টিকা বা ভ্যাকসিন কাকে বলে? টিকা কয় প্রকার ও কি কি?

ভ্যাকসিন শব্দটি ল্যাটিন শব্দ ভ্যাকসিনাস (vaccinus) থেকে এসেছে যার আক্ষরিক অর্থ হলো from cow বা 'গরু থেকে প্রাপ্ত'।

ড. এডওয়ার্ড জেনার (Dr. Edward Jenner) ১৭৭৬ খ্রিস্টাব্দে প্রথম গুটি বসন্তের টিকা আবিষ্কার করেন। এর অনেক বছর পর লুই পাস্তুর জলাতঙ্ক রোগের টিকা আবিষ্কার করেন।

টিকা হলো প্রাণিদেহে রোগ সৃষ্টিকারী অণুজীবের নিষ্ক্রিয় পরিশ্রুত সাসপেনশন। টিকায় বিদ্যমান অণুজীবগুলো (ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া) জীবিত, অর্ধমৃত বা মৃতও হতে পারে।

এদের এমনভাবে নিষ্ক্রিয় করা হয় যাতে এরা জীবকোষে কোনো রোগ সৃষ্টি করতে না পারে, কিন্তু রোগের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি সৃষ্টি করে। অ্যান্টিবডি রোগের জীবাণুর বৃদ্ধি প্রতিহত করে এবং স্থায়ী কার্যক্ষমতা নষ্ট করে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে টিকা ভাইরাস থেকে তৈরি করা হয়।

সাধারণত কোনো রোগ সৃষ্টিকারী অণুজীব দিয়েই ওই রোগের টিকা তৈরি করা হয়। টিকা প্রবেশ করালে প্রাণিদেহে ওই একই জীবাণু বা নিকট সম্পর্কিত রোগ জীবাণুর আক্রমণ প্রতিরোধক্ষম হয়ে ওঠে।

আরও পড়ুন :- অ্যান্টিজেন কাকে বলে?

দেহে টিকা দেওয়া মানে হলো ওই রোগের জীবাণু দেহে প্রবেশে করানো। কিন্তু যেহেতু এ জীবাণুগুলো বিশেষ পদ্ধতিতে নিষ্ক্রিয় থাকে সেহেতু এরা জীবদেহে কোনো রোগ সৃষ্টি না করে রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলে।

আধুনিক জৈবপ্রযুক্তি প্রয়োগ করে বর্তমানে পোলিও, টিটেনাস, হাম্পস, ডিপথেরিয়া, যক্ষ্মা, হুপিংকাশি, টাইফয়েড, হেপাইটিস, ও সাম্প্রতিক COVID-19 ইত্যাদি রোগের টিকা আবিষ্কৃত হয়েছে। কিন্তু মরণব্যাধি এইডস (AIDS) এর ভাইরাস HIV কিংবা হেপাইটিস সি ভাইরাসের প্রতিষেধক কোনো টিকা আজও আবিষ্কার হয়নি।

টিকার প্রকারভেদ :-

মানবদেহের বিভিন্ন রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণুকে দমন করতে চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন ধরনের টিকা আবিষ্কা করেছেন।এগুলো হলো-
টিকা কাকে বলে
১. নিষ্ক্রিয়কৃত জীবাণু জীবন্ত টিকা (Attenuated live vaccine)- কালচার করা, ক্ষতিকর বৈশিষ্ট্য নিষ্ক্রিয় বা দুর্বল করে দেওয়া জীবিত জীবাণু নিয়ে তৈরি। উদাহরণ- করোনা, BCG, হাম, মাম্পস, পোলিও, জলাতঙ্ক, যক্ষ্মা, গুটিবসন্ত, প্লেগ, টাইফয়েড প্রভৃতি রোগের ভ্যাকসিন।

২. মৃত জীবাণুভিত্তিক নিষ্প্রাণ টিকা (killed vaccine)- এধরনের টিকা মৃত জীবাণু দিয়ে তৈরি। উদাহারণ- ইনফ্লুয়েঞ্জা, কলেরা প্রভৃতি ভ্যাকসিন।

৩. নিষ্ক্রিয় বিষভিত্তিক টিকা (Toxoid vaccine)- এ ধরনের টিকা জীবাণু নিঃসৃত টক্সয়েড দিয়ে তৈরি। উদাহরণ- ডিপথেরিয়া, টিটেনাস (ধনুষ্টংকার) প্রভৃতি রোগের ভ্যাকসিন।

৪. দেহ তলের রাসায়নিক বস্তু (Surface chemical molecule)- অনেক ক্ষেত্রে সংক্রমণকারী জীবাণুর দেহ তল থেকে রাসায়নিক উপাদান (নির্দিষ্ট প্রোটিনের অংশ) আলাদা করে ভ্যাকসিন তৈরি করা হয়। উদাহরণ- হেপাটাইটিস-B ভ্যাকসিন, হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস ভ্যাকসিন প্রভৃতি।

৫. ডিএনএ টিকা (DNA vaccine)- রিকমবিনেন্ট DNA পদ্ধতিতে DNA ভ্যাকসিন তৈরি করা হয়।

আরও পড়ুন :- ইমিউনিটি সিস্টেম কি?

টিকা দেওয়ার গুরুত্ব বা প্রয়োজনীয়তা (Importance of Vaccination) :-

১. টিকা দেওয়ার ফলে দেহে অ্যান্টিবডি সৃষ্টি করে রোগাক্রমণ প্রতিরোধ করা হয়।

২. ভ্যাকসিন দেহের মধ্যে প্রবিষ্ট ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়াদের প্রজনন ক্ষমতাকে নষ্ট করে দেয়।

৩. টিকার মাধ্যমে যে সব রোগ প্রতিরোধ করা হয় সে রকম কয়েকটি হলো- যক্ষ্মা, টিটেনাস, কলেরা, জলাতঙ্ক, হুপিংকাশি, গুটি বসন্ত, ডিপথেরিয়া, পোলিও, টাইফয়েড, হেপাটাইটিস-B ইত্যাদি।

৪. টিকা দেওয়ার ফলে কৃত্রিম শক্তির ইমিউনিটি সৃষ্টি করা হয়।

একটি আদর্শ টিকার বৈশিষ্ট্য :-

১. সারা জীবনের জন্য দেহকে অনাক্রম্য করে।

২. সুনির্দিষ্ট জীবাণু থেকে দেহকে সুরক্ষা দেয়।

৩. রোগের সংক্রমণ রোধ করে।

৪. খুব দ্রুত অনাক্রম্যতার সূচনা ঘটায়।

৫. মায়ের অনাক্রম্যতাকে সস্তানে পরিবাহিত করে।

৬. সুস্থিত, সস্তা এবং নিরাপদ।

আরও পড়ুন :- অ্যান্টিবডি কি?

বুস্টার ডোজ (Booster dose) :-

দেহে অধিক মাত্রায় অ্যান্টিবডি সৃষ্টি এবং ইমিউনিটি সাধনের জন্য প্রাথমিক ভ্যাকসিন দেওয়ার নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে যে ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা হয় তাকে বুস্টার ডোজ বলে।

টিকা দেওয়া বা ভ্যাকসিনেশন (Vaccination) :-

ইমিউনিটি অর্জনের জন্য দেহের মধ্যে টিকা বা ভ্যাকসিন দেওয়ার পদ্ধতিতে টিকাকরণ বা ভ্যাকসিনেশন বলে।

টিকাকরণের নীতি (Principles of Vaccination) :-


রোগ সৃষ্টিকারী অণুজীবের রোগ সৃষ্টির ক্ষমতাকে নষ্ট করে দেহে প্রবেশ করিয়ে ইমিউনিটি গড়ে তোলা হয়। এই পদ্ধতিতে সক্রিয় অনাক্রমীকরণের মাধ্যমে ইমিউনোলজিক্যাল মেমোরির (immunological memory) সৃষ্টি হয়।

পরবর্তীতে রোগ সংক্রামক জীবাণু শরীরে প্রবশে করলে দেহ দ্রুততার সঙ্গে প্রবিষ্ট জীবাণুকে ধ্বংস করে। প্রকৃতপক্ষে, দেহে প্রবিষ্ট ভ্যাকসিনের বিরুদ্ধে অ্যান্টিজেন নির্দিষ্ট T ও B-লিম্ফোসাইটের সংখ্যা বৃদ্ধি পায় এবং মেমোরি সেল উৎপন্ন ভ্যাকসিনেশন প্রধানত অণুজীবের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হলেও বিভিন্ন বিষ (toxins), যেমন- সাপের বিষ (snake venom), মাকড়সার বিষ প্রভৃতির বিরুদ্ধেও ব্যবহার করা হয়।

আরও পড়ুন:- করোটিক স্নায়ু কাকে বলে?

জীবাণু বা পরজীবীর আক্রমণে রোগের লক্ষণ প্রকাশ পেলে ভ্যাকসিনেশন আর কোনো কাজে আসে না। এসব দিক বিবেচনা করলে দেখা যায় যে ভ্যাকসিনেশন কতগুলো নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত। ভ্যাকসিনেশনের নীতিগুলো হলো-

১. ভ্যাকসিন বা টিকা মৃত বা নির্জীব জীবাণু অথবা তাদের নিষ্ক্রিয় উপজাত সমন্বয়ে গঠিত।

২. নির্জীব জীবাণু ভ্যাকসিন হিসেবে শরীরে প্রবেশ করানো হলে এটি বংশবৃদ্ধি করলেও কোনো রোগ সৃষ্টি করতে পারে না। নিষ্ক্রিয় টক্সয়েড টিকা হিসেবে ব্যবহৃত হলে এটি শরীরের কোনো ক্ষতি করতে পারে না।

৩. ভ্যাকসিন প্রয়োগে যে ইমিউনিটি জাগে তা জীবনব্যাপী স্থায়িত্ব পায় না। তবে বুস্টার ডোজ প্রয়োগ দ্বারা এর স্থায়িত্ব বাড়িয়ে তোলা যায়। বুস্টার ডোজগুলো দীর্ঘস্থায়ী ইমিউনিটি বজায় রাখে।

৪. কোন পথে ভ্যাকসিন প্রয়োগ হচ্ছে তার ওপর অনেক সময় ইমিউনিটি স্থায়ী হয়। যেমন- খাদ্যনালি সংক্রমণের ক্ষেত্রে খাদ্যনালির মাধ্যমে ভ্যাকসিন প্রয়োগ করলে স্থায়ী ফল প্রদান করে।

৫. অনাক্রম্যতাজনিত সাড়া জাগাতে যে সময় লাগে তা কোনো জীবাণুর ইনকিউবেশন সময়কালের চাইতে অনেক বেশি। এ কারণে দেহে রোগ জীবাণু সংক্রমণের পর ভ্যাকসিন প্রয়োগ করলে আশানুরূপ ফল পাওয়া যায় না।

তবে জলাতঙ্কের ক্ষেত্রে ভ্যাকসিন প্রয়োগে ব্যতিক্রম লক্ষ করা যায়। কারণ জলাতঙ্কের বেলায় ইনকিউবেশনকাল অতিশয় দীর্ঘ।


জীবাণুঘটিত রোগের ভ্যাকসিন, তাদের জীবাণু ও প্রকৃতি :-

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ