অর্থনীতি কাকে বলে? অর্থনীতি কত প্রকার ও কি কি? অর্থনীতির বিষয়বস্তু?

সীমাহীন অভাবের মধ্যে একটি মানবশিশু জন্মগ্রহণ করে। জন্মের পরপরই তার খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, ওষুধপত্র, শিক্ষা, আমোদ প্রমোদের সুবিধা এবং আরো বহু জিনিস প্রয়োজন হয়। কিন্তু এসবের সরবরাহ অনেক সময় পর্যাপ্ত নয়।

অন্যদিকে, মানুষের অভাব সীমাহীন। তাই মানুষ প্রকৃতিপ্রদত্ত সীমিত সম্পদ নিয়ে তার সীমাহীন অভাব পূরণের জন্য বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করে। মানুষের এসব কার্যক্রমকে অর্থনৈতিক কার্যক্রম হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

অর্থনীতি কাকে বলে :-  

সুতরাং মানুষের যেসব অর্থনৈতিক কার্যক্রম সীমিত সম্পদ দিয়ে তার সীমাহীন অভাব মেটানোর জন্য গ্রহণ করা হয় তার আলোচনাকে অর্থনীতি বলে।

অর্থনীতির ইংরেজি 'Economics শব্দটি গ্রিক শব্দ 'ওইকোনোমিয়া' (Oikonomia) হতে উদ্ভূত হয়েছে। যার অর্থ হচ্ছে 'গৃহ পরিচালনা' (Household Management )। গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটল অর্থনীতিকে 'গৃহ পরিচালনার' বিজ্ঞান হিসেবে অভিহিত করেন। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে অর্থনীতি শব্দের অর্থ আর গৃহ পরিচালনার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। বিখ্যাত পণ্ডিত কৌটিল্যের 'অর্থশাস্ত্র' নামক গ্রন্থে প্রাচীনকালে অর্থনীতি চর্চার কথা স্বীকার করা হলেও বস্তুতঃ অর্থনীতি সম্পূর্ণভাবে আধুনিক কালের শাস্ত্র।

অর্থনীতির সংজ্ঞা :-

সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকে অর্থনীতিকে বিভিন্ন অর্থনীতিবিদ বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। এই সংজ্ঞাগুলোকে তিন শ্রেণীতে ভাগ করা যায়। যেমন:

(i) সম্পদের বিজ্ঞান,

(ii) কল্যাণের বিজ্ঞান,

(ii) অপ্রাচুর্যের বিজ্ঞান।

আরও পড়ুনঃ অর্থের চাহিদা কাকে বলে?

অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে অ্যাডাম স্মিথ, ডেভিড রিকার্ডো, জন স্টুয়ার্ট মিল প্রমুখ ক্লাসিক্যাল অর্থনীতিবিদরা অর্থনীতিকে সম্পদের বিজ্ঞান (Science of Wealth) বলে অভিহিত করেন।

অর্থনীতির দ্বিতীয় সংজ্ঞার প্রধান প্রবক্তা হলেন আলফ্রেড মার্শাল, যাকে আধুনিক অর্থনীতির জনক বলা হয়। এছাড়াও ফিশার, পিও, ডেভেনপোর্ট, ক্যানন, অ্যারো প্রমুখ নিউ ক্লাসিকেল অর্থনীতিবিদরা অর্থনীতিকে কল্যাণের বিজ্ঞান (Science of Welfare) বলে অভিহিত করেছেন।

পক্ষান্তরে, এল রবিন্স হলেন তৃতীয় সংজ্ঞার প্রধান প্রবক্তা। রবিন্স প্রদত্ত সংজ্ঞাটি সবচাইতে বিজ্ঞানসম্মত। এর কিছু ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও এর গ্রহণযোগ্যতা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। অধ্যাপক এল রবিন্স, ক্রেয়ার ক্রস প্রমুখ অর্থনীতিবিদগণ অর্থনীতিকে "অপ্রাচুর্যের বিজ্ঞান" (Science of Scarcity) বলে অভিহিত করেছেন।

অ্যাডাম স্মিথের সংজ্ঞা :-

ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ অ্যাডাম স্মিথ এবং তাঁর অনুসারী ক্লাসিক্যাল অর্থনীতিবিদরা অর্থনীতিকে সম্পদের বিজ্ঞান বলে অভিহিত করেছেন। অ্যাডাম স্মিথ তাঁর 'An Inquiry into the Nature and Causes of the Wealth of Nations' নামক গ্রন্থে বলেছেন, অর্থনীতি হচ্ছে এমন এক বিজ্ঞান, যা জাতিসমূহের সম্পদের প্রকৃতি এবং তার কারণ অনুসন্ধান করে। সম্পদ কীভাবে উৎপাদিত হয় এবং তা কীভাবে মানুষের উপকারে লাগে তাই ছিল তার আলোচ্য বিষয়। অ্যাডাম স্মিথের সংজ্ঞাটি সম্পূর্ণভাবে ভুল নয়। অর্থনৈতিক আলোচনায় সম্পদ খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিন্তু অর্থনীতি মানুষের আচরণ নিয়েও আলোচনা করে।

মার্শালের সংজ্ঞা :-

অ্যাডাম স্মিথের সংজ্ঞায় সম্পদের ওপর বেশি গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছিল। কিন্তু মার্শালের সংজ্ঞায় মূল আলোচ্য বিষয় হলো অভাব মোচনসংক্রান্ত মানুষের দৈনন্দিন কার্যাবলি। ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত 'Economics of Industry' নামক গ্রন্থে মার্শাল বলেছেন, 'অর্থনীতি মানুষের জীবনের দৈনন্দিন সাধারণ কার্যাবলি আলোচনা করে। মানুষের সাধারণ কার্যাবলি বলতে বোঝায় যে, মানুষ কীভাবে অর্থ উপার্জন করে ও কিভাবে সেই উপার্জিত অর্থ তার বিভিন্ন অভাব মেটানোর জন্য বায় করে।' মার্শালের এ বক্তব্যের সাথে ক্যানন, অ্যারো, পিশু এবং অন্য অর্থনীতিবিদরা একমত প্রকাশ করেন।

এল. রবিন্সের সংজ্ঞা :-

এল. এস.ই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এল, রবিন্দ তাঁর 'Nature and Significance of Economic Science' নামক গ্রন্থে বলেছেন, “অর্থনীতি মানুষের অসীম অভাব এবং বিকল্প ব্যবহারযোগ্য সসীম সম্পদের সম্পর্ক বিষয়ক মানব আচরণ সম্বন্ধে আলোচনা করে।

অর্থনীতি কত প্রকার ও কি কি:-

অর্থনীতিকে দুটি দৃষ্টিকোন থেকে ভাগ করা হয়েছে।

বিষয়বস্তু তথা বক্তব্যের দিক থেকে অর্থনীতি দুই প্রকার,

১. ইতিবাচক অর্থনীতি ও
২. নীতিবাচক অর্থনীতি।

আবার তাত্ত্বিক দিক থেকে অর্থনীতি দুই প্রকার

১. ব্যষ্টিক অর্থনীতি ও
২. সামষ্টিক অর্থনীতি।
 
আরও পড়ুনঃ অর্থের যোগান কাকে বলে?

নিম্নে এসবের বিস্তারিত বিশ্লেষণ করা হলো-

ইতিবাচক অর্থনীতি (Positive Economics) :

একটি অর্থনীতিতে যা হয় বা হয়ে থাকে অর্থাৎ বিভিন্ন অর্থনৈতিক কর্মকান্ড যেগুলো বিভিন্ন সময় ঘটে থাকে সেগুলো ইতিবাচক বক্তব্য। আমাদের চারপাশে চলমান এসব অর্থনৈতিক সমস্যা বা জটিলতা বাস্তব তথ্য এবং অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান দ্বারা সমাধান করা যায়।

আর যেসকল সমস্যা বাস্তব তথ্য এবং অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান দ্বারা সমাধান করা সম্ভব সেগুলো ইতিবাচক অর্থনীতির আলোচ্য বিষয়।

যেমন- অর্থনীতিতে মুদ্রাস্ফীতি ঘটতে পারে, বেকারত্ব থাকতে পারে ইত্যাদি। এগুলো উচিত অনুচিতের প্রশ্ন দ্বারা বিবেচিত হয় না।

নীতিবাচক অর্থনীতি (Normative Economics) :

নীতিবাচক অর্থনীতিতে সেই সকল বক্তব্য স্থান পায় যেগুলো উচিত অনুচিতের প্রশ্ন দ্বারা আবদ্ধ। অর্থনীতিতে কোনটি হওয়া উচিত আর কোনটি হওয়া উচিত নয় ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়ে থাকে। এই অর্থনীতিতে কোনো সমস্যা বা জটিলতা দেখা দিলে তা বাস্তব তথ্য ও অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান দ্বারা সমাধান করা সম্ভব হয় না।

উপরের উদাহরণের প্রেক্ষিতে যদি বলা হয় মুদ্রাক্ষীতি সমস্যা সমাধানের পূর্বে বেকারত্ব সমস্যা সমাধান করা উচিত, তাহলে এই বক্তব্যটি হবে নীতিবাচক অর্থনৈতিক বক্তব্য।

বিষয়টি আরও স্পষ্ট করা যাক। যদি মুদ্রাস্ফীতিতে দ্রব্যের দাম বাড়ে তাহলে জনগনের বা ভোক্তার কষ্ট হয়, অন্যদিকে বেকারত্বের জন্য জনগনের জীবনযাত্রার মান কমে যায়। অতএব মুদ্রাস্ফীত ও বেকার সমস্যা দূর করতে হবে। ইত্যাদি হলো নীতিবাচক অর্থনৈতিক বিষয় ।

এখন চলুন ব্যষ্টিক ও সামষ্টিক অর্থনীতি নিয়ে আলোচনা করা যাক। এই দুটি মূলত অর্থনীতির দুটি শাখা।

ব্যষ্টিক অর্থনীতি (Microeconomics) :

ব্যষ্টিক শব্দের ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো Micro যা গ্রীক শব্দ Micros হতে উৎপত্তি লাভ করেছে যার অর্থ ক্ষুদ্র। অর্থনীতির যে অংশে অর্থনীতির ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিষয় নিয়ে আলোকপাত করা হয় অর্থাৎ ব্যক্তি, পরিবার তথা ফার্ম ইত্যাদির আচরণ ব্যাখ্যা করা হয় তাকে ব্যষ্টিক অর্থনীতি বলে।

এখানে একজন ব্যক্তির চাহিদা, ভোগ, সঞ্চয় ইত্যাদি গুরুত্ব পায়। একজন ভোক্তা কিভাবে সর্বোচ্চ উপযোগ পেতে পারে, একজন উৎপাদক কিভাবে সর্বনিম্ন ব্যয়ে সর্বোচ্চ মুনাফা পেতে পারে সেই আলোচনা করা হয় ব্যষ্টিক অর্থনীতিতে।

এখানে উৎপাদিত দ্রব্যের দাম কত হবে, ফার্মে নিয়োজিত শ্রমিকের মজুরি কিভাবে নির্ধারিত হয় তা ব্যষ্টিক অর্থনীতি বিশ্লেষণ থেকে জানা যায়। তাই বলা হয়, ব্যষ্টিক অর্থনীতি হচ্ছে অর্থনীতির বিশাল বিশ্বের ক্ষুদ্র আলোচনা।

সামষ্টিক অর্থনীতি (Macroeconomics) :

সামষ্টিক শব্দের ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো Macro যা গ্রীক শব্দ Macros হতে উৎপত্তি লাভ করেছে যার অর্থ বিশাল বা বৃহৎ। সামষ্টিক অর্থনীতি সামগ্রিক অর্থনীতি নিয়ে আলোচনা করে। অর্থনীতির বিষয়গুলোকে এখানে কতগুলো কম্পার্টমেন্ট বা সেক্টরে ভাগ করা হয়।

যেমন- ব্যক্তির আয়ের পরিবর্তে জাতীয় আয়, ব্যক্তিগত চাহিদার পরিবর্তে সামগ্রিক চাহিদা, ব্যক্তিগত যোগানের পরিবর্তে সামগ্রিক যোগান, ব্যক্তিগত সঞ্চয়ের পরিবর্তে মোট সঞ্চয়, মূল্যস্তর, মুদ্রাস্ফীতি, বেকারত্বের হার একটি দেশের আমদানি-রপ্তানি ইত্যাদি।

অর্থনীতির পরিধি বা বিষয়বস্তু :-

অর্থনীতি কী— এ বিষয়টি পরিষ্কার হবার পর আপনার মনে প্রশ্ন আসতে পারে যে অর্থনীতির পরিধি কতটা ব্যাপক অর্থনীতির পরিধি বা বিষয়বস্তু নিয়ে অর্থনীতিবিদদের মধ্যে নানা মতভেদ আছে। অর্থনীতির বিষয়বস্তু সম্পর্কে নিম্নোক্ত মন্তব্য করা যায়।

১. অর্থনীতি একটি সামাজিক বিজ্ঞান :

অর্থনীতি সমাজবদ্ধ মানুষের আচরণ ও কার্যাবলি আলোচনা করে। কিন্তু এটি মানুষের সব ধরনের কার্যাবলি বিশ্লেষণ করে না। যেসব কার্যাবলি অর্থ-আয় ও অর্থ-ব্যয়ের সাথে জড়িত, কেবল সেসব কার্যাবলি নিয়ে অর্থনীতি আলোচনা করে। আবার সমাজবহির্ভূত মানুষের আচরণ ও কার্যাবলি অর্থনীতির আলোচ্য বিষয় নয়।

২. অন্যান্য বিজ্ঞানের কিছু বিষয়বস্তু অর্থনীতিতে অন্তর্ভুক্ত :

অর্থনীতিকে অনেক সময় অন্যান্য বিষয়ের সাহায্য নিতে হয়। এমন অনেক অর্থনৈতিক বিষয়বস্তু আছে, যেগুলোর ক্ষেত্রে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছার জন্য রাষ্ট্রবিজ্ঞান, মনস্তাত্ত্বিক বিজ্ঞান, নীতিবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান প্রভৃতির সাহায্যের প্রয়োজন হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, আয়কর প্রগতিশীল হলে কর দাতাদের মানসিকতা কীরূপ হবে তা মনস্তাত্ত্বিক বিজ্ঞানের সাহায্যে জানা যাবে।

৩. অর্থনীতির মূল লক্ষ্য অভাব মোচন :

মানুষ কীভাবে তার অভাব মোচন করে তা-ই অর্থনীতির আলোচ্য বিষয়। সমাজবদ্ধ মানুষ তার সামাজিক জীবনে সীমাহীন অভাবের সম্মুখীন হয়। কিন্তু অসীম অভাবের তুলনায় সম্পদ অত্যন্ত সীমিত। স্টোনিয়ার এবং হেগ বলেছেন, অর্থনীতি স্বল্পতা এবং স্বল্পতাজনিত সমস্যাদি আলোচনার শাস্ত্র। মানুষ সীমিত সম্পদ নিয়ে কীভাবে প্রাপ্য সম্পদ উৎপন্ন করে এবং কীভাবে এ সম্পদের সুষ্ঠু বণ্টনের মাধ্যমে তার অভাব মোচন ও সার্বিক কল্যাণ অর্জন করে তা-ই অর্থনীতির মূল আলোচ্য বিষয়।

উপরোক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে এটা স্পষ্টই প্রতীয়মান হয় যে অর্থনীতির বিষয়বস্তু বা পরিধি অত্যন্ত ব্যাপক। অর্থনীতিবিদদের মধ্যে কেউ কেউ ব্যাপক অর্থে এবং কেউ কেউ সংকীর্ণ অর্থে এর পরিধি নির্ধারণ করেছেন।

অ্যাডাম স্মিথের মতে, জাতিসমূহের সম্পদের প্রকৃতি ও কারণ সম্পর্কে দান করা অর্থনীতির কাজ। আলফ্রেড মার্শাল যুক্তি দেন যে অর্থনীতির বিষয়বস্তু হলো- মানুষের দৈনন্দিন কার্যাবলি। অন্যদিকে অধ্যাপক রবিন্সের মতে, অপ্রাচুর্যজনিত সমস্যাবলীর অনুশীলন অর্থনীতির মূল বিষয়বস্তু।

আবার অধ্যাপক ভাইনার ( Prof. Viner ) অর্থনীতির পরিধিকে অত্যন্ত ব্যাপক করে তুলেছেন। তাঁর মতে, অর্থনীতিবিদরা যা কিছু আলোচনা করেন তা-ই অর্থনীতির আওতাভুক্ত। কিন্তু তাঁর এ বক্তব্য গ্রহণযোগ্য নয়।

অর্থনৈতিক বিধিসমূহ বাস্তবক্ষেত্রে প্রয়োগ করে অনেক অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান বের করা যায়। অর্থনৈতিক তত্ত্বজ্ঞান প্রয়োগ করে উৎপাদন, ভোগ, বণ্টন, সরকারি অর্থব্যবস্থা, ব্যাংক ও মুদ্রা ব্যবস্থা, বাজার ব্যবস্থা, দ্রব্যমূল্য নির্ধারণ, জনসংখ্যা, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য প্রভৃতি সংক্রান্ত সকল সমাধান বের করা সম্ভব। অতএব অর্থনীতির পরিধিও ব্যাপক।

অর্থনৈতিক সমস্যার প্রকৃতি (Nature of Economic Problems) :-

মানুষ কীভাবে সীমিত সম্পদ (ভূমি, শ্রম এবং মূলধন, দ্রব্য যেমন- ট্রাক, মেশিনারি, বিল্ডিং প্রভৃতি) ব্যবহার করে দ্রব্য ও সেবা উৎপাদন, বিনিময় ও ভোগ করে, অর্থনীতি তাই আলোচনা করে।

সীমিত সম্পদের সাহায্যে মানুষ তার সীমাহীন অভাব পূরণ করতে গিয়ে বিভিন্ন অর্থনৈতিক সমস্যার সম্মুখীন হয়। মানুষের জীবনের এই অর্থনৈতিক সমস্যার দুটো দিক রয়েছে। যেমন- (i) স্বল্পতা ও (ii) নির্বাচন।

(i) স্বল্পতা (Scarcity) :

মানুষের জীবনের সকল অর্থনৈতিক সমস্যার মূল হলো সম্পদের স্বল্পতা। যদি মানুষ সম্পদের স্বল্পতায় না ভূগত তাহলে অর্থনীতির আলোচনাও প্রয়োজন হতো না। মানুষের অসীম অভাবের তুলনায় সম্পদ খুবই সীমিত। তাকে এই সব সম্পদের মাধ্যমে তার অসীম অভাব পূরণ করতে হয়। এর ফলে স্বল্পতার সমস্যার উদ্ভব হয়। তার অর্থ এই নয় যে, মানুষ গরিব অথবা তার মৌলিক প্রয়োজনীয়তা অপূরণীয় থাকছে। সমাজে সম্পদের স্বল্পতার কারণে মানুষ তার সীমাহীন অভাব পূরণের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন অর্থনৈতিক কাজে লিপ্ত হয়।

(ii) নির্বাচন (Choice) :

নির্বাচন এবং স্বল্পতা পাশাপাশি অবস্থান করে। সম্পদের স্বল্পতা থেকে নির্বাচনের উদ্ভব হয়। আমরা জানি উৎপাদনের উপকরণসমূহ খুব সীমিত। একই উপকরণ একই সাথে দুটো কাজে ব্যবহার করা যায় না। যেমন একই জমিতে একই সাথে ধান ও পাট উৎপাদন করা যায় না।

সুতরাং উপকরণসমূহ ব্যবহার করার আগে মানুষকে ঠিক করতে হয়, কোন অভাবটি আগে মেটানো দরকার। সে তার অভাবসমূহের মধ্যে অধিকতর প্রয়োজনীয় অভাব আগে মিটাবে। এটিই বাছাই বা নির্বাচন সমস্যা।

একজন ব্যক্তি, ব্যাবসায়ী অথবা সমাজ সব সময় তার বিকল্পসমূহের নির্বাচনকার্যে নিয়োজিত থাকে। একজন ব্যক্তি ঠিক করবে, সে চাকরি করবে না লেখাপড়া করবে, ভোগ করবে না সঞ্চয় করবে, প্রভৃতি।

একজন ব্যাবসায়ী ঠিক করবে, সে কোথায় তার দ্রব্য সরবরাহ করবে, বঙ্গারে কী ধরনের দ্রব্য ছাড়বে, কতজন শ্রমিক নিয়োগ করবে, কোথায় তার নতুন ফার্ম প্রতিষ্ঠা করবে প্রভৃতি।

আবার একটি দেশ ঠিক করবে, দেশের সামাজিক কল্যাণ বৃদ্ধির জন্য বেশি অর্থ ব্যয় না করে বরং দেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার পেছনে অধিক অর্থ ব্যয় করবে, অধিক হারে কর আরোপ করবে প্রভৃতি।

অর্থনীতির মৌলিক সমস্যাসমূহ :

প্রতিদিন আমাদেরকে বিভিন্ন অর্থনৈতিক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। যেমন- দারিদ্র্যতা, মুদ্রাস্ফীতি, বেকারত্ব প্রভৃতি। আমরা অর্থনৈতিক সমস্যা বলতে সাধারণ সম্পদের স্বল্পতার কথা বিবেচনা করি। প্রত্যেক সমাজকেই এই সমস্যা মোকাবেলা করতে হয়। কিন্তু এসব সমস্যা ছাড়াও অর্থনীতির তিনটি মৌলিক বা কেন্দ্রীয় সমস্যা রয়েছে। সমস্যাগুলো নিম্নরূপ :

(i) কী উৎপাদন করা হবে?

(ii) কীভাবে উৎপাদন করা হবে?

(iii) কার জন্য উৎপাদন করা হবে?

অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের সংজ্ঞা :-

সাধারণত অর্থনৈতিক প্রবন্ধি ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন শব্দ দুইটি একই অর্থে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু অর্থনীতির আলোচনায় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন এক জিনিস বোঝায় না।

অধ্যাপক সুম্পিটার ও মিসেস হিকস অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ করেছে।

অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বলতে বর্তমান অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাঠামোর কোনরূপ পরিবর্তন ছাড়াই কোন দেশের জাতীয় উৎপাদন বৃদ্ধির প্রক্রিয়াকে বোঝায়।

পক্ষান্তরে, অর্থনৈতিক উন্নয়ন বলতে দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোর উন্নয়ন সাধন করে মাথাপিছু আয় বৃদ্ধিকে বোঝায়।

এ মডিসন এর মতে, "উন্নত দেশগুলোতে মানুষের আয়সীমা বৃদ্ধি পেলে তাকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বলে এবং অনুন্নত দেশে তাকে অর্থনৈতিক উন্নয়ন বলা হয়।”

কিন্ডলবার্গার এর মতে, “অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হল অধিক উৎপাদন এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন অধিক উৎপাদন এবং যে সব কারিগরী কৌশল ও প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এ উৎপাদন বিতরণ ও সম্পাদিত হয় তাদের পরিবর্তন উভয়কেই বুঝায়।"

ফ্রিজম জন ফ্রিডম্যান বলেন, “সামাজিক ব্যবস্থাকে কোন কাঠামোগত পরিবর্তন না করে। এক বা একাধিক মাত্রায় প্রসার ঘটানোকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বলে। আবার অর্থনৈতিক উন্নয়ন হচ্ছে সামাজিক ব্যবস্থার নতুন কোন কাঠামোগত পরিবর্তন আনা।”

অর্থাৎ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এমন একটি প্রক্রিয়া যার দ্বারা দেশের জাতীয় আয়, মাথাপিছু আয় ইত্যাদির বাৎসরিক বৃদ্ধি বোঝায়।

অন্যদিকে, অর্থনৈতিক উন্নয়ন বলতে দেশের জাতীয় আয়, মাথাপিছু আয়, উৎপাদন ক্ষমতা ও জীবনযাত্রার মানের ক্রমোন্নতির এক দীর্ঘকালীন প্রক্রিয়াকে বুঝায়। অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক কাঠামো পরিবর্তিত হয় এবং সমাজে নতুনতর গতিবেগ সৃষ্টি হয়। উন্নয়ন শুধুমাত্র উৎপাদনের পরিমাণবাচক পরিবর্তনই আনয়ন করেনা, সাথে সাথে গুণবাচক পরিবর্তনও আনয়ন করে।

অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের মধ্যে পার্থক্য :-

প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের উপরোক্ত সংজ্ঞা থেকে এদের মধ্যে নিম্নোক্ত পার্থক্যসমূহ লক্ষ্য করা যায়:

১. অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন উভয় ক্ষেত্রেই জাতীয় আয় বৃদ্ধি পায়। তবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে কেবলমাত্র অর্থনৈতিক হাতিয়ারগুলোকে সুদক্ষ ব্যবহারের মাধ্যমে জাতীয় আয় বৃদ্ধি করা হয়।

পক্ষান্তরে, অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে দেশের অর্থনীতির মৌলিক কাঠামো পরিবর্তনের মাধ্যমে দেশের জাতীয় আয় দেশের অন্যান্য উন্নয়ন সূচক বৃদ্ধি পায়।

২. অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে দেশের উৎপাদন ব্যবস্থায় কেবলমাত্র পরিমাণগত পরিবর্তন আগে।

পক্ষান্তরে, অর্থনৈতিক উন্নায়নের ক্ষেত্রে দেশের উৎপাদন ব্যবস্থার গুণগত ও পরিমাণগত উভয় প্রকার পরিবর্তন সাধিত হয়।

৩. একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন একটি বিস্তৃত বা ব্যাপক ধারণা।

অপরপক্ষে, প্রবৃদ্ধি তুলনামূলকভাবে একটি সংকীর্ণ ধারণা।

৪. শ্রমিকের জীবন ধারণ উপযুক্ত মঞ্জুরির চেয়ে কম মজুরি দিয়ে এবং অধিকতর পরিশ্রম করে জাতীয় আয় বৃদ্ধির ফলে প্রবৃদ্ধি হয় কিন্তু তাতে উন্নয়ন নাও হতে পারে।

৫. উৎপাদনের গঠন প্রণালি বাদ দিয়ে উন্নয়ন নাও হতে পারে। যেমন: আবহাওয়ার অনুকূল অবস্থার কারণে কোন বছর কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি পেতে পারে। এ ক্ষেত্রেও জাতীয় বুদ্ধিকে অর্থনৈতিক উন্নয়ন বলা যাবে না, কিন্তু এটা অবশ্যই প্রবৃদ্ধি ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ