পাইকারি ব্যবসায়ের বৈশিষ্ট্য ও গুরুত্ব ও কার্যাবলী আলোচনা কর?

পাইকারি ব্যবসায়ের বৈশিষ্ট্য :-

পাইকারি ব্যবসায়ের মাধ্যমে পণ্য খুচরা ব্যবসায়ীর কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়। এই ব্যবসায়ের বৈশিষ্ট্য নিম্নরূপ

১. পণ্য সংগ্রহ (Collection of Product) :-

পাইকারী ব্যবসায়ে পণ্য সংগ্রহের প্রধান উৎস হলো উৎপাদক ও (বিদেশী পণ্যের ক্ষেত্রে) আমদানিকারক। পাইকারগণ উৎপাদকের নিকট থেকে সরাসরি পণ্য খরিদ করে। আর যেসব বিদেশী পণ্য দেশের অভ্যন্তরে আমদানি করে বিক্রি করার বিধান রয়েছে সেগুলো পাইকাররা সরাসরি আমদানিকারকদের কাছে থেকেই ক্রয় করে।

২. পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ের পরিমাণ (Buying Selling Amount of Product) :-

পাইকারী ব্যবসায়ের আরেকটি লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য হলো তারা আমদানীকারক বা উৎপাদনকারীর কাছ থেকে পণ্য বিপুল পরিমাণে ক্রয় করে খুচরা ব্যবসায়ী বা শিল্প পণ্য ব্যবহারকারীদের নিকটও বহুল পরিমাণে পণ্য বিক্রয় করে।

অবশ্য একজন পাইকার আরেকজন পাইকার বা মধ্যস্থকারবারীর নিকটও পণ্য বিক্রি করতে পারে। তাদের বিক্রিত পণ্যের পরিমাণ সর্বদাই চূড়ান্ত ভোক্তাদের নিকট বিক্রিত পণ্যের তুলানায় বেশি হয়।

৩. পণ্যের সংখ্যা (Number of Product) :-

পাইকারী ব্যবসায়ে সাধারণত কয়েকটা সীমিত পণ্যে লেনদেন হয়। সব ধরনের পণ্যের লেনদেন করা পাইকারী ব্যবসায়ের ধর্ম নয়।

৪. ভোক্তার নিকট পণ্য বিক্রয় (Selling Product to Consumer) :-

তাত্ত্বিক দিক থেকে বিচার করলে দেখা যায়, পাইকারী ব্যবসায়ীরা ভোক্তাদের নিকট সরাসরি পণ্য বিক্রি করে না। অবশ্য বাস্তবে সুবিধাজনক অবস্থানের কারণে কিছু কিছু ভোগ্যপণ্যের পাইকারকে ভোক্তার নিকট পণ্য বিক্রি করতে দেখা যায়।

আরও পড়ুন :- বিক্রয় প্রসার কাকে বলে?

৫. পাইকারী ব্যবসায়ের অবস্থান (Position of Wholesale Business) :-

পাইকারী ব্যবসায় এমন একটি মধ্যস্থ ব্যবসায় যারা সাধারণত নিজেরা পণ্য উৎপাদন করে না, তারা অন্যের উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করে। সে কারণে পাইকারী ব্যবসায় উৎপাদক ও ক্রেতা বা ভোক্তার মাঝামাঝি অবস্থান করে।

৬. একক প্রতি মুনাফা (Per Unit Profit) :-

পাইকারী ব্যবসায়ে ক্রয়কৃত পণ্যে একক প্রতি সামান্য মুনাফা ধরে বিক্রয় করা হয়। অধিক পরিমাণে পণ্য ক্রয়-বিক্রয় হয় বলে পাইকারি ব্যবসায় থেকে একক প্রতি মুনাফা অর্জন করা যায়।

৭. অধিক মূলধন (Large Capital ) :-


এ ধরনের ব্যবসায়ে পাইকারী ব্যবসায়ির অধিক মূলধন বিনিয়োগের প্রয়োজন হয়। কারণ তাকে বিপুল পরিমাণে পণ্য ক্রয় করতে হয়, আবার সেই পণ্য বিক্রয় না হওয়া পর্যন্ত গুদামজাতকরণ করতে হয়।

অন্যদিকে, উৎপাদনকারী ও খুচরা ব্যবসায়ীকেও ব্যবসায় স্বাভাবিক রাখার জন্য আর্থিক সুবিধা দিয়ে থাকে। পাইকারের পুঁজি খুচরা ব্যবসায়িদের তুলনায় অধিক থাকে বলে বহুল পরিমানে পণ্য খরিদ করা তার পক্ষে অসুবিধা হয় না।

৮. অত্যাধিক ঝুঁকি গ্রহণ (Highest Risk) :-

পাইকারি ব্যবসায়ে অধিক পণ্য ক্রয়, পণ্য গুদামজাতকরণ ও পণ্য বিক্রয়ে অধিক ঝুঁকি গ্রহণ করতে হয়।
পাইকারি ব্যবসায়ের বৈশিষ্ট্য ও গুরুত্ব ও কার্যাবলী আলোচনা কর?

পাইকারি ব্যবসায়ের কার্যাবলি ও গুরুত্ব :-

পাইকারি ব্যবসায়ী বা পাইকার বিভিন্ন প্রকারের বিপণন কার্য সম্পাদন করে থাকে। এগুলোর মধ্যে কিছু কার্যাবলি সম্পাদন করা হয় পণ্য উৎপাদকদের জন্য এবং কিছু খুচরা ব্যবসায়ীদের জন্য। উভয় পক্ষের জন্য সম্পাদিত কার্যসমূহ নিম্নে আলোচনা করা হলো -

১. ক্রয় কার্য (Buying) :-

পাইকারী ব্যবসায়ীরা তাদের গ্রাহকদের ক্রয় প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করে। পাইকারগণ আগেভাগেই নিজস্ব বুদ্ধিমত্তা খাটিয়ে ঠিক করে নেয় তাদের গ্রাহকরা কি চাইতে পারে।

অর্থাৎ গ্রাহকদের চাহিদা সম্পর্কে পাইকাররা অগ্রিম সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং সেই অনুযায়ী বিভিন্ন উৎস থেকে পণ্য সংগ্রহ করে মজুদ রাখে। ফলে বিভিন্ন ধরনের গ্রাহক তাদের প্রয়োজন মোতাবেক পণ্য সংগ্রহ করতে পারে। খুচরা ব্যবসায়ী এবং শিল্প পণ্য ক্রেতাদের ক্রয় প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করতে গিয়ে পাইকারী ব্যবসায়ী পরোক্ষভাবে উৎপাদনকারীদেরও যথেষ্ট সহায়তা করে থাকেন।

অগণিত খুচরা কারবারীদের প্রয়োজনীয়তা মেটাবার জন্য পাইকারকে প্রচুর পণ্য সংগ্রহ করতে হয় বলে তিনি উৎপাদকের নিকট বেশি পরিমাণে ফরমায়েশ প্রদান করতে পারেন। এতে উৎপাদকের বন্টন খরচ হ্রাস পায়।

২. বিক্রয় কার্য (Selling) :-

পাইকারী ব্যবসায়ী পণ্য উৎপাদনকারীদের বিনা প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেন। তার মাধ্যমেই উৎপাদকদের প্রস্তুত পণ্যসামগ্রী খুচরা ব্যবসায়ীদের হাতে পৌঁছায়। পাইকারি ব্যবসায়ীরা উৎপাদকদের পক্ষ হয়ে পণ্যের ক্রেতার সন্ধান করেন, ক্রেতার সাথে বিক্রয়ের শর্তাবলী সম্পর্কিত চুক্তি সম্পাদন করেন এবং বিক্রয়োত্তর পণ্যের মালিকানা হস্তান্তর করেন। পাইকারী ব্যবসায় উৎপাদকের পক্ষে দেশের বিভিন্ন জায়গায় অবস্থিত অগণিত খুচরা কারবারীদের সাথে পণ্য বিক্রির জন্য সংযোগ রক্ষা করে ও অর্থনৈতিক দিকথেকে সাশ্রয়ী উপায়ে পণ্য বিক্রয় করতে পারে।

৩. পৃথককরণ (Dividing) :-

পাইকারি ব্যবসায়ী উৎপাদকদের নিকট থেকে লটে পণ্য সামগ্রী ক্রয় করে এবং খুচরা ব্যবসায়ীদের নিকট সে সব সামগ্রী ভাগ করে স্বল্প পরিমাণে বিক্রি করে। অনেক উৎপাদক লট না হলে পণ্যসামগ্রী বিক্রি করে না এবং অনুরূপভাবে অধিকাংশ খুচরা ব্যবসায়ীও লটে পণ্য কিনতে রাজী হয় না। এ দুইয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানের ক্ষেত্রে পাইকারী ব্যবসায়ীর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।

8. পরিবহন (Transportation) :-

খুচরা ব্যবসায়ীদের তুলানায় অনেক বেশি পরিমাণে পণ্য ক্রয় করে পাইকারী ব্যবসায়ীরা পরিবহন বায় হ্রাস করেন। পাইকারী ব্যবসায়ীরা তাদের গ্রাহকদের পরিবহন সেবা প্রদান করে থাকেন। তারা বিক্ষিপ্ত স্থানে অবস্থিত বহুসংখ্যক উৎপাদকদের নিকট থেকে পণ্যদ্রব্য একস্থানে একত্রিত করেন। এবং সেখান থেকে খুচরা ব্যবসায়ীদের সেই পণ্য সরবরাহ করেন। ফলে পণ্য সমর্পন (delivery) দ্রুততর হয়। এর ফলে খুচরা ব্যবসায়ী ও শিল্পী পণ্য ব্যবহারকারীদের অধিক পরিমাণে পণ্য মজুদ রাখতে হয় না।

৫. গুদামজাতকরণ (Warehousing) :-

পাইকারী ব্যসায়ীরা খুচরা ব্যসারীদের জন্য গুদামজাতকরণ বা পণ্য সংরক্ষণ কাজও করে থাকেন। সংরক্ষণ কার্যাবলীর মাধ্যমে পাইকারগণ স্থানগত ও সময়গত উভয় প্রকার উপযোগিতা সৃষ্টি করে থাকেন। সাধারণত তাদের উন্নতমানের সংরক্ষণ সুবিধা থাকে এবং তারা খুচরা ব্যবসায়ীদের তুলনায় অধিকতর দক্ষতার সাথে গুদামঘরের নির্দিষ্ট জায়গা ব্যবহার করতে পারেন। ফলে তারা স্বল্পতর ব্যয়ে পণ্য সংরক্ষণ করতে সক্ষম।


৬. পণ্য পর্যায়িতকরণ (Grading) :-

পাইকারী বাসায়ীদের গুদামে রক্ষিত বিভিন্ন পণ্য তারা প্রয়োজন মোতাবেক বিভিন্ন গ্রেডে ভাগ করে পণ্যগুলোকে সুন্দর মত শ্রেণীবিন্যাস করে রাখে। এর ফলে পরবর্তীকালে পণ্য বিতরণে সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় না।

৭. মোড়ক বাঁধাই (Packaging) :-

পাইকারী ব্যবসায়ীদের আরেকটি কাজ হলো পর্যায়িত পণ্যের মোড়ক বাঁধাই। পণ্যসামগ্রী গ্রেড অনুযায়ী মোড়ক বাঁধাই করা না হলে গুদামে সংরক্ষন করা অসুবিধাজনক হয়ে দাঁড়ায়। তাই পাইকারী ব্যবসায়ীরা সংরক্ষণে ও পরিবহনের সুবিধার্থে পণ্যসামগ্রীর মোড়ক বাঁধাই করে থাকে।

৮. অর্থ সংস্থান (Financing) :-

পাইকারী ব্যবসায়ীরা খুচরা ব্যবসায়ীদের নিকট অনেক সময় ধারে পণ্যদ্রব্য বিক্রয় করে থাকেন। খুচরা ব্যবসায়ীদের অনেক যখন অধিক পরিমাণে পণ্যসামগ্রী ক্রয় করেন, তখন তারা পণ্যের সম্পূর্ণ মূল্য পরিশোধ করতে ব্যর্থ হলে পাইকাররা তাদেরকে ধারে পণ্য সরবরাহ করেন।

এভাবে খুচরা ব্যবসায়ীরা ধারে পণ্য কিনে তা নগদে বিক্রি করার পর পাইকারের পাওনা মিটিয়ে দেন। আবার পাইকার ব্যবসায়ী উৎপাদকদেরকেও প্রত্যক্ষভাবে আর্থিক সহায়তা প্রদান করে থাকেন। তারা মৌসুমের আগে পণ্য খরিদ করে খুচরা ব্যবসায়ীদের নিকট বিক্রি করার পূর্বেই উৎপাদকদের মূল্য পরিশোধ করে দিয়ে তাদের নির্বিঘ্নে উৎপাদন চালিয়ে যেতে সাহায্য করেন। অনেক সময় তাড়াতাড়ি বিল পরিশোধ করেও পাইকাররা উৎপাদকদের সাহায্যে এগিয়ে আসেন।

৯. ঝুঁকি বহন (Risk Bearing) :-

উৎপাদকদের তুলনায় পাইকারী ব্যবসায়ীরা খুচরা দোকানীদের নিকটে অবস্থিত থাকেন ফলে খুচরা দোকানীরা দ্রুত পণ্যদ্রব্যের ডেলিভারী নিতে পারেন। তাই পাইকারী ব্যবসায়ীদেরকে পণ্যদ্রব্য বিশাল পরিমাণে মজুদ করতে হয়। ফলে মূল্য পরিবর্তনের দরুন উদ্ভূত ঝুঁকি তাদের হ্রাস পায়।

সাধারণত, পাইকাররা বিক্রীত মালের গ্যারান্টি দিয়ে থাকেন। তাই ক্রীত মালের কোন পন্য ত্রুটি থাকলে খুচরা ব্যবসায়ী তার ক্ষতিপূরণ দাবি করতে পারেন। অগ্রিম মালপত্র খরিদ করে পাইকারী ব্যবসায়ী উৎপাদকদের ঝুঁকিও হ্রাস করে। পণ্যসামগ্রী গুদামজাত করে পাইকার মূল্য পরিবর্তন, ফ্যাশন পরিবর্তন এবং অবাধিক ক্ষতিজনিত উৎপাদকের ঝুঁকি হ্রাস করে থাকেন।

১০. ব্যবস্থাপনা সেবা ও পরামর্শ (Management Services and Advice) :-

বাজার তথ্য ও সাধারণ পরামর্শ প্রদান করে পাইকারী ব্যবসায়ী গ্রাহকদের উপকার করে থাকে। বিশেষ করে খুচরা কারবারীদের ব্যবস্থাপকীয় সেবা ও পরামর্শ প্রদানের মাধ্যমে পাইকারী ব্যবসায়ীরা বাজারে তাদের অবস্থান সুদৃঢ় করেছেন।

পাইকারগণ বর্তমান যুগে যে সকল ব্যবস্থাপকীয় সেবা প্রদান করে থাকেন তন্মম্যে খুচরা বিক্রয় কর্মীদের প্রশিক্ষণ, দোকানে পণ্যসামগ্রী সাজিয়ে-গুছিয়ে আকর্ষণীয় প্রদর্শনের ব্যাপারে পরামর্শ প্রদান, দোকানের লে-আউট, উন্নততর মজুদ সিস্টেম স্থাপন ইত্যাদি অন্যতম।

পাইকারী ব্যবসায়ীগণ খুচরা ব্যবসায়ীদেরকে পণ্যের মূল্য, বাজারের হালচাল, ফ্যাশনের উত্থান-পতন, গ্রাহকদের চাহিদা, বাজারে নতুন পণ্যের আগমন ও পপোল বিভিন্ন উৎস সম্পর্কে প্রয়োজনীয় ও মূল্যবান তথ্য সরবরাহ করে থাকেন।

আবার পাইকারী ব্যবসায়ীরা পণ্য উৎপপাদকদেরও বিভিন্ন উপায়ে পরামর্শ ও উপদেশ দিয়ে থাকেন। পাইকারী ব্যবসায়ীরা খুচরা ব্যবসায়ীদের সাথে সর্বদাই ব্যক্তিগত ও ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়িক যোগাযোগ রক্ষা করে থাকেন। তাই তাদের পক্ষে খুচরা দোকনদারদের মাধ্যমে গ্রাহক/ভোক্তাদের পণ্যের চাহিদা, তাদের পছন্দ-অপছন্দ ইত্যাদি তথা জানা খুবই সহজ।

১১. মূল্য নির্ধারণ (Pricing) :-

পাইকারী ব্যসায়ীদের আরেকটি কাজ হলো বিক্রিযোগ্য পণ্যের পাইকারী মূল্য নির্ধারণ। তারা উৎপাদক বা আমদানিকারকদের নিকট থেকে পণ্যসামগ্রী ক্রয় করার পর ক্রয় মূল্যের ভিত্তিতে বিক্রয় মূল্য নির্ধারণ করে। সাধারণত, ক্রয় মূল্যের উপর নির্দিষ্ট হারে মুনাফা যোগ করার পর বিক্রয় মূল্য নির্ধারণ করা হয়।

১২. উন্নতমানের পণ্য সরবরাহ (Supply of Best Products) :-

প্রতিষ্ঠিত পাইকারি ব্যবসায়ীরা তাদের দীর্ঘ দিনের অভিজ্ঞতা থেকে জানতে পারেন, কোন কোন উৎপাদক উন্নতমানের পণ্যসামগ্রী সবচেয়ে কম মূল্যে সরবরাহ করে থাকেন। এ ধরনের বিশেষায়ণ পাইকারদেরকে প্রত্যক্ষভাবে খুচরা কারবারীদের এবং পরোক্ষভাবে ভোক্তাদের কম মূল্যে উত্তম ঋণের পণ্য সরবরাহ করে তাদের সহায়তা করতে সক্ষম করে তোলে।

আরও পড়ুন :- প্রসার কাকে বলে?

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ