বিবর্তন কাকে বলে? বিবর্তনের ধাপ ও প্রমাণ?

বিজ্ঞানীদের ধারণা বর্তমান পৃথিবীতে বিদ্যমান যে লক্ষ লক্ষ প্রজাতির জীববৈচিত্র্য্য দেখা যায় তা তাদের বর্তমান রূপ নিয়ে এই দিনেই পৃথিবীতে আসেনি। এক প্রজাতি থেকে ধীরে ধীরে পরিবর্তনের মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছে অন্য প্রজাতির। পৃথিবীর বিভিন্ন পরিবেশের সঙ্গে অভিযোজনের জন্য বেঁচে থাকার তাগিদেই এসব পরিবর্তন সাধ্যি হয়েছে।

বিবর্তন কাকে বলে :-

আর প্রজাতি গঠনে জীব জগতের যে কোন ধারাবাহিক পরিবর্তনকে বিবর্তন বা অভিব্যক্তি বলে।

বিবর্তন একটি দীর্ঘ ও ধারাবাহিক জটিল প্রক্রিয়া। জীব জগতে হাজার হাজার বছর ধরে পরিবর্তনের মাধ্যমে বিবর্তনের বিকাশ ঘটেছে। প্রথম সৃষ্ট জীব হতে বিবর্তনের জটিল পথ ধরে অগ্রসর হয়েই বর্তমান পৃথিবীর সব উদ্ভিদ ও প্রাণীর উৎপত্তি হয়েছে, এটাই বিবর্তনের মূল কথা।

জীববিজ্ঞানীগণ বিভিন্নভাবে বিবর্তনের সংজ্ঞা দিয়ে দিয়েছেন। বিজ্ঞানী ডারউইন বিবর্তনকে পরিবর্তনসহ উদ্ভাবন বলেছেন।

আধুনিক সংজ্ঞা অনুযায়ী “প্রকৃতিতে যে ধারাবাহিক অথচ অতি মন্থর ক্রম পরিবর্তনের মাধ্যমে অতীতে উদ্ভূত কোন সরল জীব হতে জটিলতর ও উন্নত জীবের উদ্ভব হয় তাকে বিবর্তন বা জৈব বিবর্তন বলে।

আরও পড়ুন:- পাতা কাকে বলে?

জীব জগতের যে বিবর্তন ঘটেছে এ প্রত্যয় জীব বিজ্ঞানীদের মধ্যে জন্মেছে অনেক আগেই। কিন্তু ঠিক কিভাবে বিবর্তন হচ্ছে এ ব্যাপারে কেউ ঐক্যমতে পৌঁছতে পারেননি। এ মতানৈক্যের মূল কারণ হল বিবর্তন অত্যন্ত ধীর প্রক্রিয়া, যা সহজে অনুধাবন ও অবলোকন করা যায় না।

বিবর্তনের ধাপ :-

বিজ্ঞানীগণ গবেষণা করে বিবর্তনের তিনটি ধাপ নির্ণয় করেছেন, যথা-

১. মাইক্রো বিবর্তন (Microevolution):

জীবের জিন মিউটেশনের প্রভাবে যে বিবর্তন ঘটে তাকে মাইক্রো বিবর্তন বলে। এক্ষেত্রে কোন প্রজাতির জীবগোষ্ঠীতে অল্প মাত্রায় পরিবর্তন সাধিত হয়ে বিভিন্ন জাত, ক্লাইন বা উপ-প্রজাতির সৃষ্টি হয় ।

২. ম্যাক্রো বিবর্তন (Macroevolution):

মাইক্রো বিবর্তন উপ-প্রজাতির ধাপ অতিক্রম করে প্রজাতি সৃষ্টির বিবর্তনকে ম্যাক্রো বিবর্তন বলে।

৩. মেগা বিবর্তন (Mega evolution):

ম্যাক্রো বিবর্তন ধাপ অতিক্রম করে গণ এর উপরের পর্যায়ের স্তরগুলো সৃষ্টি হলে তাকে মেগা বিবর্তন বলে। এ বিবর্তনের মাধ্যমে মাছ থেকে উভচর, উভচর থেকে সরীসৃপ, সরীসৃপ থেকে পাখি ইত্যাদি সৃষ্টি হয়েছে বলে ধারণা করা হয়।

বিবর্তনের ধরণ :-

জীবের আবাসস্থলের বৈচিত্র্য এবং অভিযোজনিক প্রক্রিয়ার উপর ভিত্তি করে বিবর্তন তিন ধরনের হয়ে থাকে, যথা-

১. অপসারী বিবর্তন (Divergent Evolution):

এক্ষেত্রে নিকট সম্পর্কযুক্ত জীবগোষ্ঠী ভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক পরিবেশে সুষ্ঠুভাবে অভিযোজিত হয়ে বিবর্তন ঘটায় এবং নতুন প্রজাতি সৃষ্টি করে।

আরও পড়ুন:- জীবন বিজ্ঞান কাকে বলে?

২. অভিসারী বিবর্তন (Convergent Evolution):

এক্ষেত্রে দূর সম্পর্কিত জীবগোষ্ঠী একই পরিবেশের মধ্যে বাস করার ফলে অভিযোজনের কারণে তাদের দেহে সাদৃশ্যগত বৈশিষ্ট্য সৃষ্টির মাধ্যমে যে বিবর্তন ঘটে তাকে অভিসারী বিবর্তন বলে।

৩. সমান্তরাল বিবর্তন (Parallel Evolution):

দুটি ভিন্ন প্রজাতির জীবগোষ্ঠীর দুটি দূরবর্তী কিন্তু একই পরিবেশে বসবাস ও অভিযোজনের মাধ্যমে যখন একইভাবে বিবর্তিত হয় তখন তাকে সমান্তরাল বিবর্তন বলে।

ল্যামার্কের মতবাদ বা ল্যামার্কিজম (Lamarckism) :-

বিবর্তনের উপর সর্বপ্রথম একটি যুক্তিযুক্ত মতবাদ তুলে ধরেন জ্যা বাপটিস্ট ল্যামার্ক, ১৭৪৪-১৮২৯ নামক একজন ফরাসি বিজ্ঞানী। এ মতবাদটি ATheory of inheritance of acquired characters" বা "অর্জিত বৈশিষ্ট্যের বংশানুক্রম' নামে খ্যাত।

সমসাময়িক অন্যান্য জীব বিজ্ঞানীদের মতো ল্যামার্কও বিশ্বাস করতেন যে, প্রতিটি জীবের একটি অন্তর্নিহিত প্রাণশক্তি থাকে। আর এ শক্তিই পরিবেশের সব প্রতিকূল অবস্থাকে প্রতিহত করে জীবের বিভিন্ন অঙ্গের বিকাশ ও কার্য নিয়ন্ত্রণ করে। ল্যামার্কের মতবাদ মূলত এ প্রত্যয়কে ভিত্তি করেই। ল্যামার্কের মতবাদের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হল-

১. জীবন ধারণের প্রয়োজনে পরিবেশ প্রতিটি প্রাণীর গঠন, আকৃতি ও সংগঠনকে প্রভাবিত করে।

২. কোন অঙ্গের পুনঃপুনঃ ব্যবহার বা প্রতিনিয়ত ব্যবহার সে অঙ্গকে সুগঠিত করে এবং তার বৃদ্ধি ঘটায়। আবার কোন অঙ্গ ব্যবহৃত না হলে তা ক্রমশ দুর্বল হয়ে যায় এবং শেষ পর্যন্ত তার ক্ষয়প্রাপ্তি বা বিলুপ্তি ঘটে।

৩. পরিবেশের চাহিদা অনুযায়ী প্রাণীর দেহে নতুন অঙ্গের উদ্ভাবন হয়। এ নতুন অঙ্গের আকার ও বিকাশ তার ব্যবহারের উপর নির্ভরশীল।

৪. ব্যবহার ও অব্যবহারের মাধ্যমে পরিবেশ কর্তৃক আনীত সব পরিবর্তন প্রাণীর দেহে সংরক্ষিত হয় এবং প্রজননের মধ্যেমে তা পরবর্তী বংশে সঞ্চারিত হয়।

ল্যামার্কের মতবাদের ব্যাখ্যা :-

১. ল্যামার্ক তাঁর মতবাদের সমর্থন যোগাতে জিরাফের লম্বা গলার কথা উল্লেখ করেছেন। তাঁর ধারণায় জিরাফের পূর্বপুরুষের গলা লম্বা ছিল না। বিবর্তনের মাধ্যমে খাটো গ্রীবা বিশিষ্ট পূর্বপুরুষ থেকেই বর্তমানের লম্বা গ্রীবার জিরাফের আবির্ভাব হয়েছে।

ব্যাখ্যা দিতে দিয়ে ল্যামার্ক বলেছেন যে খাটো গ্রীবা বিশিষ্ট জিরাফ ঘাসের পরিবর্তে উঁচু গাছের পাতা খেয়ে জীবন ধারণ করতে শুরু করে এবং পাতা নাগাল পাওয়ার জন্য তারা অনবরত ঘাড় লম্বা এবং উঁচু করার প্রচেষ্টা চালায়।

বংশ পরস্পরায় এ প্রচেষ্টার ফলে শেষ পর্যন্ত তাদের ঘাড় ও গলা লম্বা হয়ে যায় এবং বর্তমান রূপ ধারণ করে।

আরও পড়ুন:- জীব সম্প্রদায় কাকে বলে?

ব্যবহারের চাহিদায় যে নতুন অঙ্গের সংযোজন হতে পারে তার উদাহরণস্বরূপ ল্যামার্ক জলজ পাখির প্রসঙ্গ এনেছেন। তাঁর ধারণায় এক সময় সব পাখিই ছিল স্থলচর। কিন্তু কিছু সংখ্যক পাখি খাদ্যের অন্বেষণে জলাশয়ের কাছে যায় এবং পানির ভেতর থেকে খাদ্য আহরণের জন্য তাদের পায়ের ব্যবহার শুরু করে। এছাড়া পানিতে চলাচলের জন্যও তারা পায়ের ব্যবহার চালায়। ফলে পায়ের আঙ্গুলের পাশ দিয়ে চামড়ার বিস্তৃতি ঘটতে থাকে। এভাবে দীর্ঘ দিনের ব্যবহারে লিপ্ত-পদের (web toed foot) উদ্ভব হয় যা বর্তমানে হাঁস, পেলিক্যান ইত্যাদি পাখিতে দেখা যায়।

৩. অব্যবহারের ফলে অঙ্গের যে বিলুপ্তি ঘটে ল্যামার্ক তার ব্যাখ্যাও দিয়েছেন সাপের আঙ্গিক গঠনের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে। ঘাসের মধ্যে হামাগুড়ি দিয়ে চলার সময় সাপ তার শরীরকে অহরহ প্রসারিত করে এবং এক্ষেত্রে পায়ের ব্যবহারের তেমন প্রয়োজন হয় না বরং সরু জায়গা দিয়ে চলাচল করার সময় পা প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে।

ল্যামার্কের ধারণা অনুযায়ী সাপের পূর্বপুরুষেরা চলাচলের সময় পায়ের ব্যবহার ধীরে ধীরে বর্জন করে। দীর্ঘদিন এভাবে চলতে থাকায় অব্যবহারের ফলে এক সময় তাদের দেহ থেকে পা সম্পূর্ণরূপে নিচিহ্ন হয়ে যায়।

ল্যামার্কের পর বিবর্তন সম্পর্কিত সুচিন্তিত এবং জোড়ালো মতবাদ প্রকাশ করেন চার্লস ডারউইন। তার মতবাদটি প্রাকৃতিক নির্বাচন মতবাদ নামে পরিচিত এবং বিখ্যাত গ্রন্থ On the Origin of Species by Means of Natural Selection-2 1859 সালে প্রকাশিত হয়। তাঁর এ মতবাদকে ডারউইনিজম নামে অভিহিত করা হয়।

ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচন মতবাদ নিম্নলিখিত পাঁচটি তথ্য ও যুক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত :

১. প্রকরণ (Variation):

প্রাকৃতিক পরিবেশে প্রতিটি জীব প্রজাতির মধ্যেই চেহারা, আকৃতি বা জীবন ব্যবস্থায় কিছুটা তারতম্য পরিলক্ষিত হয়। জীবের এসব অমিল বা বৈসাদৃশ্যতাকে প্রকরণ বা Variation বলে।

একই প্রজাতির দুইটি সদস্য, এমনকি অভিন্ন যমজ (Identical Twins) ব্যতিরিকে একই পিতা-মাতার দুটি সন্তানও কখনো হুবহু এক রকম হয় না। বিভিন্ন জীবে এসব প্রকরণ বিভিন্নভাবে ও বিভিন্ন মাত্রায় প্রকাশ পেতে পারে। ডারউইন জীব জগতের এ প্রকরণকে বিবর্তনে বা নতুন প্রজাতি গঠনের চাবিকাঠি হিসেবে বর্ণনা করেন।

২. গুণোত্তর হারে সংখ্যা বৃদ্ধি (Geometric Ratio of Increase ) :

জীব জগতে প্রতিটি প্রজাতির গুণোত্তর হারে সংখ্যা বাড়াবার একটি প্রবণতা আছে। তাই প্রতিটি জীব যে পরিমাণে বেঁচে থাকতে পারে তার তুলনায় অনেক বেশী সন্তান- সন্ততি জন্ম দেয়। অনেক প্রাণী রয়েছে যাদের প্রজনন ক্ষমতা অনেক বেশী। জীবের সংখ্যা বৃদ্ধির এ ধরনের প্রবণতা থাকা সত্ত্বেও স্বাভাবিক পরিবেশে প্রায় সব প্রজাতির সদস্য সংখ্যাই মোটামোটিভাবে অপরিবর্তিত থাকে। কারণ প্রতিটি জননের অধিকাংশ সন্তান-সন্ততিই বিভিন্ন কারণে মারা যায়।

৩. বাঁচার সংগ্রাম (Struggle for Existence):

ডারউইনের মতে যেহেতু প্রতিটি জীব অপেক্ষাকৃত অনেক বেশী পরিমাণ সন্তান-সন্ততির জন্ম দেয় সেহেতু বেঁচে থাকার জন্য তাদের মধ্যে সংগ্রাম অবধারিত। এ সংগ্রাম ঘটে মূলত খাদ্য, বাসস্থান ও প্রজনন স্থানকে কেন্দ্র করে।

প্রতিটি জীবকে এ তিনটি মৌলিক উপাদান লাভের জন্য প্রতিনিয়ত বহুমুখী সংগ্রামে লিপ্ত হতে হয়। এ সংগ্রাম বিভিন্ন রকম হতে পারে যেমন, প্রাণীতে প্রাণীতে সংগ্রাম উদ্ভিদে উদ্ভিদে সংগ্রাম, উদ্ভিদে প্রাণীতে সংগ্রাম এবং উদ্ভিদ-প্রাণী ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মধ্যে সংগ্রাম। প্রকৃতির অমোষ নিয়মে জীবন-মরণ এ সংগ্রাম চলছে প্রতি নিয়ত, জীবনের প্রতি স্তরে এবং জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত।

৪. প্রাকৃতিক নির্বাচন (Natural Selection):

ডারউইন জীব জগতের মধ্যে বিদ্যমান বিভিন্ন সংগ্রামকে সুক্ষ্মভাবে পর্যালোচনা করে দেখেছেন যে কিছু কিছু প্রাণীর অনুকূল প্রকরণ পরিবেশের এ প্রতিযোগিতায় বেঁচে থাকার জন্য তাদের সহায়ক হয়। অন্যদিকে যারা এ ধরনের প্রকরণ লাভ করেনি তারা প্রকৃতি কর্তৃক মনোনীত হয় না। ফলে তাদের বিলুপ্তি ঘটে অথবা প্রজনন ঘটাতে ব্যর্থ হয়।

ঘন চারা গাছের মধ্যে যেসব গাছ তাড়াতাড়ি বাড়ে স্বভাবতই তারা অন্যদের ছায়ায় ফেলে নিজেরা সাফল্যভাবে জন্মায়। অন্যগুলো আলোর অভাবে টিকতে ব্যর্থ হয় এবং মারা যায়।

এভাবে জীবন সংগ্রামে যারা বাঁচে ডারউইনের কথায় তারাই 'প্রকৃতি কর্তৃক নির্বাচিত' এবং তারাই বংশ বিস্তারে সুযোগ পায়। হার্বার্ট স্পেনসার এ প্রক্রিয়ায় টিকে থাকাকে যোগ্যতমের ঊর্ধ্বতন বলে আখ্যায়িত করেছেন।

৫. নতুন প্রজাতির সৃষ্টি (Origin of New Species):

ডারউইনের মতে জীবন ধারণ সংগ্রাম কেবল যে সব জীব সাফল্য লাভ করে যে সব জীবদেহে সংগ্রামের জন্য অনুকূল ও সহায়ক প্রকরণ থাকে। এসব প্রকরণ প্রজননের মাধ্যমে পরবর্তী বংশে সঞ্চারিত ও সংরক্ষিত হয়। কয়েক প্রজন্ম ধরে এটি চললে আরো সুষ্ঠুভাবে পরিবেশে অভিযোজিত হয়।

পরিবেশের অবস্থার আবার কোন পরিবর্তন ঘটলে যে সব প্রাণী সে পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিজেদের মধ্যে অনুকূল প্রকরণ ঘটাতে পারে কেবল তারাই টিকে থাকে। যারা পারে না তারা ধীরে ধীরে অপসারিত হয়। যে সব প্রজাতি অতীতে পৃথিবী থেকে চিরদিনের জন্য বিলীন হয়ে গেছে, পরিবর্তিত পরিবেশের সঙ্গে সংগ্রামে তাদের ব্যর্থতা এ জন্য দায়ী। ডারউইন তাই যুক্তি দেখান যে, দীর্ঘদিন ধরে প্রকরণের ক্রমাগত সঞ্চর একটি জীবের বৈশিষ্ট্যের রূপান্তর ঘটায় আর এর ফলেই উদ্ভব হয় নতুন প্রজাতির।

বিবর্তনের প্রমাণ :-

বিজ্ঞানীদের দেয়া বিভিন্ন মতবাদ ও তথ্যাদি থেকে এটি প্রতীয়মান হয় যে বিবর্তন একটি সচল প্রক্রিয়া, যা খুব ধীর গতিতে প্রকৃতিতে সব সময় ঘটে চলছে। পৃথিবীতে বিদ্যমান অসংখ্য প্রাণীর মধ্যে যে আকৃতিগত, অঙ্গ সংস্থানিক ও আচরণগত বৈচিত্র্য দেয়া যায় তা অতি সাধারণ পূর্বপুরুষ থেকে লক্ষ বছর ধরে পরিবর্তনের ধারা বেয়ে বর্তমান পর্যায়ে এসেছে।

বিবর্তনের ধারণানুযায়ী পৃথিবীর সকল প্রাণীই সাধারণ পূর্বপুরুষে থেকে উদ্ভূত এবং এ কারণেই এরা বিভিন্ন দিক দিয়ে একে অন্যে সাথে সম্পর্কযুক্ত। কলাকৌশল নিয়ে মতভেদ থাকা সত্ত্বেও বিজ্ঞানীগণ বিবর্তনের স্বপক্ষে অনেক প্রমাণ উপস্থাপন করেছেন। বিবর্তনের বহুল আলোচিত প্রমাণগুলো হল:

১. জীবাশ্মগত ও ভূ-তাত্ত্বিক প্রমাণ:

সুদূর অতীতে বিলুপ্ত কোন জীবের দেহ বা দেহাংশ বা কোন চিহ্ন প্রাকৃতিক উপায়ে পাললিক শিলায় প্রস্তরীভূত হয় সংরক্ষিত থাকলে তাকে জীবাশ্ম বা ফসিল বলে।

জীবাশ্ম বিবর্তনের অত্যন্ত যুক্তি সঙ্গত ও প্রত্যক্ষ প্রমাণ বহন করে। জীবাশ্মের অধ্যয়নের মাধ্যমে অতীতের প্রাণীকূলের অবস্থা এবং কিভাবে বিভিন্ন ধারায় পরিবর্তিত ও অভিযোজিত হয়ে বর্তমান পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে তার ইতিহাস সম্পর্কে জানা যায়।


পাললিক শিলার বিভিন্ন স্তর থেকে অনেক প্রাণীর ক্রমবিকাশেল চমৎকার ঐতিহাসিক ধারাবাহিক জীবাশ্ম তথ্য পাওয়া গেছে। এদের মধ্যে মানুষ, হাতি, ঘোড়া, উট উল্লেখযোগ্য।

ঘোড়ার পূর্ববর্তী হিসেবে এক ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট Hyracotherium প্রাণীটি প্রথম উত্তর আমেরিকায় আর্বিভূত হয় ইয়োসিন যুগে। এরা আকৃতিতে অনেকটা ছোট কুকুরের মতো ছিল। বিবর্তনের পথ বেয়ে বিভিন্ন সময়ে Miohippus, Merychippus এবং Pliohippus মাধ্যমে আধুনিক কালের ঘোড়া Equus-এর উদ্ভব হয়েছে যারা সমগ্র পৃথিবীতে বিস্তৃত আছে। ঘোড়ার বিবর্তনের সাথে যুগপৎ ভূতাত্ত্বিক পরিবর্তনের একটি সাদৃশ্যপূর্ণ ধারাবাহিক ইতিহাস বিবর্তন সম্পর্কিত প্রমাণ বহন করে।

২. শ্রেণিবিন্যাসগত প্রমাণ:

বিভিন্ন প্রাণীর মধ্যে সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে প্রাণি জগতের আধুনিক শ্রেণিবিন্যাস গড়ে উঠেছে। প্রাণীর বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ অঙ্গ সংস্থান এবং জাতিতাত্ত্বিক সম্পর্ক যাচাই করে এসব বৈশিষ্ট্য নির্ণয় করা হয় যার ভিত্তিতে বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণীদের গণ (Genus) গোত্র (Family), বৰ্গ (Order), শ্রেণি ( Class), পর্ব (Phylum) ইত্যাদি বিভিন্ন স্তরে স্থাপন করা হয়।

বিভিন্ন প্রজাতিতে বৈশিষ্ট্যের তারতম্য থাকার কারণেই শ্রেণি বিন্যাসের বিভিন্ন স্তরের উৎপত্তি হয়েছে যা বিবর্তনের প্রমাণ বহন করে। বিবর্তনের ধারণা অনুযায়ী আদিকালে কেবল একটি বা কয়েকটি প্রজাতির প্রাণী ছিল। পরে এদের ধারাবাহিক ও ধীর পরিবর্তন দ্বারা সৃষ্ট হয়েছে অগণিত অন্যান্য প্রজাতি।

বিবর্তনের পথ ধরে সামনের দিকে যতই অগ্রসর হয়েছে ততই নিম্নস্তরের প্রাণী হতে উচ্চ স্তরের প্রাণীর উদ্ভব ঘটেছে। তাই প্রাণী জগতের শ্রেণি বিন্যাসের যত নিচে যাওয়া যায় তত বেশী প্রাণীদের মধ্যে মিল পাওয়া যায়। এমন কিছু প্রাণী পাওয়া যায় যারা ভিন্ন ভিন্ন দুটি শ্রেণির প্রাণীর আঙ্গিক বৈশিষ্ট্য বহন করে এবং ফলে শ্রেণি বিন্যাসের সময় তাদের কোন শ্রেণিতে অন্তর্ভুক্ত করা যায় না। যোগসূত্র হিসেবে এসব প্রাণীর উপস্থিতি স্বাভাবিকভাবেই বিবর্তনের প্রমাণ বহন করে এবং তার গতিপথ নির্দেশ করে।

৩. জীব ভৌগোলিক প্রমান:

ডারউইন তাঁর মতবাদের জীবের ভৌগোলিক অবস্থান বা বিস্তৃতিকে বিবর্তনের অন্যতম প্রধান উপাদান হিসেবে বিবেচনা করেছেন। তাঁর মতে প্রতিটি প্রাণীগোষ্ঠীর উদ্ভব হয়েছে একটি নির্দিষ্ট স্থানে এবং পরে সেখান থেকে ধীরে ধীরে পৃথিবীর অন্যত্র ছড়িয়ে পড়েছে।

প্রাণীর বিস্তৃতি লাভের সময় পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়াতে তাদের অনেক আঙ্গিক পরিবর্তন সাধিত হয়। ফলে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানের প্রাণীদের মধ্যে সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়।

বিচ্ছিন্নতার ফলে বিভিন্ন পরিবেশের প্রাণী নিজস্ব ধারায় বিবর্তিত হয়ে নতুন প্রজাতির সৃষ্টি করে। বিবর্তনবাদীদের মতে সমগ্র পৃথিবী এক সময় গন্ডোয়ানাল্যান্ড নামে এক অখন্ড ভূখন্ড হিসেবে বিরাজিত ছিল। পরবর্তীতে দীর্ঘকালের ভূতাত্ত্বিক পরিবর্তনের ফলে এটি বিভিন্ন অংশে বিচ্ছিন্ন হয়ে বিভিন্ন মহাদেশ গঠন করে।

এ বিচ্ছিন্নতার ফলে পূর্বেকার সকল প্রাণী বিভিন্ন মহাদেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং স্ব স্ব পরিবেশে অভিযোজিত হয়ে নতুন নতুন প্রজাতির উদ্ভাবন ঘটায় এবং যেসব প্রাণী নতুন পরিবেশের সাথে অভিযোজিত হতে পারেনি তারা ধীরে ধীরে পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে যায়।

৪. অঙ্গ সংস্থান সম্পর্কিত প্রমাণ:

নিকট সম্পর্কযুক্ত বিভিন্ন প্রাণীর অঙ্গ সংস্থান তুলনামূলকভাবে পরীক্ষা করলে তাদের গঠন পরিকল্পনায় অনেক সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। প্রাণীল অঙ্গসংস্থানের এ সম্পর্ককে বিবর্তনের গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ বলে বিজ্ঞানীগণ মনে করেন।

একটি পর্বের বিভিন্ন শ্রেণির প্রাণীতে কোন একটি বিশেষ অঙ্গের গঠন তুলনা করলে তাদের মধ্যে স্পষ্ট মিল লক্ষ্য করা যায়। অর্থাৎ অঙ্গটি মূল কাঠামো সকল ক্ষেত্রে একই রকম। তুলনামূলক অঙ্গসংস্থানকে বিবর্তনের প্রমাণ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে বিজ্ঞানীগণ সমসংস্থ, সমবৃত্তীয় এবং লুপ্তপ্রায় অঙ্গসমূহের কথা তুলে ধরেছেন।

৫. ভ্রূণতাত্ত্বিক প্রমাণ:

সকল বহুকোষী প্রাণীর জীবনচক্রের প্রাথমিক দশায় ভ্রূণীয় পরিস্ফুটন দেখা যায়। প্রাণীর ভ্রূণীয় পরিস্ফুটনের দশাগুলোর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পরিণত প্রাণীর অনুরূপ নয় বরং অনেক ক্ষেত্রে নিম্নতর প্রজাতির বয়স্ক প্রাণীর অনুরূপ। তবে বিভিন্ন প্রাণীর ভ্রূণের প্রাথমিক পর্যায়গুলোর মধ্যে সুস্পষ্ট সাদৃশ্যতা লক্ষ্য করা যায়।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, মাছ, উভচর, সরীসৃপ, পাখি ও স্তন্যপায়ীদের ভ্রূণীয় পরিস্ফুটনের বিভিন্ন দশায় অদ্ভূত ধরনের সাদৃশ্যতা লক্ষ করা যায়। এ থেকে স্পষ্ট ধারণা করা হয় যে মাছের ন্যায় কোন এক পূর্বপুরুষ হতে বিবর্তনের মাধ্যমে উভচর, সরীসৃপ, পাখি ও স্তন্যপায়ী প্রাণীর উদ্ভব হয়েছে।

৬. শরীরবৃত্তীয় ও জীবরসায়নঘটিত প্রমাণ:

জীবের শরীরবৃত্তীয় এবং জীবরাসায়নিক কতগুলো দিক বিবর্তনের প্রমাণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। প্রায় সকল প্রাণীর পরিপাক, রেচন, স্নায়ু এবং সংবহনের শারীবৃত্তীয় প্রক্রিয়াগুলো মোটামুটি একই রকম। ধারণা করা হয় বিভিন্ন প্রাণী বিবর্তনের ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হওয়ার পূর্বেই এ তন্ত্রগুলো তাদের মধ্যে উদ্ভব হয়েছিল। রক্তের হিমোগ্লোবিন, রক্ত আমিষ, এনজাইম ও হরমোনের জীব রাসায়নিক গবেষণা থেকে জানা গেছে যে, নিকট সম্পর্কযুক্ত প্রাণীগোষ্ঠীতে এসব উপাদানের মধ্যে যথেষ্ট সাদৃশ্যতা লক্ষ করা যায় যা বিবর্তনের সপক্ষে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ নির্দেশ করে।

৭. কোষতাত্ত্বিক প্রমাণ:

সকল প্রাণী দেহই কোষীয় একক দ্বারা গঠিত। প্রাণীর শ্রেণিতাত্ত্বিক বা আকৃতিগত যতই বৈসাদৃশ্য থাকুক না কেন সকলের কোষীয় গঠণ প্রায় এক রকম। জৈব রাসায়নিক দিক থেকে সকল প্রাণীর কোষের গঠনে সাদৃশ্য থাকায় অনুমান করা হয় যে, সকল প্রাণী মূলত একটি সাধারণ পূর্ব পুরুষ থেকে উদ্ভব হয়েছে। এছাড়া কোষের অঙ্গসংস্থান, ক্রোমোজোম সংখ্যা ও অন্যান্য গুণাবলী বিভিন্ন প্রাণীর মধ্যে সম্পর্ক ও বিবর্তনের গতিপথ নির্দেশ করে।

৮. জিনতাত্ত্বিক প্রমাণ:

জীবের জিনতাত্ত্বিক কিছু বৈশিষ্ট্য বিবর্তনের সপক্ষে প্রমাণ বহন করে। প্রকৃতিতে একই প্রজাতির পুরুষ ও স্ত্রী প্রাণীর মধ্যে যৌন মিলন ঘটে সন্তান-সন্ততি জন্ম নেয়। ভিন্ন ধরনের দুটি প্রজাতির প্রাণীর মধ্যে কখনো প্রজনন ঘটে না। কদাচিৎ খুব নিকট সম্পর্কযুক্ত দুটি প্রজাতির মধ্যে যৌন জননে সংকর ও বন্ধ্যা প্রাণীর সৃষ্টি হয়। এ সংকর সন্তান উৎপাদন অবশ্যই তাদের মধ্যে ঘনিষ্ট সম্পর্কের ইঙ্গিত বহন করে।

জীবের প্রতিটি বৈশিষ্ট্য জিন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। জিনের হঠাৎ কোন পরিবর্তন বা মিউটেশন ঘটলে প্রজাতির মূল বৈশিষ্ট্য পরিবর্তিত হয়ে নতুন বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পায়। এ জন্য মিউটেশনকে বিবর্তনের কাঁচামাল হিসেবে গণ্য করা হয়। জিন মিউটেশনের ফলে আনীত জীবের পরিবর্তিত বৈশিষ্ট্য অনেক সময় প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে পরিবেশে অভিযোজিত হয় এবং নতুন প্রজাতি গঠনের ভিত্তির সূচনা করে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ