সমবায় সমিতির বৈশিষ্ট্য, গুরুত্ব ও উদ্দেশ্য?

সমবায় সমিতির বৈশিষ্ট্য :-

অন্য যে কোনোরূপ ব্যবসায় সংগঠন হতে সমবায় সমিতি সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী সংগঠন। সমবায় সমিতি কতগুলো বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। এ বৈশিষ্ট্যগুলো নিম্নরূপ:

১. আত্মরক্ষার মাধ্যম :-

ধনতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় ধনীদের দ্বারা দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত শ্রেণি অর্থনৈতিক নিষ্পেষণের শিকার হয়। সমবায় শোষক শ্রেণির হাত হতে শোষিতদের আত্মরক্ষার মাধ্যম হিসেবে কাজ করে।

২. স্বেচ্ছাকৃত সংঘবদ্ধতা :-

শুধুমাত্র স্বেচ্ছাকৃতভাবে কতিপয় ব্যক্তি সমবায়ের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে এ ধরনের প্রতিষ্ঠান গঠন করে, কোনো রকম বাধ্যবাধকতার স্থান এখানে নেই।

৩. গঠন প্রণালি :-

দরিদ্র ও মধ্যত্তি শ্রেণির কতিপয় লোক স্বেচ্ছায় মিলিত হয়ে কোনো বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য এরূপ সংগঠন করতে পারে। সমবায় আইন অনুসারে নিবন্ধকের নিকট এ ধরনের সমবায় প্রতিষ্ঠান নিবন্ধন করতে হয়।

৪. সদস্যপদ :-

সমস্বার্থ বিশিষ্ট প্রত্যেক লোকের জন্যই এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের সদস্যপদ খোলা। অর্থাৎ সমঅর্থনৈতিক চরিত্র এবং একই বিষয়ে সমরূপ স্বার্থ সংশ্লিষ্ট যে কোনো ব্যক্তিই সমবায়ের সদস্য হতে পারে।
সমবায় সমিতির বৈশিষ্ট্য, গুরুত্ব ও উদ্দেশ্য

৫. উদ্দেশ্য :-

ব্যবসায়ের কোনো বিশেষ অংশে অর্থাৎ উৎপাদন, বণ্টন ইত্যাদিতে জড়িত হয়ে সম্মিলিতভাবে কার্য পরিচালনার মাধ্যমে সদস্যদের কল্যাণ সাধনই এরূপ প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য। মুনাফা অর্জন এর মূল উদ্দেশ্য নয়।

৬. দায়দায়িত্ব :-

যৌথ মূলধনী ব্যবসায়ের মতো সদস্যদের দায়দায়িত্ব তাদের ক্রয়কৃত শেয়ারের মূল্য দ্বারা সীমাবদ্ধ।

৭. মূলধনের উৎস :-

সমবায় সমিতির মূলধনের কোনো সীমারেখা নেই। তবে যে পরিমাণ মূলধন নিয়ে সমবায় নিবন্ধিত হয় তার বেশি শেয়ার বিক্রয় করার অধিকার সমবায়ের নেই। কোনো সদস্যই সর্বোচ্চ ৫,০০০ টাকা বা মোট মূলধনের ১/১০ অংশের বেশি মূল্যের শেয়ার কিনতে পারে না।

৮. সদস্যদের পদমর্যাদা :-

সমবায়ে সদস্যদের পদমর্যাদা সমান থাকে। পারস্পরিক হৃদ্যতা, একতা ও সমঅধিকারের ভিত্তিতেই এরূপ প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। সুতরাং শেয়ারের পরিমাণ যাই থাকুক না কেন সকলের পদমর্যাদা সমান।

৯. শেয়ারের মূল্য :-

সমবায় সমিতি প্রতিটি শেয়ারের মূল্য ১০ টাকা বা তদুর্ধ্ব মূল্যের হতে পারে।

১০. আইনগত মর্যাদা :-

সমবায় আইন অনুসারে প্রতিষ্ঠিত হয় বলে সমবায় সমিতির আইনগত মর্যাদা আছে। এটি পৃথক ব্যক্তিসত্তার অধিকারী এবং নিজ নামে মামলা দায়ের করতে পারে।

১১. শেয়ারের হস্তান্তরযোগ্যতা :-

সমবায় সমিতির শেয়ার হস্তান্তরযোগ্য নয়। তবে শেয়ার সমিতিতে ফেরত দিয়ে মূলধন উঠিয়ে নেয়া চলে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অবশ্য সমিতির পূর্বানুমতি নিয়ে শেয়ার হস্তান্তর করাও চলে।


১২. সদস্য সংখ্যা :-

সমবায় অধ্যাদেশ অনুযায়ী সমবায় সমিতি গঠন করতে হলে কমপক্ষে ১০ জন সদস্য প্রয়োজন। এর কোনো ঊর্ধ্বসীমা নেই।

১৩. নিবন্ধন :-

সমবায় আইনানুসারে সমবায় সমিতি অবশ্যই নিবন্ধিত হতে হয়।

১৪. সরকারি নিয়ন্ত্রণ :-

আইন সৃষ্ট প্রতিষ্ঠান বলে এর যাবতীয় কার্যক্রমের ওপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ থাকে।

১৫. মুনাফা বণ্টন :-

সমবায় কর্তৃক অর্জিত মোট মুনাফার এক-চতুর্থাংশ সঞ্চিতি তহবিলে রেখে বাকি অংশ বণ্টন করা চলে।

১৬. স্থায়িত্ব :-

আইনের দ্বারা স্থাপিত ও কৃত্রিম ব্যক্তিসত্তা সম্পন্ন বলে এরূপ সংগঠনের স্থায়িত্ব চিরন্তন।

১৭. গণতান্ত্রিক পরিচালনা :-

সদস্যদের বার্ষিক সভায় প্রত্যক্ষ ভোট এ নির্বাচিত পরিচালকগণই সমিতি পরিচালনা করেন। এরূপ পরিচালনার ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক পদ্ধতি অনুসৃত হয়ে থাকে।

১৮. কার্যের পরিধি :-

সমবায়ের পরিধি অত্যন্ত ছোটো হয়ে থাকে। সমমনা এবং সমস্বার্থ বিশিষ্ট ব্যক্তিকে জাতীয় ভিত্তিতে। একত্রীকরণ সম্ভব নয় বলেই স্থানীয় পর্যায়ে সমবায় সমিতি গঠিত হয়।

১৯. নিরীক্ষণ :-

প্রতিবছর অন্তত একবার সমবায়ের হিসাবপত্র সরকারি নিরীক্ষকছারা নিরীক্ষা করাতে হয়।।

২০. পারস্পরিক অভিন্নতার পাঠশালা :-

সমবায় সমিতির প্রত্যেক সদস্যই সম্মিলিত স্বার্থ রক্ষার্থে কাজ করে যায়। আর এর পরে তাদের মধ্যে এক অভিন্নতার সম্পর্ক গড়ে ওঠে যা তারা সবটুকু উপলব্ধি বা চেতনা দিয়ে অনুভব করে এবং শিখে।

উল্লিখিত বৈশিষ্ট্যগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, সমবায় সমিতি পৃথক ব্যক্তিসত্তা বিশিষ্ট এবং গণতান্ত্রিক রীতি পদ্ধতি অনুসরণে পরিচালিত একটি আইনসৃষ্ট স্বেচ্ছাকৃত সংগঠন, যার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে সদস্যদের অর্থনৈতিক কল্যাণ নিশ্চিত করা। এ বৈশিষ্ট্যগুলো সমবায় সমিতিকে ব্যবসায়িক ভূবনে এক স্বতন্ত্র অস্তিত্ব প্রদান করেছে।


সমবায় সমিতির উদ্দেশ্য :-

সমবায় সমিতি সমাজের নিম্নশ্রেণি যেমন- কামার, কুমার, তাঁতী, জেলে ও দরিদ্র কৃষিজীবির আর্থিক ও বৈষয়িক কল্যাণার্থে সৃষ্ট সংগঠন। সমাজের নিম্ন আয়ের লোকজন তাদের ঐক্যবদ্ধ প্রচষ্টার মাধ্যমে ধনিক শ্রেণির শোষণ ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষায় সচেষ্ট হয় এ সমবায়ের মাধ্যমে। সমবায় সংগঠনের এ কল্যাণধর্মী উদ্দেশ্যসমূহ নিম্নে আলোচিত হলো:

১. সদস্যদের অর্থনৈতিক কল্যাণ সাধন :-

সমবায় সমিতির প্রধানতম লক্ষ্য হচ্ছে এর সদস্যদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন। শ্রমিক শ্রেণি ও দরিদ্র জনগোষ্ঠী নিজেদের অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে উৎপাদন, ক্রয়, বিক্রয়, ঋণদান প্রভৃতি কার্যে জড়িত বিভিন্ন প্রকার সমবায় সমমিতির সাথে সম্পৃক্ত হয়ে আর্থিক স্বচ্ছলতা আনয়নে সচেষ্ট হয়।

২. মধ্যস্বত্বভোগীদের উচ্ছেদ :-

মধ্যস্থ ব্যবসায়ী, পুঁজিপতি ও মহাজন শ্রেণির হাত থেকে সমাজের নিম্নবিত্ত দরিদ্র শ্রেণির লোকদের রক্ষা করা সমবায়ের আরও একটি বিশেষ উদ্দেশ্য। ক্রয় সমবায় বিক্রয় সমবায় উৎপাদক সমবায় ইত্যাদির মাধ্যমে এদের প্রভাবমুক্ত হওয়া সম্ভব হয়।

৩. মূলধনের যোগান :-

সমবায় সমিতি বহুলোকের পুঁজিকে একত্রিত করে বড় আকারের মূলধনের যোগান দেয়। এককভাবে পুঁজির সংস্থান করে, বৃহৎ সংগঠনের সাথে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হওয়া অসম্ভব। কিন্তু সংগঠিত উপায়ে তথা সমবায়ের মাধ্যমে অধিক মূলধন নিয়ে ব্যবসায় জগতে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা সহজ হয়।

8. কর্মসংস্থান :-

অশিক্ষিত ও অর্ধশিক্ষিত এমনকি শিক্ষিত বেকার যুবকদের কর্মের সংস্থান করা সমবায়ের আরেক উদ্দেশ্য । কৃষি, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প ইত্যাদি বহুবিধ ক্ষেত্রে বেকার যুবকদের কর্মসংস্থান হয় এ সমবায়ের মাধ্যমেই।

৫. সম্পদের সুষম বণ্টন :-

সমবায় সমিতি সমাজের উচ্চশ্রেণি ও নিম্নশ্রেণির মধ্যে ধনবৈষম্য দূর করতে সহায়তা করে। সকল শ্রেণির মধ্যে সম্পদের সুষম বণ্টনের মাধ্যমে অর্থনৈতিক সমতা রক্ষার প্রচেষ্টাই সমবায়ের উদ্দেশ্য।

৬. জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন :-

সমবায় সমিতি সদস্যদের আর্থিক নিরাপত্তা দেয়। এতে ব্যক্তি ও রাষ্ট্র আর্থিকভাবে লাভবান হয়। সদস্যরা ন্যায্য মূল্যে উত্তম পণ্য ও সেবা পেয়ে থাকে। ফলে সামগ্রিকভাবে সদস্য ও অন্যান্যদের জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়।

৭. আত্মনির্ভরশীলতা অর্জন :-

সমবায়ীদের স্বনির্ভর করে তোলা সমবায়ের আরও একটি উদ্দেশ্য। ছোটোবড় বিভিন্ন কাজে নিজেদের সম্পৃক্ত করে সদস্যরা সমবায়ের মাধ্যমে আত্মনির্ভরশীলতা অর্জনে সক্ষম হয়।

৮. ঐক্য প্রতিষ্ঠা :-

অর্থাৎ ঐক্যই শক্তি- এ মূলমন্ত্রে বিশ্বাসী হয়ে ঐক্য প্রতিষ্ঠা সমবায়ের অপর এক উদ্দেশ্য। সমাজের বঞ্চিত ও নিগৃহীত শ্রেণিকে সমবায় ঐক্যের পথে ধাবিত করে।

৯. নেতৃত্ব সৃষ্টি :-

সমবায় তৃণমূলে নেতৃত্ব সৃষ্টিতে সহায়তা করে। কেননা সমবায় সমিতি সদস্যদের নির্বাচিত প্রতিনিধির দ্বারা পরিচালিত হয়। প্রতিনিধিরা বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কার্যক্রমেও অংশ নিয়ে দক্ষতা অর্জন ও নেতৃত্বের বিকাশ ঘটাতে পারে।


১০. সামাজিক কল্যাণ :-

সদস্যদের স্বার্থ রক্ষাই সমবায়ের একমাত্র উদ্দেশ্য নয়। সমবায় সমিতি সামাজিক কল্যাণ সাধনের লক্ষ্যেও প্রতিষ্ঠিত হয়। স্কুল-কলেজ, রাস্তা-ঘাট, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, ত্রাণ ও পুনবার্সন কার্য ইত্যাদির মাধ্যমে সমবায় সামাজিক উন্নয়নমূলক কাজে অংশ নেয়।

১১. সংঘবদ্ধ করা :-

সমবায় সমিতির অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে কতিপয় সমশ্রেণিভূক্ত ও সমমানসিকতা সম্পন্ন ব্যক্তিদের সংঘবদ্ধ করে তোলা। একক প্রচেষ্টায় সম্ভব নয় বিধায় সমবায়ের মাধ্যমে কতিপয় লোক নিজেদের ভাগ্যোন্নয়নে সংঘবদ্ধ হয়।

১২. দক্ষতার উন্নয়ন :-

সমবায় সমিতির মাধ্যমে সদস্যদের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। এছাড়া সদস্যগণ সমিতি কর্তৃক গৃহীত বাস্তবভিত্তিক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের সাথে যুক্ত হয় বিধায় বাস্তবশিক্ষা লাভেও সমর্থ হয়।

১৩. বৃহদায়তন ক্রয় সুবিধা :-

স্বল্প আয়ের জনগণ তাদের প্রয়োজনীয় পণ্যদ্রব্য সহজ শর্তে ও ন্যায্য ক্রয় সমবায় সমিতি গঠন করে। ফলে তারা অধিক পরিমাণ পণ্য তুলনামূলক কম মূল্যে ক্রয় করার সুবিধা পেয়ে থাকে।

১৪. প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা :-

স্বল্প মূলধনের উৎপাদকগণ তাদের উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ কার্য সম্পাদন করতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রেই প্রবল প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হয়ে থাকে। ফলে তারা নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লক্ষ্যে সমবায় গঠন করে।

১৫. সঞ্চয়ের প্রবণতা সৃষ্টি :-

সদস্যদের মধ্যে সঞ্চয়ের প্রবণতা সৃষ্টি করা সমবায়ের অন্যতম আরেকটি উদ্দেশ্য। সদস্যদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পুঁজি একত্রিত করে বৃহৎ পুঁজি সৃষ্টি করা হয়। এতে তাদের সঞ্চয়ের প্রবণতা বাড়ে।

বাস্তবে সমবায় সমিতি সমাজের নিম্ন আয় শ্রেণির ভাগ্য উন্নয়নের লক্ষ্যেই প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে ঐক্যই শক্তি’, ‘একতাই বল' এমন আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে ব্যক্তি, সমাজ এবং জাতীয় উন্নয়নের লক্ষ্যেও সমবায় সমিতি গঠিত হয়ে থাকে।

সমবায় সমিতির গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা :-

ধনতান্ত্রিক অর্থনীতির চাকায় পিষ্ট দরিদ্র শ্রেণি নিজেদের স্বার্থ রক্ষার জন্য অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি ঐক্যবদ্ধ চেষ্টার মাধ্যমে সমবায়ের চিন্তাধারার জন্ম দেয়। সমবায়ের মূল লক্ষ্য ছিল নিম্নবিত্ত শ্রেণির জনগণের অর্থনৈতিক কল্যাণ। বর্তমানে যে কোনো অর্থনীতিতে বিশেষ করে বাংলাদেশের ন্যায় তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল অর্থনীতির জন্য এরূপ গোষ্ঠীবদ্ধ প্রচেষ্টার গুরুত্ব অসীম। নিম্নে সমবায় সমিতির গুরুত্ব আলোচিত হলো:

১. ঐক্য সৃষ্টি :-

'Unity is strength এ শ্লোগানই সমবায়ের মূলমন্ত্র। যেখানে একক ও বিচ্ছিন্ন প্রচেষ্টায় বৃহৎকার্য সম্পাদন করা যায় না সেখানে সমবায় ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার শিক্ষা দেয়। দুর্বল ও শোষিত শ্রেণি সমবায়ের মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ হয়ে বৃহৎ কোনো অর্জনের পথকে প্রশস্ত করতে সক্ষম হয়।

২. অর্থনৈতিক উন্নয়ন :-

নিম্ন আয়ের লোকজন কৃষি, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প, মৎস চাষ ও খামার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তাদের আর্থিক কল্যাণ সাধনে ব্যাপৃত হয়। এতে ব্যক্তি, সমাজ ও জাতি অর্থনৈতিকভাবে উপকৃত হয়।

৩. মূলধন গঠন :-

সমবায় সমিতি বিশ্বের যে কোনো দেশের সামগ্রিক মূলধন গঠনে সহায়তা করে। কেননা এতে সদস্যদের ক্ষুদ্র আমানত একত্রিত হয় এবং তা বিনিয়োজিত হয়ে থাকে। এটি সদসদের সঞ্চয়ী মনোভাব গড়ে তোলার পাশাপাশি সমাজের অন্যান্যদেরও সঞ্চয়ী হতে উদ্বুদ্ধ করে। সমবায় দেশের অভ্যন্তরীণ মূলধন গঠনে গুরুত্বপূর্ণ উৎস হিসেবে কাজ করে।

8. কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি :-

সমবায় সমাজের নিম্নবিত্ত শিক্ষিত, অশিক্ষিত বেকার জনগোষ্ঠীর কর্মের সংস্থান করে। কারণ সমবায় তাদের কর্মের যোগান দেয় এবং এর মাধ্যমে সমবায়ীরা আত্ম-কর্মসংস্থানের পথ খুঁজে পায়।

৫. বৈষম্য হ্রাস :-

সমবায় সম্পদের সুষ্ঠু বণ্টনের সাহায্য করে। পুঁজিপতি শ্রেণির হাতে পুঞ্জিভূত না হয়ে সমবায় সমাজের সকল শ্রেণির মধ্যে অর্থের সুষম বণ্টনের পথকে উন্মুক্ত করে। এতে ধন বৈষম্য হ্রাস পায়।

৬. মধ্যস্থব্যবসায়ীদের উচ্ছেদ :-

সমবায় সমিতির সদস্যরাই পণ্য উৎপাদন করে এবং এগুলো বিক্রয়ের কাজও তাদের দ্বারাই সম্পাদিত হয়। ফলে সদস্য ও অন্যান্য শ্রেণি ন্যায্য মূল্যে পণ্য সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়। ফলশ্রুতিতে মধ্যস্থব্যবসায়ী তাদের ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য হাসিলে ব্যর্থ হয় এবং এতে তাদের উচ্ছেদ ত্বরান্বিত হয়।

৭. দারিদ্র্য দূরীকরণ :-

সমবায় সমিতি সাধারণত নিম্নবিত্ত ও সমাজের অবহেলিত জনগোষ্ঠীর কল্যাণধর্মী সংগঠন। সমাজের অনুন্নত শ্রেণির অধিক সংখ্যক ব্যক্তি সমবায়ের মাধ্যমে তাদের পুঁজি একত্রিত করে যে মুনাফা অর্জন করে তা নিজেদের মধ্যে বণ্টিত হয়। ফলে এটি তাদের দারিদ্র্য দূর করে আর্থিক সচ্ছলতা আনয়নের একটি বাহন হিসেবে কাজ করে।

৮. নৈতিকতার উন্নয়ন :-

মানুষের নৈতিকতা চরম অবক্ষয়ের সম্মুখীন। সততা, সহযোগিতা, একতা, সমাজসেবা ইত্যাদি আজকের দিনে হারিয়ে যেতে বসেছে। সমবায় শৃংখলা ও মৈত্রীর বন্ধনে আবদ্ধ হবার শিক্ষা দিয়ে নৈতিক চরিত্রের উন্নয়নে মাধ্যমে এ ক্ষয়িষ্ণু সমাজে আশার আলো জ্বালায়।

৯. কর্মস্পৃহা জাগ্রতকরণ :-

সমাজের স্বল্প আয়ের দুর্বল মানসিকতা সম্পন্ন ও উদ্যমহীন লোকদের মধ্যে সমবায় কর্মস্পৃহা জাগিয়ে তুলতে পারে। কেননা সমবায় বিমুখ ও অসচ্ছল লোকদের কর্মমুখী ও সচ্ছলতা আনয়নের লক্ষ্যে সুসংগঠিত করে তোলার সংগঠন।

১০. একচেটিয়া ব্যবসায় রোধ :-

বিত্তশালী ও পুঁজিপতি শ্রেণির ব্যবসায়ীদের প্রতিরোধ করার ক্ষেত্রে সমবায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। কেননা সমবায় ক্ষুদ্র পুঁজির ব্যবসায়ীদের সুসংগঠিত করে ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করতে সক্ষম।

১১. জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন :-

অধিক সংখ্যক সমবায় সমিতি প্রতিষ্ঠার ফলে ব্যক্তি, সমাজ ও জাতির অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটে, সমাজের সকলের দৃষ্টিভঙ্গি ও রুচির পরিবর্তন হয়। এতে তাদের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ে এবং জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়।

১২. কৃষি, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের উন্নয়ন :-

দেশের কামার, কুমার, জেলে, তাঁতি, দরিদ্র কৃষক শ্রেণি এবং ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের মালিকগণ সমবায়ের মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ হয়। এতে তারা সরকারি সহযোগিতায় উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের সুযোগ লাভ করে। ফলে কৃষি এবং শিল্পের উন্নয়ন ও বিকাশ সহজতর হয়।

১৩. বৃহদায়তন ব্যবসায়ের সুযোগ :-

সমবায় সমিতির সদস্যদের স্বল্পপুঁজি, দক্ষতা, মেধা ও শ্রমকে একত্রীভূত করে। ফলে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় বৃহদায়তনে উৎপাদন, ক্রয়বিক্রয় এবং অন্যান্য সুযোগ লাভ করে সামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

১৪. গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা :-

সমবায় গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার পথকে প্রশস্ত করে। দরিদ্র জনগোষ্ঠী যখন অধিকার পুঁজিপতি ও বিষশালী শিল্পপতিদের নিষ্পেষণে পিষ্ট তখনই তারা সমবায়ের মাধ্যমে সমাজে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়।

১৫. সামাজিক উন্নয়ন :-

সমবায় কেবল অর্থনৈতিক উন্নয়নের দিকেই দৃষ্টিপাত করে তা নয়, এটি সামাজিক আন্দোলনেও অংশগ্রহণ করে। সমাজের শিক্ষা-সংস্কৃতির বিকাশে বিভিন্ন পরিকল্পনা ও কার্যসূচি গ্রহণ করে। রাস্তাঘাট নির্মাণ, ত্রাণ ও পুনবার্সন, আবাসিক সমস্যা দূরীকরণ ইত্যাদি নানাবিধ কল্যাণকর কাজে অংশ নিয়ে সমবায় সমিতি সামাজিক উন্নয়ন সাধন করে থাকে।

এছাড়া সমবায় সমিতি দেশের জনগণের দক্ষতা উন্নয়ন ও নেতৃত্বের বিকাশ, নিরক্ষরতা দূরীকরণ, ঋণের সুযোগ সৃষ্টি, মানবীয় গুণাবলির বিকাশ ইত্যাদি বহুবিধ ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত কল্যাণধর্মী কার্যক্রমে অংশগ্রহণকরে সামজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আর এ কারণেই সমবায়ের জয়গান গাওয়া হয় এভাবে- 'সমবায়ই শক্তি, সমবায়ই মুক্তি'।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ