চর্যাপদ কি বা কাকে বলে? চর্যাপদের সমাজচিত্র, আদি কবি কে, আবিষ্কৃত হয় কত সালে

চর্যাপদ কি বা কাকে বলে :-

বাংলা সাহিত্যের সামগ্রিক ইতিহাসকে তিন যুগে ভাগ করা হয়েছে। এর প্রথম যুগের নাম প্রাচীন যুগ। তবে কেউ কেউ আরও কয়টি নামে এ যুগকে অভিহিত করেছেন। 
সে নামগুলো হল: আদ্যকাল, গীতিকবিতার যুগ, হিন্দু-বৌদ্ধ যুগ, আদি যুগ, প্রাক-তুর্কি যুগ, গৌড় যুগ ইত্যাদি। তবে প্রাচীন যুগ নামটির ব্যবহার ব্যাপক ও যথার্থ যুক্তিসঙ্গত।

বাংলা ভাষায় রচিত প্রাচীন যুগে প্রাচীনতম গ্রন্থটির নাম চর্যাপদ। গ্রন্থটির মূলনাম অজ্ঞাত তবে চর্যার টীকাকার মুনিদত্তের টিকা বা ভাষ্যরচনা থেকে পাওয়া অনুমিত শিরোনাম যথাক্রমে 'চর্যাচর্যবিনিশ্চয়' ও ‘চর্যাগীতিকোষবৃত্তি'। 

আসল নাম যাই হোক, বাংলায় তা 'চর্যাপদ' কিম্বা 'চর্যাগীতি'-এই দুটি নামেই প্রচলিত। অধ্যাপক মণীন্দ্রমোহন বসু, রচিত 'চর্যাপদ' ও ড. সুকুমার সেন-রচিত 'চর্যাগীতি’ এর প্রমাণ।

আরও পড়ুন :- বৈষ্ণব পদাবলী কি?

চর্যাপদের আবিষ্কর্তা ও আবিষ্কারকাল :-

চর্যাপদ আবিষ্কৃত হয় কত সালে এই প্রশ্নের উত্তরে বলা যায় ১৯০৭ সালে নেপালের রাজদরবারের গ্রন্থাগার থেকে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী (ভট্টাচার্য) চর্যাপদের পুঁথির সন্ধান পান। তবে ''চর্যাগীতি কোষ’, কৃষ্ণাচার্যের ‘দোহাকোষ’, সরহবজ্রের ‘দোহাকোষ’ ও ‘ডাকার্ণব’ পুঁথিকে একত্র করে ১৯১৬ সালে হাজার বছরের পুরাণ বাংলা ভাষায় ‘বৌদ্ধগান ও দোহা' এই শিরোনামে 'বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ' কলকাতা থেকে প্রকাশ করেন।
চর্যাপদ কি

রচনাকাল :-

'চর্যাপদে'র ভাষা দুর্বোধ্য ও সাংকেতিক। আলো অন্ধকারের মধ্যবর্তী অস্পষ্ট | হেয়ালিপূর্ণ ভাষায় সেগুলি রচিত। গ্রন্থটির | আবিষ্কারক হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, গ্রন্থের ব্যাখাতা ডঃ সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় ও ডঃ সুকুমার সেন প্রমুখ চর্যাগীতি গুলিকে দশম ও দ্বাদশ শতকের রচনা বলে মনে করেন।

চর্যাপদের গ্রন্থ ও অনুবাদ :-

নেপাল রাজদরবারে প্রাপ্ত সংকলিত গ্রন্থটির নাম ছিল 'চর্যাগীতিকোষ'। গ্রন্থের আবিষ্কর্তা শাস্ত্রী মহাশয় তাঁর নতুন নামকরণ করেন 'চর্যাচর্যবিনিশ্চয়।' 'চর্যাগীতিকোষ' গ্রন্থটি মূলতঃ টীকা বা ভাষ্য রচনা।

চর্যার তিব্বতী অনুবাদকের নাম মুনি দত্ত। মুনিদত্তের টীকানুসারে 'চর্যাগীতিকোষ'-এর অন্য একটি নাম পাওয়া যায় এটি হলো 'আশ্চর্যচর্যাচয়'। তিব্বতী অনুবাদ অনুসারে মুনি দত্ত মোট পঞ্চাশটি চর্যার টীকা রচনা করেন।

'চর্যাগীতিকোষ’ শ্রেণীর গ্রন্থ প্রাচীন ভারতে দুর্লভ ছিল না, তা চর্যাগীতি কোষের তিব্বতী অনুবাদের আবিষ্কারেই প্রমাণ হয়ে যায়।

চর্যাপদের পদকর্তা কতজন ও তার সংখ্যা :-

চর্যাগীতিতে লুইপাদ, সরহপাদ, কাহ্নপাদ প্রভৃতি নাম উপাধিযুক্ত ২৪ জন পদকর্তার ৫১ টি পদ সংকলিত হয়েছিল। তার মধ্যে সাড়ে ছেচল্লিশটিপদ অক্ষত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছে।

চর্যাগীতিতে সংকলিত পদগুলির মধ্যে সর্বাধিক সংখ্যক পদের রচয়িতা কাহ্নপাদ (পদসংখ্যা ১০টি) তারপরে ভুসুকুপাদ (পদসংখ্যা-৮) এবং সরহ বা সরহপাদ (পদ সংখ্যা-৪), বাকিপদ কর্তাগণের কেউ তিনটি কেউ দুটি এবং কেউ একটি করে পদ রচনা করেন।

চর্যাপদের সমাজচিত্র :-

চর্যাগীতিগুলির বেশির ভাগই রচিত হয়েছে বাংলা দেশ ও বাঙালি-জীবনের পটভূমিকায়। ফলে প্রাচীন বাংলা ও বাঙালির জীবনের নানা অনুষঙ্গ এসেছে চর্যার গানে।

অবশ্য সেখানে বাস্তব জীবনের ছবিগুলি অধ্যাত্ম সংগীতে এক একটা আবরণ বা রূপকের ছদ্মবেশ নিয়ে ধরা পড়েছে। ফলে দৈনন্দিন জীবনের রূপ সেখানে রূপক অথবা সাংকেতিক অর্থদ্যোতক হয়ে উঠেছে।

তাসত্ত্বেও সেকালের নর-নারীর সুখ-দুঃখ কেন্দ্রিত জীবনচর্যা তাদের আচার-ব্যবহার রীতি-নীতি, হাস্য-পরিহাস, বৃত্তি, ব্যবসা-বাণিজ্য অর্থনৈতিক-অবস্থান, দাম্পত্য জীবনের প্রেম-প্রীতি-অনুরাগ-বিরাগ, সংশয়, বিশ্বাস, আমোদ-প্রমোদ প্রভৃতি খুটিনাটির বর্ণনায় আভাষে ইঙ্গিতে প্রকাশিত হয়েছে।

সুতরাং প্রাচীন বাংলার সমাজ জীবনের ঐতিহাসিক দলিল রূপে ‘চর্যাগীতি’গুলিকে গ্রহণ করা যায়।

চর্যাকারগণের অনেকেই সমাজজীবনের উচ্চ পর্যায়ের অধিবাসী ছিলেন। তাঁদের কেউ ব্রাহ্মণ, কেউ ক্ষত্রিয়, কেউ রাজপুরুষ, কেউ রাজপুত্র, কেউ কায়স্থ বা কেউ ছিলেন রাজ বণিক।


তবে চর্যায় যে জীবনচিত্রের প্রতিফলন রয়েছে তাতে উচ্চ জীবনধারার পরিচয় নেই। অধিকাংশ পদে অন্ত্যজিজাতির দৈনন্দিন জীবনযাত্রার বেদনাবিধূর চিত্র অঙ্কিত হয়েছে।

চর্যায় তত্বকথায় যা-ই থাকুক না কেন, সেখানে চিত্র ফুটেছে সাধারণ মানুষের জীবনের। চর্যায় নদ-নদী, নৌযাত্রা, নৌকার বিভিন্ন অংশের পারিভাষিক নাম নৌবাণিজ্য, জলদস্যুদের হানা ইত্যাদি সম্পর্কে যে বর্ণনা পাওয়া যায় তাতে চর্যার পটভূমি যে নদীমাতৃক তাতে সন্দেহ নেই।

মগধ, উড়িষ্যা, বাংলা ও কামরূপ এসব অঞ্চলের বিস্তৃত পটভূমিকায় চর্যার জীবনচিত্র অঙ্কিত হলেও বাঙালির জীবনচিত্র হিসেবে বিশেষ দাবি অযৌক্তিক নয়।

ধর্ম ও দর্শন :-

চর্যাগীতিগুলিতে যে ধর্ম ও দর্শনের পরিচয় ফুটে উঠেছে তা সাধারণভাবে বৌদ্ধ তান্ত্রিক-সহজিয়া ধর্ম-দর্শন নামে খ্যাত। সহজিয়া দর্শনের উৎপত্তির মূলে বৌদ্ধ ধর্ম সম্প্রদায়ের বিবর্তন প্রক্রিয়ায় গৃহীত ধর্ম ও দর্শনকেন্দ্রিত বিশ্বাস বর্তমান।

ভগবান বুদ্ধ প্রচারিত ধর্ম-দর্শন সাধারণ ভাবে বৌদ্ধ ধর্ম-দর্শন নামে পরিচিত।

এই ধর্মের মূল কথা অহিংসা, সদাচার, সর্বজীবে প্রেম, সৎকর্মানুষ্ঠানের দ্বারা আত্মোন্নতি এবং দুঃখবিনাশের দ্বারা পুনর্জন্মকেন্দ্রিত 'ভচক্র' থেকে নির্বাণ, মোক্ষ বা মুক্তি।

ভগবান বুদ্ধের বাণী ও উপদেশ-সংকলিত হয়ে 'ত্রিপিটক' নামক ধর্মগ্রন্থে লিপিবদ্ধ হয়। বস্তুতঃ বৌদ্ধধর্মের দার্শনিক উপলব্ধির আকর গ্রন্থ এই ত্রিপিটক।

হিন্দুদের কাছে যেমন 'বেদ', মুসলমানদের তেমন 'কোরান' বা 'কোরআন' বৌদ্ধদের কাছে তেমনি 'ত্রিপিটক'।

গ্রন্থখানি তিনটি পিটকে অর্থাৎ পর্বে বা ভাগে বিভক্ত। পর্বগুলি যথাক্রমে 'সুত্রপিটক', 'বিনয়পিটক' ও 'অভিধম্মপিটক'। 'ত্রিপিটক' বুদ্ধদেবের মৃত্যুর পর সংকলিত হয়।

চর্যাপদের সাহিত্যিক মূল্য বিচার :-

চর্যাপদ প্রধানত তত্ত্ববাদের বাহন, গৌণত কবিতা। বৌদ্ধ সিদ্ধ আচার্যদের রচনা হিসেবে চর্যাপদের মধ্যে ধর্মীয় অনুভূতি প্রকাশ পেলেও এর সাহিত্যিক মূল্য অবশ্যস্বীকার্য।

চর্যাকারগণ সচেতনভাবে কাব্য রচনা করেন নি, কিন্তু তাঁদের বিশেষ রহস্যবাদী সম্প্রদায়ের গূঢ় ভজনাবলি হলেও এতে স্বতঃস্ফূর্ত রসের আবেদন এবং বাকনির্মিতির শিল্পকৌশল বিদ্যমান থেকে তাকে কাব্যের পর্যায়ে উন্নীত করেছে। এতে সাধকদের হৃদয়ভাব সার্থক মাধ্যমে বিবৃত হয়েছে বলে চর্যার সাহিত্যিক মূল্য সম্পর্কে সন্দেহ নেই।

চর্যাপদের বক্তব্য কেবল জ্ঞানের নয়, ভাবের বিষয় এবং তাকে ব্যক্ত করার উপযুক্ত সার্থক মাধ্যমও চর্যাকারেরা আহরণ করেছিলেন। এ কারণেই চর্যাপদের সাহিত্যিক মূল্য অবশ্য স্বীকার্য। জীবন ঘনিষ্ঠ জ্ঞানচেতনার শৈল্পিক রূপায়ণেই চর্যাপদের সাহিত্যমূর্তি গঠিত হয়েছে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ