রক্ত কাকে বলে? রক্তের কাজ? রক্ত কনিকা কত প্রকার ও কি কি?

মানবদেহে সংবহন :-

মানবদেহের সংবহন প্রক্রিয়ায় রক্ত একটি অপরিহার্য উপাদান। রক্তনালির মাধ্যমে রক্ত দেহের সর্বত্র প্রবাহিত হয় এবং কোষে অক্সিজেন ও খাদ্য উপাদান সরবরাহ করে, একে মানবদেহে সংবহন বলে।

যে তন্ত্রের মাধ্যমে রক্ত প্রতিনিয়ত দেহের বিভিন্ন অংশে চলাচল করে তাকে রক্ত সংবহন তন্ত্র (Circulatory system) বলে।

সারাদেহে রক্তের এক বার পরিভ্রমণের জন্য মাত্র ১ মিনিট বা তার চেয়ে কম সময় লাগে। মানবদেহে রক্ত প্রবাহ কেবল হৃদপিন্ড ও রক্তনালিসমূহের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে, কখনও বাইরে আসে না। এ ধরনের সংবহনতন্ত্রকে বন্ধ সংবহনতন্ত্র (Closed circulatory system ) বলা হয়। এ ব্যবস্থায় রক্ত সরাসরি দেহের বিভিন্ন অঙ্গে গিয়ে পৌঁছে এবং রক্ত বিভিন্ন অঙ্গে পরিভ্রমণ করে দ্রুত হৃদপিন্ডে ফিরে আসে।

রক্ত সংবহনতন্ত্রকে সাধারণত দু'টি অংশে ভাগ করা হয়। যথা-

আরও পড়ুন :- বৃক্ক কাকে বলে?

(ক) রক্ত সংবহনতন্ত্র (Blood circulatory system) হৃদপিন্ড, ধমনি, শিরা ও কৈশিক নালি নিয়ে গঠিত।

(খ) লসিকাতন্ত্র (Lymphatic System) লসিকা, লসিকানালি ও ল্যাকটিয়েলনালি নিয়ে গঠিত।

রক্ত কাকে বলে (Blood) :-

রক্ত একটি অস্বচ্ছ তরল পদার্থ। লোহিত রক্ত কণিকায় হিমোগ্লোবিন নামক রঞ্জক পদার্থ থাকার কারণে রক্তের রং লাল দেখায়। রক্ত হৃদপিন্ড, শিরা, উপশিরা, ধমনি, শাখা ধমনি ও কৈশিকনালি পথে আবর্তিত হয়। এটি ক্ষারধর্মী, লবণাক্ত স্বাদযুক্ত পদার্থ। সাধারণত হাড়ের লাল অস্থিমজ্জাতে (Bone marrow) রক্ত কণিকার জন্ম।

রক্তের উপাদান (Blood Corpuscles) :

রক্ত এক প্রকার লাল তরল যোজক কলা। ইহা (ক) রক্তরস ও (খ) রক্ত কণিকার সমন্বয়ে গঠিত।

(ক) রক্তরস (Plasma)-

রক্তের বর্ণহীন তরল অংশকে রক্তরস বলে। রক্তের শতকরা ৫৫ ভাগই রক্তরস। রক্তরসের প্রধান উপাদান পানি। বাকি অংশে কিছু আমিষ, জৈব যৌগ ও সামান্য অজৈব লবণ দ্রবীভূত অবস্থায় থাকে।

এরমধ্যে যে পদার্থগুলো থাকে তা হলো- আমিষ (অ্যালবুমিন, গ্লোবিউলিন এবং ফাইব্রিনোজেন), গ্লূকোজ, চর্বি কণা, খনিজ লবণ, ভিটামিন, হরমোন, অ্যান্টিবডি এবং বর্জ্য পদার্থ (কার্বন ডাইঅক্সাইড, ইউরিয়া, ইউরিক অ্যাসিড ইত্যাদি)। এছাড়া সোডিয়াম ক্লোরাইড, সোডিয়াম বাইকার্বনেট ও অ্যামাইনো অ্যাসিড সামান্য পরিমাণে থাকে।

(খ) রক্ত কণিকা :-

মানবদেহে তিন প্রকার রক্ত কণিকা দেখা যায়। যথা-

  1. লোহিত রক্ত কণিকা,
  2. শ্বেত রক্ত কণিকা এবং
  3. অণুচক্রিকা।

১। লোহিত রক্ত কণিকা (RB.C.) :-

রক্ত কণিকার মধ্যে লোহিত রক্ত কণিকার সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এটি শ্বাসকার্যে অক্সিজেন (O2) পরিবহনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। লোহিত রক্ত কণিকায় নিউক্লিয়াস থাকে না, দেখতে অনেকটা বৃত্তের মতো দ্বি-অবতল।

আরও পড়ুন :- সাইটোপ্লাজম কাকে বলে?

একজন পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তির দেহে এর সংখ্যা প্রায় ৫০ লক্ষ। পুরুষের তুলনায় মহিলাদের রক্তে লোহিত কণিকার পরিমাণ কম। তুলনামূলকভাবে শিশুদের দেহে এর পরিমাণ বেশি থাকে। জীবনের প্রতি মুহুর্তে লোহিত রক্ত কণিকা ধ্বংস হয়, আবার সমপরিমাণে উপন্ন হয়।

হিমোগ্লোবিন এক ধরনের রঞ্জক পদার্থ। লোহিত রক্ত কণিকায় এর উপস্থিতির কারণে রক্ত লাল দেখায়। রক্তে উপযুক্ত পরিমাণে হিমোগ্লোবিন না থাকলে রক্ত স্বল্পতা বা রক্তশূন্যতা ( Anemia) দেখা দেয়।

২। শ্বেত রক্ত কণিকা (W.B.C.) :

মানবদেহে কয়েক প্রকার শ্বেত রক্ত কণিকা থাকে। এদের আকার অনিয়মিত, বড় এবং সংখ্যায় লোহিত রক্ত কণিকার চেয়ে কম। প্রতি কিউবিক মিলিমিটারে ৫- ১০ হাজার শ্বেত রক্ত কণিকা থাকে।

লাল অস্থিমজ্জা ও লসিকাগ্রন্থিতে শ্বেত কণিকা তৈরি হয়। এদের রং নেই কিন্তু নিউক্লিয়াস আছে। এদের আকার পরিবর্তন হতে পারে এবং এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যেতে পারে। এরা ক্ষণপদ সৃষ্টির মাধ্যমে রোগ জীবাণু ভক্ষণ করতে পারে। এ প্রক্রিয়ার নাম ফ্যাগোসাইটোসিস।

রক্তে এর পরিমাণ বৃদ্ধি পেলে লিউকেমিয়া রোগ হয়। শ্বেত রক্ত কণিকা দেহে প্রহরীর মতো কাজ করে রোগ জীবাণু ধ্বংস করে এবং অ্যান্টিবডি তৈরি করে।

৩। অণুচক্রিকা (Platelets):

অণুচক্রিকা আকারে ছোট, বর্তুলাকার ও বর্ণহীন। এরা গুচ্ছাকারে থাকে। প্রতি কিউবিক মিলিমিটারে প্রায় ২ লক্ষ ৫০ হাজার অণুচক্রিকা থাকে।

অস্থিমজ্জার মধ্যে অণুচক্রিকা উৎপন্ন হয়। এরা রক্ত জমাট বাঁধতে সাহায্য করে। থ্রোম্বোপ্লাস্টিন নামক এক প্রকার রাসায়নিক দ্রব্য নিঃসরণ করে রক্ত জমাট বাঁধতে সাহায্য করে।

রক্তের কাজ :-

রক্ত দেহের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এটি দেহের নানাবিধ কাজ করে। যেমন-

অক্সিজেন পরিবহন: লোহিত রক্ত কণিকা কোষে অক্সিজেন বহন করে।

কার্বন ডাইঅক্সাইড অপসারণ: নিঃশ্বাস বায়ুর সাথে দেহের কোষে উৎপন্ন CO2 বাইরে বের করে দেয়।

খাদ্যসার পরিবহন: রক্তরস গগ্লুকোজ, অ্যামাইনো অ্যাসিড ও চর্বি কণা ইত্যাদি কোষে সরবরাহ করে।


তাপের সমতা রক্ষা: দেহের সর্বত্র তাপের সমতা রক্ষা করে।

বর্জ্য পদার্থ নিষ্কাশন: রক্ত দেহের সকল দূষিত ও বর্জ্য পদার্থ বহন করে বিভিন্ন অঙ্গের মাধ্যমে ইউরিয়া, ইউরিক অ্যাসিড ও কার্বন ডাইঅক্সাইড হিসেবে নিষ্কাশন করে।

হরমোন পরিবহন : হরমোন সরাসরি রক্তে মিশে প্রয়োজন অনুযায়ী বিভিন্ন অঙ্গে সঞ্চালিত হয়ে বিভিন্ন জৈবিক কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

রোগ প্রতিরোধ: শ্বেত রক্ত কণিকা ফ্যাগোসাইটোসিস প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দেহকে জীবাণুর আক্রমণ থেকে রক্ষা করে।

রক্ত জমাট বাঁধা : অণুচক্রিকা রক্ত জমাট বাঁধতে সাহায্য করে এবং দেহের রক্ত ক্ষরণ বন্ধ করে।

রক্তের গ্রুপ (Blood group) :-

ব্যক্তির লোহিত রক্ত কণিকায় 'A' এবং 'B' নামক দু'ধরনের অ্যান্টিজেন (Antigen ) এবং রক্ত রসে 'a' ও 'b' দু'ধরনের অ্যান্টিবডি (Antibodies) থাকে।

অ্যান্টিজেন এক প্রকারের পদার্থ যা কোন জীবদেহে প্রবেশ করানোর ফলে ঐ জীবদেহে অ্যান্টিবডি তৈরি হয় এবং অ্যান্টিবডি হলো এক প্রকারের পদার্থ যা জীবদেহে রোগের বিরুদ্ধে কাজ করে।

অ্যান্টিজেন ও অ্যান্টিবডির উপস্থিতির উপর ভিত্তি করে মানুষের রক্তকে বিভিন্ন গ্রুপে ভাগ করা যায়। একে রক্তের গ্রুপ বলে।

বিজ্ঞানী কার্লল্যান্ড স্টেইনার (১৯০১) মানুষের রক্তের শ্রেণিবিন্যাস করে তা 'A', 'B', 'O' এবং 'AB' এ চারটি গ্রুপের নামকরণ করেন।

আজীবন মানুষের রক্তের গ্রুপ একই রকম থাকে, পরিবর্তন হয় না। অতএব রক্তে বিভিন্ন অ্যান্টিজেন ও অ্যান্টিবডির উপস্থিতির উপর ভিত্তি করে রক্তের গ্রুপকে চিহ্নিত করা যায়।

নিম্নের ছকে রঙের গ্রুপের অ্যান্টিবডি ও অ্যান্টিজেনের উপস্থিতি দেখানো হলো-
রক্ত

যে গ্রুপ অন্য সকল ব্যক্তিকে রক্ত দিতে পারে তাদের সার্বজনীন রক্তদাতা (Universal Donor) বলে। যেমন- O গ্রুপ।

যে গ্রুপ অপর যে কোনো গ্রুপের ব্যক্তির রক্ত গ্রহণ করতে পারে তাকে সার্বজনীন রক্ত গ্রহীতা (Universal Recipient )বলে। যেমন- AB গ্রুপ।

রক্ত দানের নিয়মাবলি :-

আঘাত, দুর্ঘটনা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা যে কোনো কারণে অধিক রক্ত ক্ষরণ হলে দেহে রক্তের পরিমাণ আশংকাজনকভাবে কমে যায়। রক্ত শূন্যতা পূরণে ঐ ব্যক্তির দেহে রক্ত সংযোজনের প্রয়োজন হয় এবং জরুরী ভিত্তিতে রোগীর দেহে অন্য মানুষের রক্ত দিতে হয়।

বর্তমানে এটি একটি সাধারণ ঘটনা। জরুরী অবস্থায় রক্ত সরাসরি ব্যাড ব্যাংকের মাধ্যমে সংগৃহীত রক্ত রোগীর দেহে প্রবেশ করানো হয়।

শিরার মধ্য দিয়ে বাইরে থেকে অন্যের রক্ত প্রবেশ করানোর প্রক্রিয়াকে রক্ত সংযোজন (Blood transfusion) বলে। তবে কোনও অবস্থাতেই রোগীর রক্তের গ্রুপ ও প্রকৃতি পরীক্ষা না করে অন্য কোনও ব্যক্তির রক্ত প্রবেশ করানো উচিত নয়। ব্যতিক্রম হলে নানা জটিলতা সৃষ্টি এমনকি রোগীর জীবন বিপন্ন হতে পারে।

সুতরাং মনে রাখতে হবে এটি আমাদের সবার জন্য একটি সামাজিক দায়বদ্ধতা। এরূপ পরিস্থিতিতে সকলের সহযোগিতা প্রয়োজন হয়। রোগীর প্রাণ রক্ষার জন্য এটি একটি চমৎকার ফলপ্রদ ব্যবস্থা।

অন্যকে রক্তদান করা একটি মহৎ কাজ। এতে রক্ত দাতার কোনও ক্ষতি হয় না। একজন সুস্থ ব্যক্তি চার মাস অন্তর রক্ত দান করলে দাতার দেহে সামান্যতম অসুবিধা হয় না। আমাদের দেহে প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ২০ লক্ষ লোহিত রক্ত কণিকা সৃষ্টি হতে পারে।

রক্ত দানের সামাজিক দায়িত্ব :-

বর্তমানে সমাজে নানা প্রকার রক্ত দান কর্মসূচি নেওয়া হচ্ছে। সাংগঠনিকভাবে কোন বিশেষ দিবসের অনুষ্ঠানে রক্ত দান কর্মসূচির আয়োজন করা হয়। এতে সাধারণ মানুষের মধ্যে রক্ত দান সম্পর্কে ভুল ধারণা ও ভীতি অনেকাংশে হ্রাস পায়। অতীতের তুলনায় মানুষ এখন রক্ত দান ও গ্রহণ সম্পর্কে যথেষ্ট আগ্রহী ও সচেতন।

রক্ত সংযোজনের সমস্যা :-

রক্তের গ্রুপ ও প্রকৃতি পরীক্ষা না করে রোগীর দেহে রক্ত সংযোজন করলে নিম্নের সমস্যাগুলো দেখা দিতে পারে- রক্ত কণিকাগুলো জমাট বাঁধতে পারে, রক্ত কণিকাগুলো ভেঙ্গে বিশ্লিষ্ট হতে পারে, জন্ডিস, হেপাটাইসিস-বি এর প্রাদুর্ভাব দেখা দিতে পারে, প্রস্রাবের সাথে হিমোগ্লোবিন নির্গত হতে পারে এবং এইড্স এর সংক্রমণ ঘটতে পারে ইত্যাদি।

করণীয় দিকগুলো হলো :-

রক্তের গ্রুপ, রক্তের Rh factor নির্ণয় করা, রোগ জীবাণুর উপস্থিতি নির্ণয় করা এবং সুস্থ ব্যক্তি, আপনজনের নিকট হতে রক্ত সংগ্রহ করা ইত্যাদি।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ