লোকসংগীত বা লোকগীতি কাকে বলে ও কত প্রকার

লোকসংগীত বা লোকগীতি কাকে বলে :- 

বাংলা লোকসাহিত্যের অন্যতম জনপ্রিয় এবং সমৃদ্ধ শাখা হলো লোকসংগীত। লোকগীতি বা লোকসংগীত এককথায় লোকের গীতি বা সংগীত। যা একটি মাত্র ভাব অবলম্বন করে গীত হবার উদ্দেশ্যে রচিত ও লোক-সমাজ কর্তৃক মৌখিকভাবে প্রচারিত তা লোকগীতি বা লোকসংগীত (Folk song)।

ছড়া, প্রবাদ, ধাঁধা, গীতি – সবই লোকসমাজের মানস ক্রিয়ার মৌখিক প্রকাশ। তার মধ্যে ছড়া মূলত কল্পনা প্রধান, প্রবাদ সমাজ অভিজ্ঞতা-নির্ভর, পরিচিতকে রহস্যের আবরণে ঢেকে ধাঁধার আবির্ভাব, আর লোকগীতি মূলত ভাব ও সুর নির্ভর। এই চার উপকরণই মুখ্যত লোকমানসের ভাবনা-চিন্তার ছন্দোবদ্ধ প্রকাশ। ভাব-আবেগ ও সুরের গভীরতায় অবশ্য লোকসংগীত-ই প্রথম।


ছড়ার আবেদন আমাদের মনের কল্পনার কাছে, প্রবাদের আবেদন পর্যবেক্ষণ ক্ষমতার কাছে, ধাঁধার আবেদন বুদ্ধির কাছে, আর সংগীতের আবেদন আমাদের হৃদয় ও আবেগের কাছে। লোক-সমাজের হৃদয়ের আবেগ বা ভাবোচ্ছ্বাসের প্রকাশ ঘটে লোকসংগীতের মধ্যে। যাকে আমরা বলি লোকসংগীত, তার মধ্যে কথা থাকে, কথার সঙ্গে থাকে সুর আর সুরের সঙ্গে অনুভূতি। লোকসংগীতে সমাজ-অনুভূতির অন্তরালে ব্যক্তি অনুভূতির ছোঁয়া কখনো কখনো অনুভূত হয়ে থাকে।

বাংলা লোকসংগীতের রূপ ও বিষয়গত বৈচিত্র্য তার ভাণ্ডারকে নানাভাবে সমৃদ্ধ করেছে। এদিক থেকে প্রকৃতির ভূমিকা অনস্বীকার্য। বাংলার পল্লী প্রকৃতির সহজ সরল রূপই বাংলার সংস্কৃতির জন্মদাতা।
লোকসংগীত বা লোকগীতি কাকে বলে

গ্রামবাংলার বিস্তীর্ণ সবুজ তৃণভূমি, কল্লোলিত নদ-নদীর শান্ত ও বিক্ষুব্ধ রূপ, মুক্ত স্বচ্ছন্দ মেঘমালা, ধূ-ধূ উদাসী প্রাপ্তর, বিস্তীর্ণ জলাভূমি বা হাওড়, চর পড়ে যাওয়া নদীবক্ষে কাশবন, বছরের ছটি ঋতু এবং তাদের ক্রমাগত পরিবর্তনশীল প্রাকৃতিক দৃশ্যের অপরূপ সৌন্দর্য এ দেশের নরনারীর মধ্যে একটি বিশেষ প্রবণতা সৃষ্টি করেছে; ভৌগোলিক, ঐতিহাসিক এবং ঐতিহ্যগত দিক থেকে এদেশের মানুষের মধ্যে তাই স্বভাব কোমলতা ও গীতিভাব-প্রবণতা প্রকাশ পেয়েছে। এর সঙ্গে মিশেছে দিনযাপনের সুখ-দুঃখ, প্রেম-বিরহ, জীবন-মৃত্যুর ও মিলন-বিচ্ছেদের বিচিত্র স্বাদ। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত জীবনের প্রতিটি পর্ব-ই তাই বাঙালি ভরিয়ে তুলেছে গানের ডালি দিয়ে।

লোকসাহিত্যের অন্যান্য উপকরণের মতো লোকসঙ্গীতও ঐতিহ্যবাহী। এর নির্দিষ্ট কোন লেখক বা গীতিকার যেমন থাকে না, তেমনি এর সুর ও কথা লোকমুখে পরম্পরাগতভাবে বাহিত বা গীত হয়, এবং তার ফলে কথা ও সুরে যে বিকৃতি ঘটে না তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। এক অর্থে লোক-গীতি কাউকে শিক্ষা করতে হয় না, এবং তা শিক্ষাদানের কোন বিধিবদ্ধ প্রণালীও নেই। 

আরও পড়ুন :- একাঙ্ক নাটক কি?
লোকগীতি কিভাবে রচনা করতে হয়, কি ভাবে স্মরণ রাখতে হয় কিংবা কিভাবে এর সুর ও তাল শিক্ষা করতে হয়, তার কোনও বিধিবদ্ধ প্রণালী নেই। কেবলমাত্র কানে শুনে সহজাত প্রবর্তনের দ্বারাই এই সকল বিষয় আয়ত্ত করা হয়ে থাকে। তবে লোকগীতির এই সহজাত বৈশিষ্ট্যগুলো কেবল লোকসমাজ সম্পর্কে প্রযোজ্য। 

শিষ্ট সংগীতের মতো লোকসংগীতও এখন নাগরিক মানুষের শিক্ষার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। শহরের মানুষ এখন লোকসংগীত শেখেন, শেখান। গান করেন, লেখেন এবং সুরও দেন। কিন্তু সেগুলো কতটা পরিমাণে লোকসংগীত সে সম্পর্কে সন্দেহ থেকেই যায়।

বাংলা লোকসংগীতের শ্রেণীবিভাগ :-

বাংলা লোকসঙ্গীতের ভাণ্ডারটি বেশ সমৃদ্ধ। তাকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। যেমন – ব্যবহারিক সঙ্গীত, কর্মসঙ্গীত, পার্বণসঙ্গীত, আনুষ্ঠানিক সঙ্গীত, আঞ্চলিক সঙ্গীত, প্রেমসঙ্গীত ইত্যাদি।

এছাড়া বিভিন্ন ভাবনির্ভর ধর্মবিষয়ক সঙ্গীতও পাওয়া যায় বাউল, মুর্শিদা, মারফতি, দেহতত্ত্ব ইত্যাদি নামে। বিষয়ভিত্তিক এই শ্রেণী বিভাগের পাশাপাশি অঞ্চলভিত্তিক দিকটিও বাংলা লোকসংগীতে বেশ গুরুত্বপূর্ণ।

লোকসংগীতের বাদ্যযন্ত্র :-

বাংলা লোকসংগীতের বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার কিছুটা গৌণ। প্রকৃতির নানামুখী রূপ পল্লীর লোকশিল্পী কণ্ঠকে নানাভাবে সহায়তা করেছে। তবু তাল ঠিক রাখতে, কণ্ঠস্বরে মাধুর্য যোগ করতে কিছু কিছু বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার হয় এবং সেই বাদ্য যন্ত্রগুলো এক একটা গানে এক এক রকমের। বাংলা লোকসংগীতে ব্যবহৃত বাদ্যযন্ত্রসমূহ সাধারণত এই রকম—
  • তারের যন্ত্র – একতারা, দোতারা, সংগ্রহ, গোপীযন্ত্র, সাবিদা
  • শুষির যন্ত্র – মুরলী, আবাশি, টিপরা বাঁশি, শিঙা।
  • আনদ্ধ যন্ত্র - ঢোল, কাড়া, ঢোলক, খোল, মাদল, খঞ্জরী, আনন্দ রহরী বা খমক।
  • ঘন যন্ত্র - করতাল (নানা প্রকারের), ঘটতাল, মন্দিরা, কাঁসি, কাঁসর, ঘণ্টা ইত্যাদি।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ