ব্যবসায় অর্থ সংস্থানের বিভিন্ন উৎসসমূহ?

ব্যবসায় অর্থ সংস্থানের বিভিন্ন উৎসসমূহ :-

ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা থেকে শুরু করে সুষ্ঠরুপে পরিচালনার জন্য বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনের ঋন এবং অর্থের প্রয়োজন হয়। আবার এই অর্থের প্রয়োজন ব্যবসায়ের প্রকৃতি ও কার্যধারার উপর নির্ভরশীল। 
আমারা অন্য একটি পোস্টে আপনাদের দেখিয়ছি অর্থ বা ঋণ সমূহকে আমরা ৩টি মেয়াদে ভাগ করেছি। এবার আমরা প্রতিটি মেয়াদের অধীনে অর্থ সংস্থানের উৎস সমূহকে বিস্তারিত আলোচনা করবো:

স্বল্প মেয়াদী অর্থসংস্থানের উৎস :-

আপনারা জেনেছেন যে, স্বল্প সময় অর্থাৎ এক বা তার কম সময়ের জন্য যে অর্থ বা তহবিলের সংস্থান করা হয়, তাকে স্বল্প মেয়াদী অর্থ সংস্থান বলে। স্বল্প মেয়াদী অর্থসংস্থানের উৎসগুলোকে আমরা নিম্নরূপে আলোচনা করতে পারি।

১. মালিকের নিজস্ব তহবিল (Owners own capital) :-

ব্যবসায়ের মালিক নিজের তহবিল থেকে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্বল্পমেয়াদি অর্থের যোগান দেয়। তবে মালিকের পক্ষে সমস্ত চলতি মূলধন সরবরাহ করা সম্ভব না হলে অন্যান্য উৎস থেকে তা সংগ্রহের ব্যবস্থা করা হয়।

২. ব্যক্তিগত ঋণ (Personal loan) :-

মালিক যদি নিজে চলতি অর্থের পুরো অংশ নিজের তহবিল থেকে সরবরাহ করতে না পারে তাহলে তিনি বন্ধুবান্ধব বা আত্মীয়স্বজনের নিকট থেকে ব্যক্তিগত ঋণ দিয়ে চলতি অর্থের অভাব পূরণ করতে পারেন।

৩. গ্রাম্য মহাজন (Village money lender) :-

গ্রামাঞ্চলে অবস্থিত ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের মালিকগণ তাদের নিজ গ্রাম বা পাশাপাশি গ্রামের মহাজনদের নিকট থেকে ঋণ গ্রহণ করে স্বল্পমেয়াদি অর্থসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারেন। অবশ্য এ ধরনের ঋণের ওপর চড়া হারে সুদ দিতে হয়।
ব্যবসায় অর্থ সংস্থানের বিভিন্ন উৎসসমূহ?

৪. দেশজ ব্যাংকার (Local banker) :-

গ্রামাঞ্চল এবং শহরাঞ্চল উভয় স্থানেই মহাজনদের মতো সুদের ব্যবসায়ী থাকে। তারা সুদের ওপর ঋণ দেয়। ব্যবসায়ের চলতি অর্থের জন্য এরা একটি বিরাট উৎস। এরা সর্বসাধারণের নিকট দেশজ ব্যাংকার নামে পরিচিত।

৫. ব্যবসায়িক ঋণ (Business loan) :-

ব্যবসায়িক ঋণ চলতি অর্থের একটি উৎস। আমাদের দেশে একজন ব্যবসায়ী আরেকজন ব্যবসায়ীর নিকট থেকে বাকিতে পণ্য ক্রয় করে সাময়িকভাবে চলতি মূলধনের ঘাটতি কিছুটা পূরণ করতে পারেন।

৬. গ্রাহকদের নিকট থেকে অগ্রিম গ্রহণ (Taking advance from customers) :-

এদেশের বড় বড় ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানগুলো বিশেষ করে উৎপাদক এবং পাইকারগণ গ্রহকদের নিকট থেকে পণ্যের মূল্য বাবদ অগ্রিম টাকা গ্রহণ করে স্বল্পমেয়াদি অর্থের ব্যবস্থা করতে পারেন।

আরও পড়ুন :- ব্যবসায় কাকে বলে?

৭. বাণিজ্যিক ব্যাংকের ঋণ (Commercial bank loan ) :-

বাণিজ্যিক ব্যাংক দেশের ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানসমূহকে জমাতিরিক্ত উত্তোলন, নগদ ঋণ ইত্যাদি প্রদান করেও স্বল্পমেয়াদি অর্থসংস্থান করে থাকে।

৮. সমবায় ব্যাংক (Cooperative bank) :-

সমবায় ব্যাংকগুলো ক্ষুদ্রায়তনের ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানকে স্বল্প সময়ের জন্য ঋণ দিয়ে তাদেরকে চলতি পুঁজির সমস্যা কাটিয়ে ওঠতে সাহায্য করে।

৯. ব্যবস্থাপনা প্রতিনিধি (Managing agent) :-

ব্যবস্থাপনা প্রতিনিধিরা তাদের অধীনস্থ কোম্পানিগুলোকে প্রয়োজনবশত চলতি মূলধন সরবরাহ করে থাকে।

১০. মুনাফার অংশ সংরক্ষণ (Preservation from profit) :-

ব্যবসায়ে প্রতি বছর যে মুনাফা অর্জিত হয় তার সবটা মালিক নিজে ভোগ না করে কিছু অংশ চলতি মূলধন হিসেবে ব্যবহার করতে পারে।

১১. সমবায় ঋণদান সমিতি (Cooperative credit Society) :-

কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান জামানত প্রদানের মাধ্যমে ঋণদান সমিতি থেকে স্বল্প মেয়াদের জন্য ঋণ গ্রহণ করে থাকে।

১২. কমার্শিয়াল পেপার হাউস (Commercial paper house) :-

কমার্শিয়াল পেপার হাউস এক ধরনের বিশেষায়িত মূলধন সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান। সংশ্লিষ্ট ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানসমূহ হুন্ডি, বিনিময় বিল, অঙ্গীকারপত্র ইত্যাদি মেয়াদ পূর্তির পূর্বে এখানে বিক্রয় করে আগাম অর্থ সংগ্রহ করে থাকে।

আরও পড়ুন :- ব্যবসায়ের পরিধি ও প্রকৃতি আলোচনা কর?

১৩. এন.জি.ও. (Non Government organization) :-

অনেক বেসরকারি সংস্থা (NGO) ক্ষুদ্র উৎপাদক ও ব্যবসায়ীদের স্বল্প মেয়াদের জন্য ঋণ প্রদান করে। গ্রামীণ ব্যাংক, ব্রাক, প্রশিকা ইত্যাদি এন.জি.ও. সমূহ গ্রামাঞ্চলে এ জাতীয় ঋণ সরবরাহ করে।

১৪. সরকারি প্রতিষ্ঠান (Government institutions) :-

অনেক দেশেই সরকারি প্রতিষ্ঠান বা বিভাগ শিল্প ও বাণিজ্যক্ষেত্রে ঋণদান কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে।

১৫. ভূমি বন্ধকি ব্যাংক (Land mortgage bank) :-

কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভূমি বন্ধকি ব্যাংক নামক আর্থিক প্রতিষ্ঠান জমি বন্ধক রেখে ঋণ দান করে থাকে। ব্যবসায়ীরা ভূমি বন্ধকি ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ করে স্বল্প মেয়াদি অর্থের সংস্থান করতে পারে।

উল্লিখিত উৎস ছাড়াও শিল্প ঋণসংস্থা, সম্পত্তি বিক্রয় ইত্যাদি বিভিন্ন উৎস ব্যবহার করেও ব্যবসায়ে স্বল্প মেয়াদি অর্থসংস্থান করা হয়ে থাকে।

মধ্যমেয়াদী অর্থসংস্থানের উৎসসমূহ :-

এক বৎসরের বেশি কিন্তু ৫ বা ১০ বৎসরের কম সময়ের জন্য যে অর্থের সংস্থান করা হয়, তাকে মধ্য মেয়াদী অর্থসংস্থান বলে। স্বল্প মেয়াদী এবং দীর্ঘ মেয়াদী অর্থ সংস্থানের মাঝামাঝি অবস্থান করে মধ্যমেয়াদী অর্থ সংস্থান মালিক নিজস্ব তহবিল থেকে অর্থ সংস্থানে ব্যর্থ হলেই বিকল্প উৎসের সন্ধান করে। বিভিন্ন উৎস থেকে

১. বাণিজ্যিক ব্যাংক :-

মধ্য মেয়াদী অর্থসংস্থানের প্রধান উৎস হলো বাণিজ্যিক ব্যাংক। বাণিজ্যিক ব্যাংক জনগণের আমানত জমা রাখে এবং তা থেকেই মধ্য মেয়াদী ঋণ প্রদান করে। আমানত কারীরা যে কোন সময় আমানত তুলে নিতে পারে। তাই তারল্য নীতি বজায় রাখার জন্য বাণিজ্যিক ব্যাংক দীর্ঘ মেয়াদী ঋণ প্রদান করে না। মধ্য মেয়াদী ঋণের প্রধান উৎস হিসেবে কাজ করে।

২. শিল্প ব্যাংক ও শিল্প ঋণ সংস্থা :-

দেশের শিল্প ব্যাংক এবং শিল্প ঋণ সংস্থা শিল্প উন্নয়নে বিশেষ শর্তে মধ্য মেয়াদী ঋণ প্রদান করে থাকে। এ দু'টি প্রতিষ্ঠান দেশের শিল্প কারখানা স্থাপন সম্প্রসারণ, আধুনিকীকরণ, পরিবর্তন-পরিবর্ধন ও পুনর্বাসনের জন্য মধ্য মেয়াদী ঋণের যোগান দিয়ে থাকে।

৩. বীমা কোম্পানি :-

বীমা কোম্পানিগুলো বাণিজ্যিক ব্যাংকের সাথে তাল মিলিয়ে ব্যবসায় ও শিল্প প্রতিষ্ঠানকে মধ্য মেয়াদী ঋণ সরবরাহ করে থাকে। তবে বীমা কোম্পানীগুলো এক্ষেত্রে সতর্কতার নীতি অনুসরণ করে অপেক্ষাকৃত কম ঝুঁকিপূর্ণ ক্ষেত্রে এবং বড় বড় প্রতিষ্ঠানকে মধ্য মেয়াদী ঋণ দিয়ে থাকে। তবে দীর্ঘ মেয়াদী ঋণ প্রদানই হলো বীমা কোম্পানির প্রধান কাজ।

৪. লিজিং কোম্পানি :-

লিজিং কোম্পানি দেশের শিল্পের উন্নয়ন ও বিকাশে মধ্যমেয়াদী ঋণ প্রদান করে থাকে।

৫. গ্রামীণ ব্যাংক :-

গ্রাম পর্যায়ের দরিদ্র-অসহায় মানুষের মধ্যে ঋণদানই গ্রামীণ ব্যাংকের প্রধান উদ্দেশ্য। তথাপি ইদানিং গ্রামীণ ব্যাংক বিশেষ শর্ত সাপেক্ষে প্রকল্প ভিত্তিক মধ্য মেয়াদী ঋণ প্রদান করছে।

৬. সরবরাহকারীদের ধার বা ঋণ সুবিধা :-

বর্তমানে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের ক্রেতাদের ভাড়া ক্রয় এবং কিস্তিভিত্তিক ক্রয়ের ক্ষেত্রে ধার বা ঋণ সুবিধা দিয়ে আসছে। বা ব্যবসায়ের মধ্য মেয়াদী অর্থসংস্থানকে গুরুত্বপূর্ণ উৎস হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।


৭. পেনশন তহবিল :-

মধ্যবর্তী ঋণের উৎস হিসেবে অনেক সময় শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিক বা ঋণ গ্রহীতাগণ কর্মচারীদের পেনশন তহবিল ব্যবহার করে থাকে।

দীর্ঘ মেয়াদী অর্থসংস্থানের উৎসমূহ :-

যে সকল উৎস থেকে দীর্ঘ মেয়াদের জন্য অর্থ বা ঋণ সংগ্রহ করা হয়, তাকে দীর্ঘ মেয়াদী অর্থসংস্থানের উৎস বলে। দীর্ঘ মেয়াদী অর্থসংস্থানের উৎসগুলোকে আমরা নিম্নরূপে আলোচনা করতে পারি।

১. প্রবর্তকদের নিজস্ব তহবিল (Owners own fund) :-

যে কোনো ব্যবসায় আরম্ভ করার সময় ব্যবসায়ের যারা মালিক থাকেন তারাই প্রধানত নিজ তহবিল থেকে দীর্ঘমেয়াদি মূলধন সরবরাহ করে থাকেন।

২. শেয়ার বিক্রয় (sale of share) :-

পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি জনসাধারণের নিকট শেয়ার বিক্রয় করে দীর্ঘমেয়াদি অর্থের যোগাড় করে থাকে। অবশ্য শেয়ার বিক্রয় করে যে টাকা পাওয়া যায় তার কিছু অংশ চলতি মূলধন হিসেবেও ব্যবহার করা যায়।

৩. ঋণপত্র বিক্রয় (Sale of debenture) :-

পাবলিক কোম্পানিতে যদি দীর্ঘমেয়াদি মূলধনের অভাব দেখা দেয়, তখন ঋণপত্র বা ডিবেঞ্চার বিক্রয় করেও অর্থ সংগ্রহ করা হয়।

৪. অবলেখকদের নিকট থেকে (From underwriters) :-

অনেক কোম্পানি শেয়ার অবলেখকদের নিকট থেকে দীর্ঘমেয়াদি অর্থ সংগ্রহ করে। অবলেখকগণ কোম্পানির নিকট থেকে শেয়ার ও ঋণপত্র অগ্রিম কিনে নেয় এবং পরে বাহিরের ক্রেতাদের নিকট এগুলো বিক্রয় করে।

৫. শেয়ার বাজারের মাধ্যমে (Through share market) :-

পাবলিক কোম্পানি শেয়ার বাজার বা স্টক এক্সচেঞ্জে শেয়ার ও ঋণপত্র বিক্রয় করে ব্যবসায়ের জন্য দীর্ঘমেয়াদি অর্থ সংগ্রহ করতে পারে।

৬. ব্যবস্থাপনা প্রতিনিধি থেকে (From managing agent) :-

কোম্পানির ব্যবস্থাপনা প্রতিনিধিগণ তাদের সাথে চুক্তিবদ্ধ কোম্পানিতে দীর্ঘমেয়াদি মূলধনের সরবরাহ করে।

৭. সংরক্ষিত তহবিল ব্যবহার (Use of reserve fund) :-

ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান সংরক্ষিত তহবিল থেকেও কিছু টাকা দীর্ঘমেয়াদি মূলধন হিসেবে ব্যবহার করতে পারে।

৮. ফাইনান্স কোম্পানি ( Finance company) :-

কোম্পানির শেয়ার অবলেখন করে বা সরাসরি ক্রয় করে ফাইনান্স কোম্পানি ব্যবসায়ে দীর্ঘমেয়াদি অর্থ সরবরাহ করে।

৯. বিনিয়োগ সংস্থা (Investment agency) :-

সাধারণত নিজস্ব শেয়ার বিক্রয় করে বিনিয়োগ সংস্থা তহবিল সৃষ্টি করে এবং উক্ত তহবিলের টাকা দিয়ে অন্যান্য কোম্পানির শেয়ার ক্রয় করে।

১০. বিমা কোম্পানি (Insurance company) :-

বিমা কেম্পানিগুলো বিভিন্ন ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে দীর্ঘমেয়াদি অর্থ সরবরাহ করে থাকে। জীবন বীমা কর্পোরেশন, ন্যাশনাল লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে দীর্ঘমেয়াদি অর্থ সরবরাহ করে।

১১. সরকারি বিভাগ (Government department) :-

সাধারণত প্রতিটি দেশেই সরকারের অর্থসংস্থান বিভাগ থাকে। এ বিভাগ শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে দীর্ঘমেয়াদি অর্থের যোগান দেয়।

১৪. কেন্দ্রীয় ব্যাংক (Central bank) :-

যে কোনো দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সে দেশের শিল্প বাণিজ্যের ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ সরবরাহ করে থাকে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ