বিচূর্ণীভবন কি বা কাকে বলে? বিচূর্ণীভবন কত প্রকার ও কি কি? বিচূর্ণীভবনের কারণ?

বিচূর্ণীভবন কাকে বলে :-

বিচূর্ণীভবন কথার অর্থ শিলা চূর্ণ-বিচূর্ণ হওয়া। বিচূর্ণীভবন ভূ-পৃষ্ঠের নগ্নীভবন প্রক্রিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

যে প্রক্রিয়ায় ভূ-পৃষ্ঠের শিলা প্রাকৃতিকভাবে ছোট ছোট খন্ডে ভাগ হয় অথবা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয় অথবা রাসায়নিকভাবে দ্রবীভূত হয় তাকে বিচূর্ণীভবন বলে।

বিচূর্ণীভবনকে আবহিক বিকার বলা হয় কারণ আবহাওয়ার বিভিন্ন উপাদান বিশেষ করে উত্তাপ, আর্দ্রতা, সূর্যালোক, বৃষ্টিপাত প্রভৃতির তারতম্য ভূ-পৃষ্ঠের শিলাসমূহকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে।

সুতরাং আবহাওয়ার বিভিন্ন উপাদান দ্বারা যান্ত্রিক উপায়ে শিলাস্তর ফেটে (Mechanical Fracturing) ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শিলাখন্ডে পরিনত হয়ে অথবা রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় শিলাস্তর বিয়োজিত হয়ে ক্ৰিয়া (Chemical Decomposition) মূল শিলার উপরই যদি থেকে যায়, তখন তাকে বিচূর্ণীভবন (Weathering) বলা হয়।

এই সকল শিলা খন্ডের অপসারণকে ক্ষয়ীভবন (Erosion) বলে।

বিভিন্ন যান্ত্রিক, রাসায়নিক ও জৈবিক প্রক্রিয়াগুলি ভূ-পৃষ্ঠে অনবরত কার্যকর রয়েছে এবং তাদের দ্বারা সেখানকার শিলারাশি প্রতিনিয়ত চূর্ণ-বিচূর্ণ হচ্ছে।

পৃথিবীর সব স্থানের আবহাওয়া সবসময় একই রূপ থাকে না। এমনকি যে কোনো স্থানের যে কোনো দিনের বিভিন্ন সময়ের আবহাওয়ার মধ্যে তারতম্য ঘটে। সময় পরিবর্তনে আবহাওয়া সংক্রান্ত বিভিন্ন উপাদানের অর্থাৎ বৃষ্টিপাত, বায়ুর উষ্ণতা, চাপ, আর্দ্রতা প্রভৃতির পরিবর্তন ঘটে। অধিক তাপে শিলাসমূহ প্রসারিত হয় আবার তাপ হ্রাসে তা সংকুচিত হয়।

অতএব, যে সব স্থানে বিশেষ করে দিবা-রাত্রির উষ্ণতার পার্থক্য এবং শীত-গ্রীষ্মের উষ্ণতার পার্থক্য খুব বেশি সে সব স্থানে শিলাসমূহের প্রসারিত ও সংকুচিত হওয়ার কাজ ক্রমাগত চলতে থাকে।

আরও পড়ুন :- ভাঁজ কাকে বলে?

এভাবে সেখানকার শিলাসমূহ ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ে এবং কালক্রমে ঐ সব শিলা ধীরে ধীরে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে নরম ও আলগা হয়। এভাবেই বিচূর্ণীভবন প্রক্রিয়া চলতে থাকে।

উল্লেখ্য, বিচূর্ণীভবন বা আবহবিকার বলতে কেবলমাত্র বিচূর্ণীকরণ প্রক্রিয়াকেই বুঝায় কিন্তু বিচূর্ণীত বা ক্ষয়প্রাপ্ত শিলাসমূহের স্থানান্তর বুঝায় না। সে জন্য বিচূর্ণীভবনের মাধ্যমগুলি সুনির্দিষ্ট।

সুতরাং বিচূর্ণীভবন ও ক্ষয়ীভবনের মধ্যে পার্থক্য হলো এই যে, ক্ষয়ীভবন শিথিল শিলাখন্ডসমূহ দূর দেশে অপসারিত করে। আর বিচূর্ণীভবনে মাধ্যাকর্ষণ শক্তির দ্বারা শিলাখন্ড সামান্য স্থানচ্যুত হয়। কিন্তু শিলাখন্ডসমূহ অপসারণ হয় না।

বিচূর্ণীভবনের প্রক্রিয়া যেভাবেই সম্পন্ন হোক না কেন নিম্নোক্ত চারটি কাজ এর দ্বারা সম্পাদন হয়ে থাকে

ক) শিলা / মাটির ক্ষয়সাধনে কাজ করে,

খ) ভূমির উচ্চতা কমাতে নিয়ামক হিসেবে কাজ করে,

গ) ভূমিরূপের পরিবর্তনে সরাসরি অংশগ্রহণ করে এবং

ঘ) রিগোলিখ ও মাটি গঠনে সক্রিয় ভূমিকা রাখে।
বিচূর্ণীভবন কাকে বলে

বিচূর্ণীভবন কত প্রকার ও কি কি :-

বিচূর্ণীভবন সংঘটিত হওয়ার প্রক্রিয়ার ওপর ভিত্তি করে বিচূর্ণীভবন বা আবহবিকারকে প্রধানত তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়।

১. যান্ত্রিক বা প্রাকৃতিক বিচূর্ণীভবন (Mechanical or Physical Weathering) :

যেখানে ভূ পৃষ্ঠের শিলাসমূহ উত্তাপের তারতম্যে, তৃষার কার্য এবং আংশিকভাবে গাছপালা ও জীবজন্তুর ক্রিয়াকলাপে ভেঙ্গে টুকরা টুকরা হয়ে যায়।

২. রাসায়নিক বিচূর্ণীভবন (Chemical Weathering) :

যেখানে বায়ুমন্ডলে অবস্থিত পানি, অক্সিজেন, কার্বন-ডাই অক্সাইড এবং জৈব পদার্থ ও এগুলোর অবশিষ্ঠাংশের দ্বারা শিলার খনিজ দ্রব্যসমূহ বিয়োজিত ও দ্রবীভূত হয়ে আলগা হয়ে পড়ে।

৩. জৈবিক বিচূর্ণীভবন (Biological Weathering) :

জীবজন্তু ও বিভিন্ন জৈব পর্যায়ের দ্বারা সংঘটিত বিচূর্ণীভবনকে অনেক সময় জৈবিক বিচূর্ণীভবন নামে অভিহিত করা হয়। জৈবিক বিচূর্ণীভবন যান্ত্রিক এবং রাসায়নিক উভয় প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই কাজ করে থাকে।

বিচূর্ণীভবনকে প্রধানত দুটো ভাগে ভাগ করা হলেও একটিকে অপরটি থেকে সম্পূর্ণরূপে পৃথক করা একেবারেই অসম্ভব। পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে সামান্যতম জলীয়বাষ্পের অবস্থান, রাসায়নিক বিচূর্ণীভবনকে পৃথিবীর সর্বত্র কাজ করতে সাহায্য করে থাকে। তবে সুবিধার জন্য আমরা যান্ত্রিক এবং রাসায়নিক বিচূর্ণীভবনকে পৃথিবীর সর্বত্র কাজ করতে সাহায্য করে থাকে।

তবে সুবিধার জন্য আমরা যান্ত্রিক এবং রাসায়নিক বিচূর্ণীভবনের বিভিন্ন বিষয় সম্বন্ধে পৃথক ভাবে আলোচনা করেছি। তবে একথা মনে রাখতে হবে যে, এ দুই প্রকার বিচূর্ণীভবন একত্রেই কাজ করে থাকে।

আরও পড়ুন :- দূর্যোগ কাকে বলে?

বিচূর্ণীভবনের কারণ :-

বিচূর্ণীভবন বিভিন্ন প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট কারণে সংঘটিত হয়ে থাকে। নিম্নে বিচূর্ণীভবনের প্রধান কারণগুলো আলোচনা করা হলো।

১. তাপমাত্রার হ্রাস-বৃদ্ধি :

তাপ ও তাপমাত্রা বিচূর্ণীভবনের অন্যতম প্রধান নিয়ামক। সূর্যের অধিক তাপমাত্রা যেমন শিলারাশি চূর্ণ-বিচূর্ণ হতে সাহায্য করে, আবার কম তাপমাত্রায় শিলা সংকুচিত হয়। ক্রমাগত তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং হ্রাসের ফলে শিলা এভাবে সম্প্রসারিত এবং সংকুচিত হয়ে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়।

২. বৃষ্টিপাতের প্রভাব :

বৃষ্টিপাতের প্রভাবে শিলার ছিদ্রে পানি প্রবেশ করে শিলান্তরকে চূর্ণ-বিচূর্ণ হতে সাহায্য করে।

৩. মাধ্যাকর্ষণ শক্তির প্রভাব :

উচ্চ পর্বতের খাড়া ঢালে কোনো প্রকান্ড শিলাখন্ড আলগা হলে মাধ্যাকর্ষণ শক্তির প্রভাবে ভূ-পৃষ্ঠের নিচের দিকে নামতে থাকে এবং অন্যান্য শিলাখন্ডের সাথে ঘাত প্রতিঘাতে বিচূর্ণিত হয়।

৪. জীবজন্তু ও কীট পতঙ্গ :

জীবজন্তু এবং কীটপতঙ্গ বিচূর্ণীভবনে সাহায্য করে। নানা প্রকার জীবজন্তুর মধ্যে কেঁচো, ইঁদুর, পিঁপড়া, কুকুর প্রভৃতি সর্বদা মাটি খুড়ে ওলট-পালট করে ভূ-ত্বকের পরিবর্তন সাধন করে। এই পরিবর্তন খুব সূক্ষ্ম এবং ধীর প্রক্রিয়ায় হয়।

৫. নদীর প্রভাব :

ভূ-ত্বকের পরিবর্তনকারী শক্তিগুলোর মধ্যে নদী সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। প্রাথমিক গতিতে নদী প্রত্যক্ষভাবে আঘাত, ঘর্ষণ ও কর্ষণ দ্বারা ক্ষয়কার্যের ফলে শিলারাশি চূর্ণ-বিচূর্ণ হয় এবং নদীর স্রোতের সাহায্যে বাহিত হয়ে বিভিন্ন প্রকার ভূমিরূপ সৃষ্টি করে। সমভূমি অঞ্চলে স্রোতের বেগ কম থাকায় শিলাসমূহ তুলনামূলকভাবে কম বিচূর্ণিত হয়।

৬. বায়ুপ্রবাহের কার্য :

বায়ুপ্রবাহের ফলে কঠিন শিলাগুলি স্থানান্তরিত হওয়ার সময় তাদের আঘাতে অপেক্ষাকৃত কোমল শিলাগুলি ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। বিশেষ করে কোয়ার্টজ জাতীয় শিলার সংস্পর্শে কোমল শিলাগুলি অতি সহজেই ভেঙে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণায় পরিণত হয়।

৭. তুষারের কার্য :

শীতপ্রধান দেশে পানি জমে অত্যধিক শীতে জমাট বেঁধে তুষারে পরিণত হয় এবং আয়তনে বৃদ্ধি পায়। ফলে তুষারের প্রচন্ড চাপে ফাটলসমূহ অধিকতর প্রসারিত হয় এবং শিলাস্তর ভেঙে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ