পঠন কাকে বলে বা কি? পঠন কত প্রকার ও কি কি? সরব পাঠ ও নীরব পাঠ কাকে বলে

পঠন কাকে বলে বা কি :-

ভাষাদক্ষতার তৃতীয় স্থানে রয়েছে পড়া বা পঠন। আনুষ্ঠানিক পাঠ অনুশীলনের গুরুত্বপূর্ণ দিক 'পড়া'। শোনা ও বলার মধ্য দিয়ে শিশুর পাঠ গ্রহণের শুরু। পড়ার কাজটি এসেছে ভাষার লিখিত রূপটি গড়ে ওঠার পরে।

রবার্ট লাডোর কথায়, 'To read is to grasp language patterns from their written representation,

ড. মাইকেল ওয়েস্ট বলেন, 'পঠন হলো দৃশ্যত ধ্বনি উৎপাদন ও অর্থ উপলব্ধির মিলিত প্রক্রিয়া'।

পড়া শেখানোর কাজে নিম্নোক্ত প্রক্রিয়াসমূহ অনুসরণ করা হয় -
  • ধ্বনির লিখিত রূপের সাথে পরিচিতি।
  • লিখিত রূপের সাথে ভাষার সংযোগ স্থাপন।
  • বলা ও পড়ার সমন্বয় সাধন।
  • মূলভাব ও অনুধাবনের উদ্দেশ্যে পঠন।
  • লিখিত রূপের বৈচিত্রের সাথে পরিচয়।
  • পড়ার স্বাচ্ছন্দ্য অর্জন।
  • সাহিত্য পাঠে আনন্দানুভূতির বিকাশ সাধন।

পঠনের গুরুত্ব :-

আনুষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে পঠন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মানুষের জ্ঞান আহরণের দ্বার উন্মুক্ত হয় পঠনের মাধ্যমে। দেশ বিদেশের জ্ঞান বিজ্ঞানের নানা তথ্য-উপাত্ত, বিচিত্র কাহিনী, ইতিহাস-ঐতিহ্য পঠনের মাধ্যমে জানা যায়। জ্ঞান রাজ্যের অসীম ভাণ্ডারের চাবি তাই পঠন প্রক্রিয়া। আমরা বলতে পারি

জ্ঞান ভাণ্ডারকে আরও স্ফীত করতে পঠনের প্রয়োজন।
শিক্ষার্থীদের মননশীলতার বিকাশে প্রয়োজন পঠনের।
বুদ্ধিবৃত্তি ও জ্ঞানের বিস্তৃতি ঘটাতে পঠন দরকার।
অবসর জীবনে পঠন আনন্দদায়ক সঙ্গী।
কবি সাহিত্যিকদের রচনারীতি সম্পর্কে জানতে পঠন আবশ্যক।
নতুন শব্দ আহরণ ও বাক্যে প্রয়োগে পঠন গুরুত্বপূর্ণ।
মার্জিত রুচিবোধ ও চিত্তের বিকাশ ঘটাতে পঠন সহযোগী।
মানুষের ব্যক্তিত্ব গঠনেও পঠনের গুরুত্ব অপরিসীম।
পঠন কাকে বলে

পঠনের প্রকারভেদ :-

প্রকৃতি অনুসারে পঠনকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন

১. সরব পাঠ

২. নীরব পাঠ।

আবার উদ্দেশ্য অনুযায়ী পঠনকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যেমন

১. চর্বনা পাঠ (Critical Study)

২. স্বাদনা পাঠ (Appreciation Study)

3. ধারণা পাঠ (Comprehensive Study)

এখন আমরা এই সব প্রকারভেদ গুলো সম্পর্কে আলোচনা করব।

সরব পাঠ কাকে বলে :-

যে পাঠে ধ্বনি উৎপন্ন হয় বা উচ্চারণ করে যা পাঠ করা হয় তাকে সরব পাঠ বলে।

সরব পাঠের গুরুত্ব ও উপযোগিতা :-

এই পাঠে বাগযন্ত্রের অনুশীলন হয়, শিশু শিক্ষার্থীরা বাগযন্ত্রকে পরিচালনা করার কৌশল আয়ত্ত করে। শিক্ষার্থীরা শুদ্ধ উচ্চারণরীতি শিখতে পারে। উচ্চারণের ত্রুটি সংশোধনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া যায়।

সরব পাঠ মার্জিত কথনশৈলী ও চমৎকার বাচনভঙ্গি অর্জনে সহায়তা করে। আবৃত্তির ক্ষেত্রে সরব পাঠের ভূমিকা অনস্বীকার্য। কারণ সরব পাঠ ব্যতিরেকে কবিতার রসাস্বাদন মোটেই সম্ভব নয়। সর্বোপরি সার্থক সরব পাঠ শিল্প হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে।

আরও পড়ুন :- পাঠ্যসূচি কাকে বলে?

সরব পাঠের সুবিধা :-

  • সরব পাঠ কথা বলার ক্ষেত্রে জড়তা দূরীকরণে সহায়তা করে।
  • শিক্ষার্থীর কথা বলায় যদি কোনো আঞ্চলিকতা থাকে তা কাটিয়ে উঠতে সহযোগিতা করা যায়।
  • পঠনে বিরাম চিহ্নাদির ব্যবহারে ত্রুটি থাকলে শনাক্ত করে তা সংশোধন করা যায়।
  • সরব পাঠের সময় পাঠকের কান ও মন একই সাথে কাজ করে। এর ফলে কঠিন বিষয়বস্তুর প্রতি অধিক মনোযোগ দেয়া যায়।
  • পাঠে ত্রুটি ধরার সুযোগ থাকায় পাঠক পাঠের প্রতি যত্নশীল হয়।
  • গোলমেলে পরিবেশেও সরব পাঠে কোনো অসুবিধা হয় না।
  • শিক্ষার্থীদের শোনার দক্ষতা বাড়াতে সরব পাঠ কার্যকর ভূমিকা রাখে।
  • ভাষা শিক্ষার প্রতি শিক্ষার্থীদের আগ্রহ সৃষ্টি হয়।
  • শিক্ষার্থীদের সুকুমার বৃত্তির বিকাশ ঘটাতে সহায়তা করে।
  • সরবপাঠ সাহিত্যরস উপভোগের সহায়ক।
  • সুন্দর বাচনভঙ্গি গড়ে উঠতে সরব পাঠের কার্যকর ভূমিকা থাকে।

সরব পাঠের অসুবিধা :-

  • সরব পাঠ অধিক শ্রমসাপেক্ষ।
  • তুলনামূলকভাবে সরব পাঠে সময় বেশি লাগে।
  • দীর্ঘ সময় ধরে সরব পাঠ করা যায় না, এতে ক্লান্তি আসে।
  • উচ্চশ্রেণির জন্য সরব পাঠ উপযোগী নয়।
  • সরব পাঠে কারো কারো মুদ্রাদোষ পরিস্ফুট হয় যা অত্যন্ত বিরক্তিকর।
  • অনেকে এক সঙ্গে সরব পাঠ করলে কোলাহলের সৃষ্টি হয়।
  • গভীর মনোযোগ দিয়ে পড়া সরব পাঠে সম্ভব হয় না।
  • অন্যের অসুবিধার কারণ হতে পারে বলে কোনো কোনো পরিবেশে সরব পাঠ মোটেই সমীচীন নয়। যেমন- লাইব্রেরি কিংবা হোস্টেলে একের সরব পাঠ অন্যের অসুবিধা সৃষ্টি করতে পারে।

নীরব পাঠ কাকে বলে :-

কোনো ধ্বনি উচ্চারণ না করে অর্থাৎ বাগযন্ত্রের দৃশ্যমান ব্যবহার না করে নীরবে যে পাঠ করা হয় তাকে নীরব পাঠ বলে।

এই পাঠে শুধু চোখ ও মন একসাথে কাজ করে। নীরব পঠন ধ্বনিময় না হলেও জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে এর তাৎপর্য অনেক বেশি। মনোসংযোগের ব্যাপারটি এখানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

কোনো বিষয়ের গভীর উপলব্ধির জন্য নীরব পাঠের কোনো বিকল্প নেই। সময় কাটানোর জন্য বা অবসর যাপনের জন্য নীরব পাঠ প্রিয়সঙ্গী হতে পারে।

নীরব পাঠের সুবিধা :-

  • নীরব পাঠ ক্লান্তিকর নয়, তাই দীর্ঘ সময় পড়া যায়।
  • কোনো কঠিন বিষয় হৃদয়াঙ্গম করার জন্য নীরব পাঠ অধিক কার্যকরী।
  • সমালোচক, বিশ্লেষক ও গবেষণারত ব্যক্তিদের জন্য নীরব পাঠ বেশি উপযোগী।
  • একই স্থানে একই সাথে অনেকে মিলে পাঠ করা যায়।
  • নীরব পাঠে শান্ত স্নিগ্ধ পরিবেশ বজায় থাকে।
  • সরব পাঠের চেয়ে নীরব পাঠে সময় কম লাগে।
  • অবসর সময় আনন্দে কাটানোর জন্য নীরব পাঠ আনন্দসঙ্গী হতে পারে।
  • লাইব্রেরিতে পাঠাভ্যাসে ও হোস্টেলে অবস্থানের জন্য নীরব পাঠ বেশি উপযোগী।
  • ব্যক্তিগত পত্র, গোপন দলিল পত্রাদি নীরবে পাঠ করা শ্রেয়।
  • পঠনকালে কোলাহলমুক্ত পরিবেশ বজায় রাখতে নীরব পাঠই উপযোগী।

নিরব পাঠের অসুবিধা :-

  • নীরব পাঠে উচ্চারণত্রুটি হলে তা সংশোধনের কোনো উপায় থাকে না।
  • ভাষাশিক্ষার শুরুতে বিশেষত প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের জন্য নীরব পাঠ উপযোগী নয়।
  • অমনোযোগী শিক্ষার্থীরা ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ পায়।
  • কবিতা পাঠের প্রধান উদ্দেশ্য রসাস্বাদন, যা নীরব পাঠে কোনো ক্রমেই সম্ভব নয়।
  • গভীর মনোযোগের ব্যত্যয় ঘটলে পাঠে পাঠকের কোনো লাভ হয় না।
  • উচ্চারণ অনুশীলনের কোনো সুযোগ নীরব পাঠে থাকে না।
  • নীরব পাঠকে শৈল্পিক পাঠের পর্যায়ে নেওয়া যায় না।

চর্বণা পাঠ কাকে বলে :-

প্রবন্ধ বা প্রবন্ধধর্মী রচনা সাধারণত যুক্তিনির্ভর, তত্ত্ব ও তথ্যে ভরপুর বুদ্ধি ও বিচার বিশ্লেষণমূলক হয়ে থাকে। এ ধরনের লেখার গভীরে পৌঁছাতে প্রয়োজন চর্বর্ণা পাঠ। কঠিন খাদ্য দ্রব্য যেমন চিবিয়ে চিবিয়ে খেতে হয় তেমনি এ জাতীয় জটিল লেখার মর্ম উপলব্ধির জন্যও চর্বণা পাঠের কোনো বিকল্প নেই। ভারিক্কি চালের এই লেখা মোটেই লঘুসঞ্চারী নয় বলে গভীর মনোনিবেশে চর্বনা পাঠের মাধ্যমে এর উপলব্ধিগত ধারণা লাভ করা সম্ভব।

স্বাদনা পাঠ কাকে বলে :-

কাব্যধর্মী কোনো রচনার সাহিত্যরস আস্বাদনের জন্য যে পাঠ করা হয় তাকে বলা হয় স্বাদনা পাঠ।

কবিতা পাঠ মূলত স্বাদনা পাঠ। কারণ কবিতা পাঠের প্রথম ও প্রধান উদ্দেশ্য রসাস্বাদন। স্বাদনা পাঠের মাধ্যমে কবির প্রকাশভঙ্গি, গভীর অনুভূতি, হৃদয়াবেগ প্রভৃতির সাথে একাতা হয়ে আনন্দ লাভ করা যায়। এখানে বিষয়বস্তুর চেয়ে রসাস্বাদনই মুখ্য।

ধারণা পাঠ কাকে বলে :-

কোনো প্রকার রসাস্বাদন বা বিচার বিশ্লেষণ নয়, শুধু পড়ে অর্থ বুঝতে পারা, মর্ম উপলব্ধি করা এবং সাধারণ ধারণা অর্জন করা যায় যে পাঠের মাধ্যমে, তাকেই ধারণা পাঠ বলে।

বাংলা পাঠ্যপুস্তকের ভ্রমণ কাহিনী, উপন্যাস, বর্ণনামূলক রচনার পাঠ এর অন্তর্ভুক্ত। শিক্ষার্থীরা চোখ বুলিয়ে অর্থ বোঝার ক্ষমতা এই পাঠের মাধমেই লাভ করে। এই পাঠকে আত্তীকরণ পাঠও বলা হয়।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ