বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনা কাকে বলে? বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনার ৪ টি নীতি?

বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনা মতবাদের মূল সূত্র হল ব্যবস্থাপনায় বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির প্রয়োগ অর্থাৎ পরীক্ষা-নিরীক্ষা, তথ্য অনুসন্ধান, সংগ্রহ, বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণ, বিশ্লেষণ ও গবেষণার দ্বারা ব্যবস্থাপনার প্রধান প্রধান রীতি-নীতি ও কর্মপদ্ধতি নির্ধারিত হবে। বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনা মতবাদের প্রবর্তক হলেন এফ. ডব্লু টেলর। এই মতবাদের অন্যান্য উল্লেল্লযোগ্য সমর্থকরা হলেন এইচ এল ন্যাট (H. L. Ganit). এফ. বি. লিখে (F B. Gilbreth), এম. এল. কুক (ML Cooke) এবং এইচ এমারসন (H Emerson) প্রভৃতি।

বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনার জনক মার্কিন ইঞ্জিনিয়ার ফ্রেডরিক উইন্সলো টেইলর (১৮৫৬-১৯২৫) ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে শিল্প সংক্রান্ত ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে এক বিশেষ ধরনের ব্যবস্থাপনার প্রবর্তন করে জগৎ-বিখ্যাত হন, যার নাম বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনা। তিনি ১৮ বছর বয়সে যন্ত্র নির্মাতা (machinist) এবং লেদ চালানোর কার্যে শিক্ষানবীশ হিসাবে কর্মজীবন শুরু করেন।

তারপর ২২ বছর বয়সে মিডভেল স্টিল ওয়ার্কস (Midvale Steel Works) কোম্পানিতে যোগদান করেন। পরবর্তীকালে তাঁর যোগ্যতার জন্য ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠানের প্রধান ইঞ্জিনিয়ার পড়ে উন্নীত হন। ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে তাঁর বিখ্যাত বই "The Principles of Scientific Management" প্রকাশিত হয়। যা ব্যবস্থাপনার জগতে ঐতিহাসিক সাড়া জাগায়। আজও তাঁর বইটি বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনার গীতা স্বরূপ।

বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনা কাকে বলে :-


এফ. ডব্লু টেলর বলেছেন “তোমার কর্মীদের নিয়ে তুমি কী কী কার্য করাতে ইচ্ছুক তা সঠিকভাবে নিরূপণ করা এবং কর্মীগণ উৎকৃষ্ট উপায়ে ও ন্যূনতম ব্যায়ে তোমার দেওয়া কার্য সম্পন্ন করছে কিনা তা তত্ত্বাবধান করা হল বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনা।"

ওয়াই কে. ভূষণ (Y K Bhasan) এর মতে “শিল্প ব্যবস্থাপনার নানারকম সমস্যা সমাধানের জন্য বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের ভিত্তিতে প্রাপ্ত নীতিসমূহের অবলম্বন ও প্রয়োগকে বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনা বলা হয়।"

সাধারণভাবে একে সংজ্ঞায়িত করা যায় নিম্নরূপে

বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনা হল চিন্তার একটি ধারা বা মনোভাব যা বৈজ্ঞানিক গবেষণা, পর্যবেক্ষণ, বিশ্লেষণ ও অনুসন্ধানের দ্বারা আবিষ্কৃত বিভিন্ন পদ্ধতি এবং কর্মনীতি ব্যবস্থাপনায় প্রয়োগ করার চেষ্টা করে।

আর সহজ কথায় বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে ব্যবস্থাপনার কাজ-কর্ম সম্পাদনের পদ্ধতিকে বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনা বলে (scientific management)।
বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনা কাকে বলে

বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনার উদ্দেশ্য :-

বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রবর্তনের পরে কার্য সম্পাদন প্রক্রিয়ার পরিবর্তন ঘটেছে। এর ফলশ্রুতিতে কারবার প্রতিষ্ঠানে উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে বহুগুণে। আর সার্বিক এ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনার উদ্ভাবন ঘটেছিল। বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনার উদ্দেশ্যসমূহ ছিল:

১. কারবার প্রতিষ্ঠানে উৎপাদনশীলতার পরিমাণ সর্বাধিক করা।

২. উৎপাদন কার্যে অল্পব্যয় এবং অপচয় নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের সর্বাধিক উন্নতি ত্বরান্বিত করা।

৩. প্রতিষ্ঠানে যাতে চিরাচরিত পদ্ধতির পরিবর্তে ভবিষ্যতে সর্বদাই আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের প্রবণতা এবং আগ্রহ সৃষ্টি হয় সে ব্যবস্থা করা।

8. কার্য সম্পাদন দক্ষতা তথা উৎপাদনশীলতার ওপর ভিত্তি করে শ্রম বিভাজন করা।

৫. ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে শ্রমিকদের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি এবং সৌহার্দ্যপূর্ণ শ্রমিক-মালিক সম্পর্ক সৃষ্টি করা।

৬. ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি কর্মীর কর্মক্ষমতার সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করা এবং সে সঙ্গে তাদের প্রত্যেকের দক্ষতা ও সম্ভাবনার উন্নয়ন সাধন করা।


বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনার ৪ টি নীতি কি কি:-


যে সকল অবস্থার উপর বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনার সাফল্য নির্ভরশীল, সেই সব অবস্থাকে বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনার নীতি বা উপাদান বলা হয়। বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনার নীতি বা উপাদানগুলিকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়।

(ক) মানবিক দিক (human aspects) এবং
(খ) অমানবিক (non-human aspects)।

(ক) মানবিক দিক :-

বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে শ্রমিক নির্বাচন (Selection of workers on scientific basis) :-

উৎপাদনের একটি অপরিহার্য উপাদান হল শ্রমিক। শ্রমিক নিয়োগ ব্যবস্থাপনার অতি গুরুত্বপূর্ণ কার্য। প্রতিষ্ঠানে উপযুক্ত শ্রমিক নিয়োগ করার আগে তার মানসিক ও শারীরিক দক্ষতা বিচার করা একান্ত প্রয়োজন। কারণ দক্ষ ও যোগ্য শ্রমিক নির্বাচন ও নিয়োগের উপর প্রতিষ্ঠানের সাফল্য নির্ভরশীল।

শ্রমিক সংস্থাপন ( Placement of workers ) :-

যোগ্য শ্রমিককে যোগ্য কার্যে নিয়োগ করাকেই (right man in the right place) শ্রমিক সংস্থাপন বলা হয়। প্রতিষ্ঠানে প্রতিটি কার্যের প্রকৃতি ও দায়িত্ব সঠিকভাবে বিবেচনা করে কার্য উপযোগী শ্রমিক নিয়োগ করতে হবে। শ্রমিক নিয়োগের ক্ষেত্রে শ্রমিকের যোগ্যতা, দক্ষতা ও বিশেষজ্ঞতা বিবেচনা করা দরকার। শ্রমিক নিয়োগের পর নির্দিষ্ট কার্যের জন্য উপযুক্ত শ্রমিক সংস্থাপন ব্যবস্থাপনার একটি গুরুদায়িত্ব।

শ্রমিক প্রশিক্ষণ (Training of workers ) :-

কার্যের প্রতি শ্রমিকের আগ্রহ বা নিষ্ঠা থাকলেও কার্যের গুণগত মান ও দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন প্রশিক্ষণের। প্রযুক্তিবিদ্যার উন্নতির ফলে উৎপাদন পদ্ধতিতে নিত্যনতুন পরিবর্তন হচ্ছে। এই পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে শ্রমিকদের নতুন পদ্ধতি সম্পর্কে অবহিত করার জন্য উপযুক্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা একান্ত প্রয়োজন। বিজ্ঞানসম্মত প্রশিক্ষণ শ্রমিকদের মান উন্নয়নে এবং নির্দিষ্ট মানানুসারে নিজ নিজ কার্যসম্পাদনে সাহায্য করে।

বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে কার্য বিশ্লেষণ (Analysis of work on scientific principles) :-

গতানুগতিক প্রথার বদলে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে কার্য বিশ্লেষণ করে কোনও নির্দিষ্ট কার্যের আঙ্গিক উপাদানগুলি চেনা যায় এবং তাদের প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্যগুলি বোঝা যায়। এর ফলে বিজ্ঞান ভিত্তিক কার্যবণ্টন সম্ভব হয়। সময় ও শ্রমের অপচয় বন্ধ করা যায়। এজন্য প্রয়োজন তিন ধরনের সমীক্ষার। যেমন (ক) সময় সমীক্ষা (time study) (খ) গতি সমীক্ষা (motion study) (1) ক্লান্তি সমীক্ষা (fatigue study)।

প্রেরণামূলক মজুরি ব্যবস্থা (Incentive wage system) :-

দক্ষতার সঙ্গে বেশি কার্য সম্পাদন করলে যাতে শ্রমিক বেশি মজুরি পায় সেই ব্যবস্থা করাই হল প্রেরণামূলক মজুরি ব্যবস্থা। টেলরের মতে, যে সব শ্রমিক মান সময়ের (standard time) মধ্যে মান-উৎপাদন (standard output) করতে পারে তাকে উচ্চহারে মজুরি দিতে হবে এবং যারা মান-সময়ের মধ্যে মান-উৎপাদন করতে পারে না, তাদের কম হারে মজুরি দিতে হবে। টেলরের এই মজুরি প্রদান ব্যবস্থাকে পার্থক্যমূলক কার্যহার পদ্ধতি (differential piece rate system) বলা হয়। এতে দক্ষ শ্রমিকদের কর্মপ্রেরণা বৃদ্ধি পায়।

কার্যভিত্তিক কর্মনায়ক নিয়োগ (Appointment of functional bosses) :-

শ্রমিকদের কার্যাবলি তদারকির জন্য কয়েকটি নিপুণ ও বিশেষায়িত তদারক বিভাগ গঠন করা হয় এবং ঐ বিভাগগুলিতে একজন করে কর্মনায়ক নিয়োগ করা হয়। টেলর আট রকমের কার্যভিত্তিক কর্মনায়ক নিয়োগের প্রস্তাব দেন।

যেমন, গ্যাং বস (Gang Boss), স্পিড বস (Speed Boss), রিপেয়ার বস (Repair Boss). পরিদর্শক (Inspector), কারখানার শৃঙ্খলা রক্ষাকারি করণিক (Shop disciplinarian), রুট করণিক (Route clerk), নির্দেশ রচনাকারী কার্ড করণিক (Instruction Card Clerk) এবং সময় ও পরিব্যয় করণিক (Time and Cost clerk)।

এই বিশেষজ্ঞ কর্মনায়কদের তার কর্তব্য পালনের জন্য পূর্ণ কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা দেওয়া হয়। তারা নিজ নিজ কার্য বিষয়ে শ্রমিকদের সরাসরি নির্দেশ দিয়ে থাকেন।

শ্রমিক ও ব্যবস্থাপকদের মধ্যে সহযোগিতা ও বন্ধুত্বমূলক সম্পর্ক (Co-operation and friendship between labour and management) :-

উৎপাদনে উৎকর্ষতা ও দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য শ্রমিক ও ব্যবস্থাপকদের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা ও মৈত্রীর সম্পর্ক স্থাপন অত্যন্ত জরুরি। এই সম্পর্ক নির্ভর করে শ্রমিকদের অভাব-অভিযোগ প্রভৃতি দিকে দৃষ্টি দেওয়া, শ্রমিকদের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া, তাদের আদেশ পালনকারী যন্ত্র হিসাবে গণ্য না করা এবং তাদের মঙ্গল সাধন করা বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনার অঙ্গ।

(খ) অমানবিক দিক :-

১. কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা ও কার্যের বৈজ্ঞানিক বণ্টন (Central planning and scientific allotment of task) :-

প্রতিষ্ঠানে উৎপাদনের জন্য একটি পৃথক কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা বিভাগ থাকবে। কী কাজ, কীভাবে করা হবে, কখন করা হবে, কোথায় করা হবে এবং কে করবে প্রভৃতি বিষয় নির্দিষ্ট করে তা পরিকল্পনা বিভাগ ঠিক করবে। শ্রমিকদের শিক্ষা, দক্ষতা ও বিশেষজ্ঞতা বিবেচনা করে তাদের বিজ্ঞানসম্মতভাবে কার্যবণ্টন করতে হবে যাতে কার্য ও শ্রমিকের মধ্যে সমন্বয় সাধিত হয়।

২. কারখানার স্থান নির্বাচন ও পরিবেশ (Selection of factory location and environment) :-

উপযুক্ত স্থানে কারখানার স্থান নির্বাচন করা দরকার। এতে ব্যয় সংকোচ করা যায়। কারখানার অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক পরিবেশ শ্রমিকদের স্বাস্থ্য ও কর্মদক্ষতা বৃদ্ধিতে সহায়ক হতে হবে। শ্রমিকদের জন্য সুলভ ক্যান্টিন, বিশ্রামাগার, শৌচাগার, পানীয় জল প্রভৃতির ব্যবস্থা থাকা একান্ত প্রয়োজন। বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনার নীতি হল এসব বিষয়ের দিকে দৃষ্টি দেওয়া।

৩. প্রমিতকরণ (Standardisation) :-

কার্য সম্পাদনের উপযুক্ত বিভিন্ন উপাদানগুলি নির্দিষ্ট মানের হতে হবে। তাতে শ্রমিকদের কার্যের গুণগত মান বৃদ্ধি পায়। যন্ত্রপাতি ও সাজ-সরঞ্জাম, কাঁচামাল প্রভৃতি নির্দিষ্ট মানের ও যথাযথ হওয়া চাই। বিজ্ঞানসম্মত পরীক্ষা-নিরীক্ষার দ্বারা বিভিন্ন উপকরণের মান স্থির করতে হবে।

যেমন—যন্ত্রপাতি ও সাজসরঞ্জাম (machines and tools) = পুরোনো যন্ত্রপাতির পরিবর্তে সর্বাধুনিক ও নির্দিষ্ট মানের যন্ত্রপাতি ব্যবহারের কথা বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনায় বলা হয়েছে। কারণ তার ফলে উৎপাদনের পরিমাণ ও উৎকর্ষতা বৃদ্ধি পায়, ব্যয়ও হ্রাস পায়। কাঁচামাল উৎপাদনের জন্য উপযুক্ত মানের কাঁচামাল প্রয়োজন। উপযুক্ত কাঁচামাল ছাড়া উৎপাদনের গুণগত মান বজায় রাখা অপচয় রোধ সম্ভব নয়।


বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনার সুবিধাসমূহ :-

বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনার নীতিগুলি অনুসৃত হবার ফলে যে সব সুবিধা পাওয়া যায় সেগুলি নিম্নরূপ :

১. বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনা গতানুগতিক পন্থা ও ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি বর্জন করে। বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে প্রতিটি শ্রমিকের জন্য কার্য ও দায়িত্ব নির্ধারণ করে এবং কার্যের প্রত্যেকটি স্তরে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রবর্তন করে।

২. শ্রমিকদের বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে নির্বাচন ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করার জন্য শ্রমিকদের দক্ষতা, কর্ম নিপুণতা বৃদ্ধি পায়।

৩. যোগ্য ব্যক্তিকে যোগ্য কার্যে নিযুক্ত করার ফলে উৎপাদিকা শক্তি বৃদ্ধি পায়।

৪. এই ব্যবস্থাপনায় ব্যক্তিগতভাবে সকল শ্রমিকের এবং সামগ্রিকভাবে শিল্পের দক্ষতা ও উৎপাদন বৃদ্ধি পায়।

৫. গবেষণা ও সতর্ক পর্যবেক্ষণ ও নিরীক্ষণের ফলে উৎপাদিত দ্রব্যের উৎকর্ষতা বৃদ্ধি পায় ও উৎপাদন ব্যয় হ্রাস পায় ফলে সুলভমুল্যে উন্নতমানের দ্রব্য সামগ্রী ক্রেতাদের সরবরাহ করা সম্ভব হয়

৬. বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনার প্রয়োগের ফলে শ্রমিকদের ও ব্যবস্থাপকদের দৃষ্টিভঙ্গি ও চিন্তাধারার আমুল পরিবর্তন হয়। উভয়পক্ষের মধ্যে সক্রিয় সহযোগিতা ও সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপিত হয়। রক্ষণশীল মনোভাবের পরিবর্তে প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গির প্রসার ঘটে।

৭. প্রেরণামূলক মজুরি ব্যবস্থার প্রবর্তন করে দক্ষ শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি পায়। ফলে তারা কার্যে উৎসাহিত হয়।

৮. সময় সমীক্ষা, গতি সমীক্ষা ও ক্লান্তি সমীক্ষার দরুন শ্রমিকদের অপ্রয়োজনীয় দৈহিক ও মানসিক পরিশ্রম কমে। তারা স্বল্প সময়ে অধিক হারে উৎপাদন করতে সক্ষম হয়।

৯. গবেষণা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলে সর্বাধুনিক যন্ত্রপাতি ও কলাকৌশল প্রয়োগ করা সম্ভব হয়।

১০. অধিক মজুরি পাওয়ার ফলে শ্রমিকদের জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়।

বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনার অসুবিধাসমূহ :-

শিল্পজগতে বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনার দর্শন যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছে। প্রথমদিকে বহু শিল্পপতি বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনার দর্শনে মুগ্ধ হন এবং এর প্রয়োগে উৎসাহী ও যত্নশীল হন। কিন্তু এই নীতির পরস্পর বিরোধিতা সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়। বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনার অসুবিধা নিম্নলিখিত ভাবে সমালোচনা করা হয়।

১. বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনার কার্যক্রম অনুসরণ করতে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন। সুতরাং এই ব্যয়বহুল পদ্ধতির প্রয়োগ ক্ষুদ্র বা মাঝারি শিল্পের পক্ষে সম্ভব নয়।

২. বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনাকে উৎপাদন সংক্রান্ত কার্যাবলির ব্যবস্থাপনাতে সীমাবদ্ধ থাকতে দেখা যায়। প্রতিষ্ঠানের সার্বিক ব্যবস্থাপনা অর্থাৎ বিপণন ব্যবস্থাপনা, প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা, আর্থিক ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি এই নীতিতে উপেক্ষিত।

৩. প্রেরণামূলক মজুরি ব্যবস্থায় শ্রমিকদের মজুরির তারতম্য ঘটে। ফলে শ্রমিকের মধ্যে ঈর্ষা ও অসন্তোষ সৃষ্টি হয়।

৪. ইহাতে অবিরাম পরীক্ষা-নিরীক্ষা, নতুন যন্ত্রপাতি প্রবর্তন ও গবেষণার দ্বারা নতুন পদ্ধতি ও কৌশল উৎপাদনে প্রয়োগ করা হয়। ঘন ঘন উৎপাদন প্রক্রিয়ার পরিবর্তনের ফলে উৎপাদনের ধারাবাহিকতা ব্যাহত হয় এবং শিল্পে বিশৃঙ্খলা দেখা যায়।

৫. এই ব্যবস্থাপনায় যে কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা বিভাগ থাকে তাতে শ্রমিকদের মতামত প্রকাশের অবকাশ থাকে না। ইহা শ্রমিক কল্যাণব্যবস্থার পরিপন্থী ও অগণতান্ত্রিক।

৬.  বিশেষায়নের জন্য কার্যের বৈচিত্র্য থাকে না। শ্রমিকরা একঘেয়েমির শিকার হয়। এতে শ্রমিকদের উৎসাহ ও উদ্দীপনা নষ্ট হয়।

৭. একদিকে কার্যভিত্তিক কর্মনায়কর ব্যবস্থার প্রয়োগ ও অন্যদিকে পরিকল্পনা রচনা থেকে ইহার পৃথকীকরণ অবাস্তব বলে পরিগণিত হয়েছে। এদের মধ্যে সম্পূর্ণ পৃথকীকরণ সম্ভব নয়। আটজন কর্মনায়ক নিয়োগের ফলে বহু ক্ষেত্রেই শ্রমিকদের মধ্যে পরস্পর বিরোধী মনোভাব সৃষ্টি হয়।

৮. উন্নত যন্ত্রপাতি ও কলাকৌশল উৎপাদনে ব্যবহৃত হওয়ার ফলে উৎপাদিকা শক্তি বৃদ্ধি পেলেও ধীরে ধীরে শ্রমিকের প্রয়োজন কমতে থাকে। ফলে বেকারত্ব বৃদ্ধি পায়।

৯. এরূপ ব্যবস্থাপনায় কার্যের গতিবেগ বৃদ্ধি পাওয়ায় শ্রমিকের শরীর ও মনের উপর অতিরিক্ত চাপ পড়ে। এজন্য শ্রমিকগণ ও শ্রমিক সংঘ এই ব্যবস্থায় বিশেষ আগ্রহী নয়।

১০. এই ব্যবস্থাপনায় অনুমান করা হয়েছে যে মানুষ স্বভাবতই কর্মবিমুখ, ফাঁকিবাজ, লোভী ও পরশ্রীকাতর। তদারকি (supervision) ছাড়া কোনও শ্রমিককে দিয়ে কার্য সম্পাদন সম্ভব নয়। মানব-চরিত্র সম্পর্কে এই ধারণা ভ্রান্ত এবং হতাশাব্যঞ্জক। সমালোচকদের মতে এই অনুমানের উপর ভিত্তি করে যে নীতিগুলি স্থির করা হয়েছে সেগুলি ভুল পথনির্দেশ করতে বাধ্য।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ