সমবায় সমিতি কাকে বলে? সমবায় সমিতির প্রকারভেদ?

সমবায় সমিতি কাকে :-

সমবায়ের শাব্দিক অর্থ হলো সমিতির উদ্যোগ বা প্রচেষ্টায় কাজ করা। সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা ও চিন্তা থেকেই সমবায়ের উৎপত্তি।

সাধারণ অর্থে সমাজের নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির লোকজন নিজেদের কল্যাণের লক্ষে স্বেচ্ছায় অনুপ্রাণিত হয়ে যে ব্যবসায় সংগঠন গড়ে তোলে তাকে সমবায় সমিতি বলে।

একই ধরনের পেশায় নিয়োজিত কয়েকজন ব্যক্তি একত্রিত হয়ে যখন একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের জন্য কাজ করে তখন তাকে সমবায় সমিতি বলে।

এ সংঘবন্ধ প্রচেষ্টার মূল শক্তি থাকে পারস্পারিক সমঝোতা সহযোগিতা ও সমতা বিধান। এর প্রধান উদ্দেশ্য পারস্পারিক কল্যাণ সাধন, মুনাফা অর্জন নয়।


সমশ্রেণী বা পেশাভুক্ত কতিপয় ব্যক্তি সমঝোতা, সহযোগিতা ও সমঅধিকারের ভিত্তিতে স্বেচ্ছায় ঐক্যবদ্ধ হয়ে যে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান গঠন ও পরিচালনা করে তাকে সমবায় ব্যবসা বলে।

হেনরি সি, কালভার্ট (Henry C. Calvert)- সমবায় সমিতি কি? এ সম্পর্কে বলেন, সমবায় হলো, “এমন এক ধরনের সংগঠন যেখানে সমতার ভিত্তিতে অর্থনৈতিক স্বার্থরক্ষার জন্য বিভিন্ন ব্যক্তি স্বেচ্ছাকৃত ভাবে মিলিত হয়।"

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার মতে, সমবায় সমিতি হলো, “সাধারণভাবে নিম্নবিত্তের কতিপয় ব্যক্তির সংঘ যেখানে তারা সাধারণ অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য অর্জনের নিমিত্ত স্বেচ্ছায় সম্মিলিত হয়ে গণতান্ত্রিকভাবে নিয়ন্ত্রিত একটি ব্যবসায় সংগঠন গড়ে তোলে, যাতে তারা সমহারে প্রয়োজনীয় মূলধন সরবরাহ করে এবং যার ঝুঁকি ও সুফল তারা নিজেদের মধ্যে ন্যায্যভাবে বণ্টনের প্রতিশ্রুতি প্রদান করে।"
সমবায় সমিতি কাকে বলে

সমবায় সমিতির প্রকারভেদ :-

সমাজের স্বল্প আয় বিশিষ্ট সাধারণ জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক কল্যাণধর্মী যৌথ প্রচেষ্টার সংগঠন হচ্ছে সমবায় সংগঠন। বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষ তাদের প্রয়োজন মেটাবার লক্ষ্যে নানাধর্মী সমবায় সংগঠন গড়ে তুলতে পারে। এ কারণে সমাজে বিচিত্ৰ ধর্মী সমবায় সংগঠন দেখতে পাওয়া যায়। নিম্নের রেখাচিত্রে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিন্যাসকৃত সমবায় সমিতির প্রকারভেদ দেখানো হলো।

ক. সদস্যদের চাহিদা অনুসারে :-

১. উৎপাদক সমবায় সমিতি (Producers cooperative society) :-

ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শিল্পের মালিক ও উৎপাদকগণ বৃহদায়তন শিল্পগুলোর সাথে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য তাদের স্বল্প অর্থকে একত্রিত করে যে সমবায় গঠন করে তাকে উৎপাদক সমবায় সমিতি বলে।

কোনো এলাকায় কিছু শ্রমিক একত্রে মিলে কোনো উৎপাদন শুরু করলে বা কতিপয় ব্যক্তি সমবায়ের ভিত্তিতে কোনোরূপ উৎপাদন কাজের সাথে জড়িত হলে তা উৎপাদক সমবায় সমিতি নামে পরিচিত হবে। তাঁতিদের সমবায়, দুগ্ধ উৎপাদন সমবায় ইত্যাদি এ জাতীয় সমবায় সমিতির উদাহরণ।

২. ভোক্তা সমবায় সমিতি (Consumers cooperative society) :-

যখন কোনো বিশেষ পণ্যের বা কতিপয় পণ্যের ভোক্তাগণ মধ্যস্থব্যবসায়ীর মুনাফার শিকার না হয়ে কম মূল্যে জিনিস কিনতে চান তখন তাদের চাহিদা পূরণে যে সমবায় প্রতিষ্ঠান গঠন করা হয় তাকে ভোক্তা সমবায় সমিতি বলে।

এ সমবায় সমিতি উৎপাদনকারী, আমদানিকারক বা পাইকারের নিকট থেকে পাইকারি মূল্যে পণ্যসামগ্রী খরিদ করে সেসব পণ্য সদস্যবৃন্দ ও অন্যান্যের নিকট ন্যায্য মূল্যে বিক্রয়ের ব্যবস্থা করে থাকে।

ভোক্তা সমবায় সমিতিকে বণ্টনকারী সমবায় সমিতি নামেও অভিহিত করা হয়।

আরও পড়ুন:- সমবায় সমিতির বৈশিষ্ট্য উদ্দেশ্য ও গুরুত্ব লিখ?

খ. উদ্দেশ্য বা কার্যের প্রকৃতি অনুসারে :-

১. ক্রয় সমবায় সমিতি (Purchasing cooperative society) :-

বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষ যদি সমবায় সমিতির মাধ্যমে সংঘবদ্ধ হয়ে তাদের প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি, যেমন- পণ্য-দ্রব্য, কাঁচামাল, বীজ, সার, যন্ত্রপাতি ইত্যাদি সংগ্রহের জন্য ক্রয় সুবিধা গ্রহণ করে, তবে তাকে ক্রয় সমবায় সমিতি বলে।

সাধারণ ভাবে স্থানীয় ভিত্তিতে এ সমবায় সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়। এ সংগঠন সরাসরি উৎপাদকের বা তাদের প্রতিনিধির নিকট থেকে পাইকারি হারে প্রয়োজনীয় পণ্যদ্রব্য ক্রয় করে।

২. বিক্রয় সমবায় সমিতি (Marketing cooperative society) :-

ক্ষুদে উৎপাদক, কৃষক ইত্যাদি শ্রেণির লোকজন তাদের পণ্যদ্রব্য বিক্রয়, গুদামজাতকরণ, পরিবহন ইত্যাদি ব্যাপারে পাইকারি সুবিধা প্রাপ্তির লক্ষ্যে যদি কোনো সমবায় সংগঠন গঠন করে তবে তাকে বিক্রয় সমবায় সমিতি বলে।

৩. আমদানি সমবায় সমিতি (Import cooperative society) :-

ক্ষুদে আমদানিকারকগণ তাদের নানাবিধ সুবিধা ও সরকারের কাছ থেকে দাবি আদায়ের নিমিতে যে সমবায় গঠন করে তা আমদানি সমবায় সমিতি নামে পরিচিত।

৪. রপ্তানি সমবায় সমিতি (Export cooperative society) :-

ক্ষুদ্র রপ্তানিকারকগণ রপ্তানি বিষয়ে পাইকারি সুবিধা, সম্মিলিত অভিজ্ঞতা ও সরকারের নিকট হতে দাবি আদায়ের নিমিত্তে যদি সমবায় সমিতি গঠন করে তবে তাকে রপ্তানি সমবায় সমিতি বলা হবে।

৫. বিমা সমবায় সমিতি (Insurance cooperative society) :-

নিজেদের বিমা নিজেরা সংঘবদ্ধভাবে করার জন্য কোনো জনগোষ্ঠী সমবায় সমিতি প্রতিষ্ঠা করলে তাকে ব্যাংক সমবায় সমিতি বলে।

৬. ব্যাংক সমবায় সমিতি (Bank cooperative society) :-

ক্ষুদ্র ভিত্তিতে সদস্যদের নিকট হতে আমানত গ্রহণ ও তাদেরকে ঋণদানের জন্য যে সমবায় গড়ে ওঠে তাকে ব্যাংক সমবায় সমিতি বলে।

৭. ঋণদান সমবায় সমিতি (Credit cooperative society) :-

মহাজন বা ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণের বদলে কম সুদে নিজেদের সঞ্চয় হতে ঋণ গ্রহণের জন্য যদি পেশাজীবীরা মিলিত হয়ে কোনো সমবায় গঠন করে তাকে ঋণদান সমবায় সমিতি হিসেবে অভিহিত করা হয়।

৮. গৃহনির্মাণ সমবায় সমিতি (Housing cooperative society) :-

যদি মধ্যবিত্ত ও স্বল্পবিত্ত লোকেরা নিজেদের গৃহ নির্মাণের উদ্দেশ্যে কোনো সমবায় গড়ে তোলে তবে তাকেই গৃহ নির্মাণ সমবায় সমিতি বলা হয়।

আরও পড়ুন:- ব্যবস্থাপক কাকে বলে?

৯. সমবায় আবাসিক এলাকা ( Cooperative housing society) :-

কোনো স্থানে আবাসিক প্লট খরিদের উদ্দেশ্যে যদি কোনো জনগোষ্ঠী একত্রিত হয় তবে তাকে সমবায় আবাসিক এলাকা বা আবাসিক এলাকাভিত্তিক সমবায় বলে।

১০. বহুমুখী সমবায় সমিতি (Multi purpose cooperative society) :-

যখন কোনো সমবায় সমিতি বিভিন্ন প্রকার ব্যবসায়িক কাজে লিপ্ত হয় তখন তাকে বহুমুখী সমবায় সমিতি বলে। এরূপ সমবায় সমিতি ক্রয়, বিক্রয়, গৃহ নির্মাণ, বাণদান, ব্যাংকিং বিমা এ ধরনের বহুমুখী কার্য সম্পাদন করে থাকে।

গ. সাংগঠনিক স্তর অনুসারে :-

১. প্রাথমিক সমবায় সমিতি (Primary cooperative society) :-

প্রাথমিক সমবায় সমিতি হচ্ছে সে ধরনের সমবায় সংগঠন যা সর্বনিম্ন স্তরে বা প্রাথমিক পর্যায়ে গঠিত হয়। সমবায় বলতে মূলত এ স্তরের সমবায়কেই বোঝানো হয়। ইউনিয়ন থেকে থানা পর্যায়ের সমিতি এর অন্তর্ভূক্ত।

২. কেন্দ্রীয় সমবায় সমিতি (Central cooperative society) :-

কতগুলো প্রাথমিক সমবায় সমিতির সম্মিলিত রূপ হচ্ছে কেন্দ্রীয় সমবায় সমিতি। ইউনিয়ন বা থানা পর্যায়ের সমিতিগুলো একত্রিত হয়ে এ জাতীয় সমিতি গঠিত হয়। এটি সমবায়ের দ্বিতীয় স্তর । এ সমিতিতে কোনো ব্যক্তি সদস্য হতে পারেনা।

৩. মিশ্র সমবায় সমিতি (Mixed cooperative society) :-

এটি সমবায়ের তৃতীয় স্তর। ব্যক্তি সদস্যের পাশাপাশি প্রাথমিক সমবায় সমিতিগুলো এর সদস্য হয়ে থাকে। বিভাগীয় পর্যায়ের সমবায় সমিতিগুলো একত্রিত হয়ে মিশ্র সমবায় সমিতি গঠন করে।

৪. জাতীয় সমবায় সমিতি (National cooperative society) :-

এটি সর্বোচ্চ স্তরের (চতুর্থ স্তর) সমবায় সংগঠন। জাতীয় পর্যায়ে যে সমিতি গঠন করা হয় তাকেই জাতীয় সমবায় সমিতি বলে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কার্যরত কেন্দ্ৰীয় সমবায় সমিতিগুলোর সমন্বয়ে এরূপ সমবায় সমিতি গঠিত হয়।

ঘ. দায়দায়িত্বের প্রকৃতি অনুসারে (According to the liabilities) :-

১. অসীম দায় সমবায় সমিতি (Unlimited cooperative society) :-

অসীম দায় সমবায় সমিতি হচ্ছে সে ধরনের সমবায় সংগঠন যেখানে সদস্যদের দায় তাদের ক্রয়কৃত শেয়ার দ্বারা বা অন্য উপায়ে সীমাবদ্ধ থাকে না। সমিতির দেনার জন্য এ জাতীয় সমিতির সদস্যরা এককভাবে এবং যৌথভাবে দায়ী থাকে।

২. সসীম দায় সমবায় সমিতি (Limited cooperative society) :-

সমবায় সমিতির সদস্যদের দায় যখন তাদের ক্রয়কৃত শেয়ারের আংকিক মূল্য দ্বারা সীমাবদ্ধ থাকে তখন তাকে সসীম দায় সমবায় সমিতি বলে। সদস্যদের সীমিত দায়কে বোঝাবার জন্য এরূপ সমবায় সমিতির নামের শেষে লিমিটেড শব্দ যোগ করা হয়। দেশের অধিকাংশ সমবায়ই এ শ্রেণিভুক্ত।

উল্লিখিত সমবায় সমিতিসমূহ ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শ্রমিক চুক্তি ও নির্মাণ সমবায় সমিতি, কৃষি সমবায় সমিতি, অকৃষি সমবায় সমিতি, অ-ঋণদান সমবায় সমিতি, শিল্প সংক্রান্ত সমবায় সমিতি ইত্যাদি বহুবিধ সমবায় সমিতির অস্তিত্ব পরিলক্ষিত হয়।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ