত হয়।

এভাবে বিষয়বস্তু, আকার, ভাষার ব্যবহার ও গঠনের দিক দিয়ে মহাকাব্য ও গীতিকবিতার মধ্যে পার্থক্য লক্ষ করা যায়।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ

Please do not enter any spam link in the comment box.