সমবায় সমিতির গঠন প্রক্রিয়া ও নীতিমালা

সমবায় সাধারণত বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন আইন অনুযায়ী গঠিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়। সমবায় সমিতি এক বা ততোধিক নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য সাধনের জন্য গঠিত হয়ে থাকে।

বীজ বপনের পূর্বে উত্তমরূপে জমি কর্ষণ ও ভালো সার ব্যবহার না করলে যেমন ভালো ফসল ফলানো যায় না, তেমনি কোনো সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান গড়ার পূর্বে এর সহায়ক উপযুক্ত ক্ষেত্র বা পরিবেশ সৃষ্টি না করলে তা স্থায়ী হতে পারে না।

আমাদের দেশের সমবায় আন্দোলন আশাপ্রদ সফলতা লাভ না করার প্রধান কারণ, সমিতি গঠনের পরিবেশ ও ভিত্তি ঠিক না করেই সমিতি গঠন করা হয়েছিল। 
সুতরাং সমবায় সংগঠনে হাত দেওয়ার পূর্বেই প্রস্তাবিত সমিতির সদস্যদের মধ্যে উপযুক্ত ক্ষেত্র ও পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে এবং তাদেরকে সমবায় আদর্শে অনুপ্রাণিত করতে হবে। এ লক্ষ্যকে সামনে রেখে এ পোস্টে আমরা সমবায় সমিতির গঠন প্রক্রিয়া ও নীতিমালা সম্পর্কে আলোচনা করবো।

সমবায় সমিতির গঠন প্রক্রিয়া :-

সমবায় সমিতি একটি আইনসৃষ্ট কৃত্রিম ব্যক্তিসত্তা বিশিষ্ট প্রতিষ্ঠান। একাধিক ব্যক্তি নিজেদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে এ সংগঠন প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা করে থাকে। সমমনা ও সমস্বার্থ বিশিষ্ট কমপক্ষে ১০ জন সদস্যকে সমিতি গঠনের জন্য সম্মত হতে হয়, যাদের বয়স ১৮ বছর বা তার ঊর্ধ্বে। সমবায় সমিতি গঠন প্রক্রিয়া বিভিন্ন পর্যায় নিম্নরূপঃ

১. উদ্যোগ গ্রহণ পর্যায়।
২. নিবন্ধন পর্যায় এবং
৩. কার্যারম্ভ পর্যায়।
সমবায় সমিতির গঠন পদ্ধতি ও নীতিমালা

১. উদ্যোগ গ্রহণ পর্যায় (Stage of taking initiative) :-

সমবায় সমিতি গঠনের জন্য কমপক্ষে সমমানসিকতা সম্পন্ন ১০ জন ব্যক্তিকে একত্রিত হতে হয়। প্রাথমিক অবস্থায় যেসব ব্যক্তি সমিতি গঠনের উদ্যোগ নেয় তাদেরকে উদ্যোক্তা বলা হয়। এরূপ ৬ জন উদ্যোক্তার সমন্বয়ে গঠিত হয় একটি কমিটি। কমিটির সদস্যবৃন্দ হচ্ছে-

ক. চেয়ারম্যান জন ১ জন ।
খ. ভাইস চেয়ারম্যান ১ জন।
গ. সেক্রেটারি ১ জন।
ঘ. কোষাধ্যক্ষ জন ১ জন।
ড. সাধারণ সদস্য ২ জন।

সমিতি গঠনের জন্য ভারাপ্রাপ্ত কমিটি অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের সাহায্য নিয়ে সমিতির উপবিধি প্রণয়ন করেন। উপবিধি সমিতির একটি প্রয়োজনীয় দলিল যাকে সমিতির গঠনতন্ত্রও বলা যেতে পারে। উপবিধিতে অন্তর্ভুক্ত বিষয়গুলো হলো

সমিতির নাম ও ঠিকানা, উদ্দেশ্যসমূহ, উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন পদ্ধতি, উদ্যোক্তার নাম, ঠিকানা, ইত্যাদি।



২. নিবন্ধন পর্যায় (Stage of registration) :-

এ পর্যায়ে সংশ্লিষ্ট এলাকার সমবায় নিবন্ধকের অফিস হতে নিবন্ধনের আবেদনপত্র সংগ্রহ করা হয়। আবেদনপত্রটি যথাযথভাবে পূরণ করে নির্দিষ্ট ফিসহ নিবন্ধকের নিকট জমা দেওয়া হয়। আবেদনপত্রের সাথে নিম্নলিখিত কাগজপত্র ও তথ্যাবলি প্রদান করতে হয়।

(i) প্রস্তাবিত সমিতির সদস্যদের নাম, ঠিকানা ও তারিখসহ স্বাক্ষর;
(ii) উদ্যোক্তাদের স্বাক্ষরিত ২ কপি উপবিধি;
(iiii) সিলমোহরের নমুনা:
(iv) আবেদনপত্রটি সঠিকভাবে পূরণ হয়েছে এ মর্মে সম্পাদক ও উদ্যোক্তাদের স্বাক্ষরকৃত প্রতিশ্রুতি। নিবন্ধক প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ আবেদনপত্রটি পরীক্ষানিরীক্ষা করে সন্তুষ্ট হলে প্রস্তাবিত সমিতি নিবন্ধন করে নেন।

৩. কার্যারম্ভ পর্যায় (Stage of commencement) :-

সমিতি নিবন্ধন হওয়া মাত্রই তা নিজস্ব সত্তালাভ করে। নিবন্ধিত সমিতি আইনগত মর্যাদার অধিকারী হয় এবং নিজ নাম ও সিল ব্যবহার করে যথারীতি কার্য আরম্ভ করতে পারে।

উপরিউক্ত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে একটি সমবায় সমিতির গঠন কার্য সমাপ্ত হয়ে থাকে।

সমবায় সমিতির মূল নীতিমালা বা আদর্শ :-

ধনতান্ত্রিক উৎপাদন পদ্ধতিতে দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত উৎপাদক, ভোক্তা, শ্রমিক বা ব্যবসায়ীগণকে প্রচণ্ড প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হতে হয়। উচ্চবিত্তগণ এসব ক্ষেত্রে ধ্বংসাত্মক প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ে থাকেন। এমতাবস্থায় প্রথমোক্ত শ্রেণির অস্তিত্ব ও স্বার্থকে টিকিয়ে রাখার জন্য তারা সমবায়ের মাধ্যমে একত্রিত হন এবং যৌথভাবে কতিপয় নীতির ওপর ভিত্তি করে কাজ করতে পারে। এ নীতিগুলো নিয়ে আলোচিত হলো:

১. একতা (Unity) :-

একতার মাধ্যমে দরিদ্রতম ব্যক্তিরাও উচ্চবিত্ত শ্রেণির যে কোনো অনাচারকে প্রতিহত করতে পারে। সমবায় একতার নীতিতে প্রতিষ্ঠিত।

২. সাম্য (Equality) :-

সকল সদস্যের অধিকার ও মর্যাদা সমবায় সমিতিতে সমান। অর্থাৎ কোনো শ্রেণিভেদ সমবায় সমিতিতে থাকেনা।

৩. স্বেচ্ছাকৃত সংঘবদ্ধতা (Voluntary association) :-

সমবায় সমিতির সদস্যগণ একান্তই স্বেচ্ছায় মিলিত হয়ে থাকেন। কোনোরূপ শক্তিপ্রয়োগ করে সদস্য সংগ্রহ করা হয় না।

8. সেবা (Service) :-

সমবায়ের প্রধান উদ্দেশ্য সদস্যদের এবং জনগণের সেবা করা বা কল্যাণ সাধন করা। মুনাফা অর্জন সমবায়ের মুখ্য উদ্দেশ্য নয়।

৫. একাত্মবোধ (Proximity) :-

সকলের তরে সকলে আমরা প্রত্যেকে মোরা পরের তরে- এ নীতি সমবায়ে অনুসৃত হয়। কারণ যৌথ স্বার্থ রক্ষার উদ্দেশ্যেই সমবায় সমিতির জন্ম।

আরও পড়ুন:- একমালিকানা ব্যবসায়ের উপযুক্ত ক্ষেত্রসষমূহ লিখ?

৬. মিতব্যয়িতা (Economy) :-

সাধ্যমত মিতব্যয়িতা নিশ্চিত করা সমবায়ের অন্যতম নীতি। এতে সঞ্চয় ও আয় বাড়ে।

৭. শান্তি বজায় (Peace) :-

সদস্যদের পরস্পরের মধ্যে যেন কোনোরূপ বিরোধ সৃষ্টি না হয় এবং ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় থাকে সেদিকে নজর রেখে সমবায় সমিতিতে কাজ করতে হয়।

৮. সহযোগিতা (Cooperation) :-

সকল সদস্যের পারস্পারিক সহযোগিতা প্রদানই সমবায়ের আদর্শ।

৯. সমভোটাধিকার (Equal right of votes) :-

প্রত্যেক সদস্যের ভোটাধিকার সমান। এক্ষেত্রে কোনো সদস্যের অধিক পরিমাণ শেয়ার থাকলেও সে অতিরিক্ত ভোট দেবার সুযোগ পাবে না।

১০. গণতান্ত্রিক পরিচালনা (Democratic administration) :-

সদস্যদের বার্ষিক সাধারণ সভায় সকলের ভোটে নির্বাচিত কার্য নির্বাহী কমিটিই সাংবার্ষিক কার্যক্রম পরিচালনা করে।

১১. মূলধনের ঊর্ধ্বসীমা (Upper limit of capital) :-

কোনো সদস্যের মোট মূলধনের ১/১০ অংশের অধিক বিনিয়োগ করার অধিকার নেই। আধিপত্য সীমিতকরণের উদ্দেশ্যে এ বিধির প্রচলন করা হয়েছে।

১২. মুনাফা বণ্টন (Distribution of profit) :-

মুনাফা অর্জন বা মুনাফা বণ্টন সমবায়ের নীতি নয়। বরং সেবাই সমবায়ের আদর্শ। আর এ জন্যই সমবায়ের অর্জিত মুনাফার কমপক্ষে ১/৫ অংশ বণ্টনের পরিবর্তে সঞ্চিতি তহবিলে রাখা হয়।

১৩. রাজনীতি ও ধর্ম নিরপেক্ষতা (Neutrality in politics and in religion) :-

রাজনৈতিক বা ধর্মীয় মতাদর্শের ভিত্তিতে বিভেদের স্থান সমবায়ে নেই। সকলেই নিজ নিজ মতাদর্শের পৃথকত্ব বজায় রেখে সমবায়ে মিলিত হতে পারে।

১৪. আর্থিক সচ্ছলতা (Financial solvency) :-

সমবায় সমিতির সাফল্য প্রধানত আর্থিক সচ্ছলতার ওপর নির্ভরশীল। তাই সমবায়ের কার্যসমূহ মিতব্যয়িতার সাথে সম্পাদন করা উচিত যাতে সংগঠনের আর্থিক সচ্ছলতা আনয়ন করা সম্ভব হয়।

সমবায় সমিতির কাঙ্ক্ষিত সাফল্য অর্জনের জন্য উপরিউক্ত নীতিসমূহ যথাযথভাবে অনুসরণ করা বাঞ্ছনীয়। এ আদর্শগুলোকে সমুন্নত রেখে সমবায়ীগণ সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টায় অগ্রসর হলে এর মাধ্যমে সমবায়ের মূল লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব হয়।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ