অনুবাদ সাহিত্য কাকে বলে? অনুবাদ সাহিত্য সৃষ্টির কারণ, গুরুত্ব ও বৈশিষ্ট্য?

বাংলা অনুবাদ সাহিত্যের সূচনা হয়েছিল আদি-মধ্যযুগে। কবিবর মালাধর বসুর ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়' নির্দিষ্ট সন তারিখযুক্ত প্রথম বাংলা অনুবাদ করেন ।

মহাকবি কৃত্তিবাসের 'রামপাঁচালী'র রচনাকাল আনুমানিক হলেও প্রাচীনত্বের দিক থেকে প্রথম হওয়া সম্ভব।

ভাগবত অথবা রামায়ণ ও মহাভারতের বিভিন্ন অনুবাদের মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষার ও বাঙালির সারস্বত সাধনার অগ্রগতির ইতিহাস ত্বরান্বিত হয়েছিল।

প্রাচীন ঐতিহ্যের সঙ্গে বর্তমানের অন্বয় বাঙালির সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারকে করেছিল সুদৃঢ়। বাংলা অনুবাদ করা সাহিত্যের ঐতিহাসিক গুরুত্ব বোধকরি এখানেই।


অনুবাদ সাহিত্য কাকে বলে :-

অনুবাদ সাহিত্য বলতে বোঝায় মূল ভাষা থেকে অন্য কোনো ভাষায় অনূদিত সাহিত্যকে।

একটি ভাষার সাহিত্যিক রচনাকে অন্য ভাষায় অনুবাদ করা হলে সেটিকে অনুবাদ সাহিত্য বলা হয়। যেমন - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'ঘরে বাইরে' কবিতাটিকে ইংরেজিতে অনুবাদ করা হলে সেটি অনুবাদ সাহিত্যের একটি উদাহরণ।

সাধারণত একটি দেশ বা ভাষা-সংস্কৃতির মানুষের কাছে অপরিচিত থাকা সাহিত্যিক রচনাগুলো অন্য ভাষায় অনুবাদ করে তুলে ধরা হয়, যাকে অনুবাদ সাহিত্য বলে।

অনুবাদ সাহিত্য সৃষ্টির কারণ :-

অনুবাদ সাহিত্যের সৃষ্টির পেছনে বিভিন্ন কারণ রয়েছে, যার মধ্যে প্রধান:

1. ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র: বিভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতির মানুষের মধ্যে সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক বিনিময়ের জন্য অনুবাদ প্রয়োজন।

2. সাহিত্যিক প্রভাব: বিশ্বসাহিত্যের উপর প্রভাব এবং নতুন ধারা-প্রবণতা চর্চার জন্য অন্য ভাষার সাহিত্য অনুবাদ করা হয়।

3. মূল্যবোধ ও ঐতিহ্য চর্চা: বিখ্যাত সাহিত্যিক ও লেখকের রচনা অনুবাদ করে ঐ ঐতিহ্যকে চর্চা করা।

4. সাহিত্যিক উন্নয়ন: অন্যদের সাহিত্য চর্চা ও অনুবাদ নিজের সাহিত্য উন্নয়নে সাহায্য করে।

5. পাঠক সমাজের প্রয়োজন: পাঠকের চাহিদা মেটাতে তাদের পছন্দের লেখক ও সাহিত্যিকদের রচনা অনুবাদ করা হয়।

এছাড়াও বাণিজ্যিক লাভ, মানসিক উপকারিতা, ঐতিহ্য চর্চার প্রয়োজন ইত্যাদি কারণে অনুবাদ সাহিত্যের সৃষ্টি হয়ে থাকে।

অনুবাদ সাহিত্যের উদ্ভব ও বিকাশ :-

অনুবাদ সাহিত্যের উদ্ভব এবং বিকাশ সম্পর্কে নিম্নরূপ ধারণা দেওয়া যেতে পারে:

উদ্ভব:

• প্রাচীন সময় থেকেই বিভিন্ন সংস্কৃতির মাঝে সাহিত্যিক বিনিময়ের কথা পাওয়া যায়। তবে প্রকৃত অর্থে অনুবাদ সাহিত্যের শুরুটা হয়েছিল গ্রীক ও রোমান সভ্যতার যুগ থেকে।
• ভারতীয় উপমহাদেশে, বৌদ্ধ ও জাতক গল্পকে বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত করা হয়েছিল খুব শীঘ্রই।

বিকাশ:

• পশ্চিমা দেশগুলিতে রনেসাঁ যুগের সাথে সাথে ব্যাপক অনুবাদ কাজ হয়েছিল গ্রীক-রোমান সাহিত্যের।
• ভারতে, ১৯শ শতাব্দীতে ইংরেজি শিক্ষার প্রসার ঘটে এবং বিশ্বসাহিত্যের অনেক রচনা বাংলায় অনূদিত হয়।
• ২০শ শতাব্দীতে অনুবাদ কর্মকাণ্ড সমৃদ্ধ হয় এবং একটি পেশা হিসেবে গড়ে ওঠে।
• বর্তমানে বিশ্বের প্রায় সব ভাষায় অনুবাদ কর্মকাণ্ড চলমান রয়েছে এবং এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে।

অনুবাদ সাহিত্য পড়ার গুরুত্ব :-

অনুবাদ সাহিত্য পড়ার কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক নিচে বর্ণিত:

১. অন্য সংস্কৃতি ও চিন্তাভাবনার সাথে পরিচয়:

অন্য দেশের সাহিত্য অনুবাদ করে সেই সংস্কৃতি, চিন্তা-ভাবনা ও মানসিকতার সাথে পরিচয় ঘটে।

২. নতুন ধারণা ও শিল্পগত উন্নয়ন:

বিশ্বসাহিত্যের নতুন ধারা-প্রবণতা ও শিল্পগত উন্নয়নের সাথে পরিচয় ঘটে।

৩. মানসিক ঐতিহ্যের সৃজন:

বিখ্যাত সাহিত্যিকদের রচনা অনুবাদ হওয়ায় মানসিক ঐতিহ্য গড়ে উঠে।

৪. ভাষা শিক্ষার সুবিধা:

অন্যভাষা শিক্ষার এবং নিজের ভাষা-চেতনা উন্নয়নে সুবিধা প্রদান করে।

৫. সাহিত্যিক উন্নয়নে সাহায্য:

অন্যের সাহিত্য থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজেদের সাহিত্যিক উন্নয়নে সাহায্য পাওয়া যায়।

অনুবাদ সাহিত্য বৈশিষ্ট্য :-

অনুবাদ সাহিত্যের কিছু প্রধান বৈশিষ্ট্য নিম্নরূপ:

১) মূল সাহিত্যকর্মের ওপর নির্ভরশীল:

অনুবাদকৃত কোন সাহিত্যকর্মের মান নির্ভর করে মূল সাহিত্যকর্মের উপর। মূলটি যতটা ভাল, অনুবাদটিও ততটাই ভাল।

২) সংক্ষিপ্ততার প্রবণতা:

অনেক সময় মূল রচনার তুলনায় অনুবাদকৃত রচনাটি সংক্ষিপ্ত হয়। এর কারণ, অনুবাদকারী অনা঵শ্যক বিবরণ এড়িয়ে যেতে পারেন।

৩) সংস্কৃতিগত পরিবর্তন:

অন্য সংস্কৃতি ও ভাষার কোন সাহিত্যকর্ম অনূদিত হলে সংস্কৃতিগত কিছু পরিবর্তন হওয়া স্বাভাবিক।

৪) ভাষাগত মনোভাব বজায় রাখা কঠিন:

অনুবাদকারীর জন্য মূল রচনার ভাষাগত মনোভাব ধরে রাখা খুবই কঠিন কাজ।

৫) মূল রচয়িতার কল্পনার সীমাবদ্ধতা:

অনুবাদকৃত সাহিত্যকর্ম মূল রচয়িতার কল্পনার আরেকটি প্রকাশ। সুতরাং এর মধ্যে মূল লেখকের সীমাবদ্ধতাও রয়েই যায়।

সংস্কৃত থেকে বাংলা অনুবাদ করা কিছু পৌরাণিক কাব্যের নাম ও লেখকদের নাম :-

মূলগ্রন্থ / উৎসবাংলা অনুবাদ করা গ্রন্থ অনুবাদ করা কাব্যের লেখকদের নাম
বাল্মীকি-রামায়ণ, অধ্যাত্ম রামায়ণ, অদ্ভুত রামায়ণ, যোগবাশিষ্ট রামায়ণ এবং রামকথা বিষয়ক অন্যান্য পুরাণ।রামায়ণকৃত্তিবাস, অদ্ভুতাচার্য, চন্দ্রাবতী, দ্বিজ গঙ্গা-নারায়ণ, ঘনশ্যাম দাস, ভবানীদাস, দ্বিজ লক্ষ্মণ, রামশঙ্কর, কৈলাস বসু, ষষ্ঠীবর সেন, শিবচন্দ্র সেন, রামমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, রামানন্দ ঘোষ, রঘুনন্দন গোস্বামী, কবিচন্দ্র শঙ্কর চক্রবর্তী ইত্যাদি
ব্যাসকৃত মহাভারত, জৈমিনি-ভারত ও অন্যান্য পুরাণ কথা।মহাভারত ও রামায়ণকবীন্দ্র পরমেশ্বর, শ্রীকর নদী, সঞ্জয়, রামচন্দ্র খান, দ্বিজ রঘুনাথ, কাশীরাম দাস, দ্বিজ অভিরাম, নিত্যানন্দ ঘোষ, দ্বৈপায়ন দাস, কৃষ্ণরাম ইত্যাদি।
ভাগবত পুরাণ (ব্যাসদেব কৃত), বিষ্ণুপুরাণ, হরিবংশ প্রভৃতি।ভাগবত (শ্রীকৃষ্ণবিজয়, কৃষ্ণমঙ্গল, গোবিন্দমঙ্গল, গোপালবিজয়, কৃষ্ণপ্রেম তরঙ্গিণী)।মালাধর বসু, সনাতন বিদ্যাবাগীশ, কৃষ্ণদাস, কৃষ্ণকিঙ্কর, দ্বিজ হরিদাস, অভিরাম দত্ত, কবি শেখর, কবিচন্দ্র, দ্বিজ মাধব, পরশুরাম চক্রবর্তী ইত্যাদি।

বাংলা অনুবাদ কারী রামায়ণ এর লেখকগণ :-

কৃত্তিবাস :-

বাংলা ভাষায় অনুবাদ করা চর্চার প্রথম যুগে বাল্মীকির রামায়ণকে যিনি বাংলা ভাষায়, বাঙালির মতো করে বাঙালির কাছে উপস্থিত করেন তিনি 'বঙ্গের অলংকার' কবি কৃত্তিবাস। কৃত্তিবাস বাঙালির জাতীয় জীবনের কবি।
বাংলা অনুবাদ সাহিত্য কি

তাঁর ‘শ্রীরামপাঁচালী' বাঙ্গালির জাতীয় মহাকাব্য। কৃত্তিবাসী রামায়ণ রচিত হয় পঞ্চদশ শতকে। সুদীর্ঘ কাল ধরে বাঙালির হৃদয়ে যে আনন্দসুধা দান করেছেন কবি কৃত্তিবাস তা অন্য কোনও বাঙালি কবির পক্ষে সম্ভব হয়নি। বাঙালির হৃদয়ে অক্ষয় কীর্তি স্থাপন করেছেন কবি।

কৃত্তিবাসের কাব্য মূলত ভাবানুবাদ। বাঙালি সমাজ ও লোক জীবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত। কৃত্তিবাসের কাব্য বাঙালীর একান্নবর্তী পরিবারের আদর্শ ও ভক্তিরসের ফল্গুধারায় অভিসিঞ্চিত করে চলেছে বাঙালির হৃদয়।

বাল্মীকির গ্রন্থ ছাড়াও ‘অদ্ভুত রামায়ণ', 'অধ্যাত্ম রামায়ণ', ‘জৈমিনি ভারত' প্রভৃতি থেকে উপকরণ সংগ্রহ করেছেন। মূল রামায়ণে রাম বীর চরিত্র, শ্রীরামপাঁচালীতে রামের বীরত্ব ততটা লক্ষ্য করা যায় না। বাঙালির প্রিয় খাদ্য তালিকাও কৃত্তিবাসের কাব্যে স্থান করে নিয়েছে।

অদ্ভুতাচার্য :-

ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর কর্মচারী বুকানন কর্মসূত্রে উত্তরবঙ্গে গিয়ে অদ্ভুত আচার্য নামে এক কবির সন্ধান পান, যিনি রামায়ণ অনুবাদ করেছিলেন।

পাবনা শহরের কাছে অমৃতকুণ্ডা গ্রামে ১৬৪৭ খ্রীঃ অদ্ভুতাচার্য জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর কাব্যের নাম 'অদ্ভুত রামায়ণ'। সপ্তদশ শতকে উত্তরবঙ্গে অদ্ভুতাচার্যের রামায়ণ প্রচলিত ছিল এবং তাতে কিছু প্রতিভার পরিচয় মেলে একথা স্বীকৃত।

চন্দ্রাবতী :-

মধ্যযুগের বাংলা ভাষাতে যে সমস্ত মহিলা কবি সাহিত্যচর্চা করে গেছেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম চন্দ্রাবতী। তিনি ছিলেন মধ্যযুগের প্রসিদ্ধ মনসামঙ্গলের কবি বংশীদাসের কন্যা। তিনি মনসার ভাসান, মহুয়া এবং কেনারাম প্রভৃতি কয়েকটি ক্ষুদ্র গাথা রচনা করলেও তাঁর বাংলা অনুবাদ করা রামায়ণই সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য।

আরও পড়ুন :- মঙ্গলকাব্য কি ও কয়টি? 

রঘুনন্দন গোস্বামী :-

রামায়ণ অনুবাদকদের মধ্যে খুবই আধুনিক কালের একজন হলেন রঘুনন্দন গোস্বামী। তিনি মোটামুটি উনিশ শতকের শেষ দিকে জন্মগ্রহণ করেন বর্ধমান জেলার নাড় গ্রামে। নিত্যানন্দ বংশোদ্ভূত কবির পিতা ছিলেন কিশোরীমোহন।

তাঁর লেখা কাব্যের নাম 'রামরসায়ণ'। বৈষ্ণব পরিমন্ডলের মানুষ হওয়ার কারণে এ কাব্যে কিছুটা বৈষ্ণব ভাবাদর্শে প্রাণিত। মূল রামায়ণের অনেক অংশই এ কাব্যে না থাকলেও কবির শব্দবিন্যাস ও ছন্দোমাধুর্য প্রশংসনীয়।

কবিচন্দ্র শঙ্কর চক্রবর্তী :-

সপ্তদশ শতকের একজন রামায়ণ অনুবাদক কবি কবিচন্দ্র শঙ্কর চক্রবর্তী। দীর্ঘজীবী কবির জন্ম ১৫৯৬ খ্রীষ্টাব্দে বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুর মহকুমার অন্তর্গত পানুয়া (বর্তমানে পেনো গ্রামে)। মৃত্যু ১৭১২ খ্রীষ্টাব্দে ১১৬ বছর বয়সে।

জানা যায়, তিনি রামায়ণ ছাড়াও ভাগবত, মহাভারত, শিবায়ণ প্রভৃতি কাব্য রচনা করেন। মল্ল রাজবংশের আশ্রিত কবির রচনা অনেকাংশেই কৃত্তিবাসী রামায়ণের সঙ্গে মিশে গেছে বলে মনে করেন ডঃ দীনেশচন্দ্র সেন।

বাংলা অনুবাদ কারী মহাভারতের লেখকগণ :-

কবীন্দ্র পরমেশ্বর :-

সংস্কৃত মহাভারতের প্রথম বাংলায় অনুবাদ রূপ দেন কবীন্দ্র পরমেশ্বর। সুলতান হুসেন শাহের সেনাপতি ও চট্টগ্রামের শাসনকর্তা পরাগল খানের আজ্ঞায় কবীন্দ্র পরমেশ্বর তাঁর কাব্য রচনা করেছিলেন বলে এ কাব্যের নাম ‘পরাগলী মহাভারত। গবেষকদের অনুমান ১৫০০ থেকে ১৫১৫ খ্রীঃ মধ্যবর্তী সময়ে ‘'পরাগলী মহাভারত রচিত হয়।

যাইহোক, প্রথম যুগের মহাভারত অনুবাদক হিসাবে কবীন্দ্র পরমেশ্বর সাফল্য অর্জন করেছেন। কাহিনী বর্ণনায় সাবলীল গতি উঁচু দরের কবিত্বের প্রমাণ। নাটকীয় ভঙ্গীতে কাহিনী পরিবেশনা, উৎপ্রেক্ষা-অলংকারের সফল প্রয়োগ, পয়ার ত্রিপদী ছন্দের কুশল ব্যবহার কাব্যটিকে সরসতা দান করেছে।

শ্রীকর নন্দী :-

শ্রীকর নন্দী মহাভারতের বাংলা অনুবাদ করেছিলেন ছুটি খানের পৃষ্ঠপোষকতায়। প্রশ্ন হোল, এই ছুটি খান কে? সুখময় মুখোপাধ্যায় প্রমুখ গবেষক বলেন ছুটি খানের আর এক নাম নসরৎ শাহ। তিনি হসেন শাহের পুত্র। কিন্তু বেশিরভাগের ধারণা পরাগল খানের পুত্র ছুটি খান।

যাইহোক, ছুটি খানের প্রেরণায় শ্রীকর নন্দীর কাব্য রচিত বলে এ কাব্য 'ছুটিখানী মহাভারত' নামেই বেশি পরিচিত। গবেষকদের অনুমান ১৫১২ থেকে ১৫১৯ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে এ কাব্য রচিত। শ্রীকর নন্দী কবীন্দ্র পরমেশ্বরের মতো সম্পূর্ণ মহাভারত অনুবাদ করেননি। কবি ‘জৈমিনি সংহিতা' অবলম্বনে মহাভারতের শুধুমাত্র অশ্বমেধ পর্বই অনুবাদ করেছিলেন।

কাশীরাম দাস :-

বাংলা মহাভারতের শ্রেষ্ঠ অনুবাদক কাশীরাম দাস। বর্ধমান জেলার ইন্দ্রাণী পরগণার সিঙ্গি গ্রামে কায়স্থ পরিবারে কবির জন্ম। পৈতৃক উপাধি ‘দেব'।

আরও পড়ুন :- সমাপিকা ও অসমাপিকা কাকে বলে?

তাঁর কাব্যের নাম 'ভারত পাঞ্চালী'। সপ্তদশ শতকের প্রথম দশক 'ভারত পাঞ্চালী'র রচনাকাল ।

“আদিসভা বন বিরাটের কতদূর ইহা রচি কাশীদাস গেলা স্বর্গপুর।”

বীররস প্রধান কাহিনীর সঙ্গে ভক্তিভাব মিশে এক অপরূপ আস্বাদ নির্মিত হয়েছে এ কাব্যে। কবি কাশীরাম বাঙালি, কাব্যের ভাষা বাংলা, কাব্যের পাঠক বাঙালির জন্য কোথাও ভাবানুবাদ, কোথাও আক্ষরিক অনুবাদ, কোথাও সারানুবাদ করে অষ্টাদশ পর্বে কাব্যটিকে বিন্যস্ত করেছিলেন।

কবিচন্দ্র শংকর চক্রবর্তী :-

রাঢ়বঙ্গের কবি কবিচন্দ্র শঙ্কর চক্রবর্তী বাংলায় মহাভারত অনুবাদ করেছিলেন। বিষ্ণুপুর মহকুমার অন্তর্গত পানুয়া গ্রামে তাঁর জন্ম। অষ্টাদশ শতকের একেবারে প্রথম দিকে তাঁর কাব্য রচিত হয়। কাব্যে জোরালো কোনো কবিত্বশক্তি না থাকায় তা তেমন জনপ্রিয় হয়নি। তাছাড়া কাশীরাম দাসের কাব্যের আড়ালে অনেক কবির প্রতিভাই ঢাকা পড়ে গেছে।

ভাগবতের বাংলা অনুবাদ কারী লেখকগণ :-

মালাধর বসু :-

বাংলা অনুবাদ সাহিত্যের মধ্যে প্রথম সন তারিখ যুক্ত গ্রন্থ মালাধর বসুর ‘শ্রীকৃষ্ণ বিজয়' কাব্য। মালাধর বসু প্রাক চৈতন্য যুগের কবি। মালাধর বসুর জন্ম বর্ধমান জেলার কুলীন গ্রামে। পিতা ভগীরথ, মাতা ইন্দুমতী।

গৌড়েশ্বর রুকনুদ্দিন বারবক শাহ কবির কাব্য রচনায় পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন ও কবিকে 'গুণরাজখাঁ’ উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন।

'ভাগবত'কে বৈষ্ণব সমাজ ও সম্প্রদায়ের উপনিষদ বলা হয়। মালাধর বসু ভাগবতের দশম ও একাদশ স্কন্দের অনুবাদ করেন। ১৪৭৩ খ্রীঃ গ্রন্থ রচনা শুরু করেন ও ১৪৮০ খ্রীঃ শেষ করেন। কাব্যের নাম দেন 'শ্রীকৃষ্ণবিজয়’ বা ‘শ্রীকৃষ্ণমঙ্গল'।

'শ্রীকৃষ্ণবিজয়' কাব্যে শ্রীকৃষ্ণের ঐশী মাহাত্ম্যই প্রধান বিষয়বস্তু। কৃষ্ণের আবির্ভাবের কারণ এবং তাঁর জন্ম থেকে দেহত্যাগ পর্যন্ত কাহিনী এ কাব্যের বিষয়। কাব্যটি তিনটি খণ্ডে বিভক্ত।

‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়' সংস্কৃত পুরাণ গ্রন্থের অনুবাদ হলেও বাঙালির নিজস্ব মনোভঙ্গী প্রকাশিত হয়েছে। মালাধর বসু কৃষ্ণকে প্রথম প্রাণনাথ বলে সম্বোধিত করেছেন। 'নন্দের নন্দন কৃষ্ণ মোর প্রাণনাথ'। সাহিত্যগুণের কথা বাদ দিলেও বাংলায় বৈষ্ণব ঐতিহ্যের প্রথম প্রবেশক গ্রন্থ হিসেবে ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’ এর গুরুত্ব ভীষণভাবে স্বীকৃত।

রঘুনাথ ভাগবতাচার্য  :-

বাংলা ভাষায় ভাগবত অনুবাদক হিসেবে রঘুনাথ ভাগবতাচার্যের গ্রন্থ 'শ্রীকৃষ্ণ প্রেমতরঙ্গিনী' উল্লেখযোগ্য।

আরও পড়ুন :- ক্রিয়ার কাল কাকে বলে?

তিনি মূল ভাগবতের প্রথম নয়টি স্কন্দ সংক্ষিপ্ত রূপে ও শেষ তিনটি স্কন্দ পূর্ণাঙ্গ আকারে অনুবাদ করেছিলেন। কবি চৈতন্যভক্ত ছিলেন বলে চৈতন্যকে অবতার রূপে দেখেছেন।

দ্বিজ মাধব বা মাধবাচার্য :-

দ্বিজ মাধব বা মাধবাচার্য হলেন ভাগবতের অনুবাদক কবি। তাঁর কাব্যের নাম ‘শ্রীকৃষ্ণমঙ্গল’। ভাগবতের গুরুগম্ভীর বিষয়কে লোকসমাজের উপযোগী করে সহজ সরল ভাষায় ‘শ্রীকৃষ্ণমঙ্গল’ কাব্য রচিত।

মহাপ্রভুকে অবতাররূপে দেখাতে চেয়েছেন কবি। পান্ডিত্য নয়, আবেগ ও সহৃদয়তার গুণে এ কাব্য পাঠকসমাজে সমাদৃত। এ কাব্যের বিশেষত্ব হল কৃষ্ণলীলার ‘দানখন্ড’। ‘নৌকাখন্ড’ অংশও এখানে আছে।

ভাগবত মূলত বীররসাত্মক কাব্য, কিন্তু ভবানন্দের 'হরিবংশ' কাব্য কামাসক্তির বিকৃত প্রকাশে অনেকটাই স্থূল রুচির বাহক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হরিবংশ গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ১৩৩৯ বঙ্গাব্দে। কাব্য পরিণতিতে শ্রী রাধার দ্বারকায় গিয়ে শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে সাক্ষাতের বিবরণও পাওয়া যায়।

ভবানন্দ :-

বাংলা ভাষায় ভাগবত অনুবাদক কবিদের মধ্যে ভবানন্দ একটি বিতর্কিত নাম। ভাগবত মূলত বীররসাত্মক কাব্য, কিন্তু ভবানন্দের 'হরিবংশ' কাব্য কাম আসক্তির বিকৃত প্রকাশে অনেকটাই স্থূল রুচির বাহক।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হরিবংশ গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ১৩৩৯ বঙ্গাব্দে।

ভবানন্দের কাব্যে যথেষ্ট অভিনবত্ব আছে। তাঁর কাব্যে রতি বর্ণনার একটা কৈফিয়ও তিনি দিয়েছেন। তাছাড়া বস্ত্রহরণ, বাঁশিচুরি, রাস প্রভৃতির বর্ণনা যেমন এখানে আছে, তেমনি কাব্য পরিণতিতে আছে শ্রীরাধার দ্বারকায় গিয়ে শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে সাক্ষাতের বিবরণ। রাধা কৃষ্ণ শরীরে লয়প্রাপ্ত হন। এ বর্ণনা অভিনব।

এ কাব্যে রাধার আর এক নাম 'তিলোত্তমা' যা নিছকই কবিকল্পনা। যা এ কাব্যে কবির বিলাসপ্রিয়তার অনেক প্রমাণ পাওয়া গেলেও সুললিত ভাষাভঙ্গী, সাবলীল ছন্দরীতি, অলংকার নৈপুণ্য ও চরিত্রসৃষ্টিতে তাঁর কবিকৃতি সুবিদিত।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ