আখ্যান কাব্য কাকে বলে | এর সূচনা, বৈশিষ্ট্য ও ধারা

আখ্যান কাব্যের সূচনা :-

মধ্যযুগে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে আখ্যান কাব্যের ধারা সূচনা হয়েছিল। বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগের রচনাগুলি প্রায় সবই আখ্যান নির্ভয় কাব্য। আধুনিক বাংলা কাব্য-সাহিত্যের সূচনালগ্নেই আখ্যানকাব্য ধারার শুরু। রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় এর হাত ধরে জাতীয় কাব্যধারার পথ চলা আরম্ভ 'পদ্মিনী উপাখ্যান' (১৮৫৮) সেই অর্থে বাংলার প্রথম আখ্যানকাব্য। এছাড়াও অন্যান্য উল্লেখযোগ্য আখ্যান কাব্যগুলি হল-
  • রঙ্গলালের কর্মদেবী শূরসুন্দরি, কাপ্টীকাবেরী,
  • মধুসুদন দত্তের তিলোত্তমা সম্ভব; ব্রজাঙ্গনা;
  • হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের বীরবাহু,
  • নবীনচন্দ্র সেনের পলাশীর যুদ্ধ, রঙ্গমতী প্রভৃতি।

এখন প্রশ্ন হলো আখ্যান কাব্য কাকে বলে? বা কি ? তা আলোচনা করা।

আখ্যান কাব্য কাকে বলে :-

ইংরাজিতে যাকে বলা হয় Narrative Poetry, বাংলায় তাকেই বলা যায় – আখ্যানকাব্য, কাহিনীকাব্য বা উপাখ্যান। Narrative: কথাটি থেকে এর বর্ণনাগত দিকটি এবং 'আখ্যান' কথাটি থেকে এর ভাবগত দিকটি পরিস্ফুট হয়। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের এই দুই মিলিয়ে নিলে এর সম্পর্কে একটি ধারনা সহজেই গড়ে উঠে।


মরিম উলসান 'Twentieth Century Narrative Poems' যে সঙ্কলন করেছেন, তার ভূমিকায় তিনি এই ধরনের রচনার পিছনে কাহিনী পরিবেশনের তাগিদটিকেই বড়ো করে দেখেছেন। এই কাহিনী কালের বর্ণনাভঙ্গিটিকেই মনে রেখে Narrative কথাটি প্রযুক্ত হয়েছে।

আখ্যান শব্দের সাধারণ অর্থ কাহিনী। যখন কোনো কোনো কাব্য আখ্যান বা কাহিনীকে ভিত্তি করে গড়ে ওঠে, তখন তাকে আখ্যানকাব্য বলে।

কোন আখ্যায়িকা বা আখ্যানবস্তুকে সম্বল করে যখন কোন কাব্য রচনা করা হয় তখন তাকে আখ্যানকাব্য বলে।


এম. এইচ. আব্রামস বলেছেন-
“A narrative is a story, whether told in prose or verse, involving events, characters, and what the characters say and do. Some literary forms such as .... the epic and romance in verse, are explicit narratives that are told by a narrator.”
আখ্যান কাব্য কাকে বলে | এর সূচনা, বৈশিষ্ট্য ও ধারা
আখ্যান, নাটক বা উপন্যাসেও থাকে। কিন্তু আখ্যান কাব্যের আখ্যানের উপস্থাপনের একটি নিজস্ব বৈশিষ্ট্য আছে। নাটক উপন্যাসের কাহিনী বাস্তব জগতের নানা বৈচিত্র্যের বর্ণনায় পূর্ণ। তার লক্ষ্য জীবনকে চিত্রিত করা।

আর কাব্যে রচিত কাহিনীর লক্ষ্য হল, মানুষের জীবনের বাস্তব প্রকাশের পিছনে যে নিগূঢ় সত্য অদৃশ্য থেকেও নানা রূপে ও ভাবে জীবনকে সঙ্গীতে ও মাধুর্যে, বেদনায় ও আবেগে অনুরঞ্জিত করে চলেছে, তাকে প্রকাশ করা।

আখ্যানকাব্যও বাস্তবকে চিত্রিত করে কিন্তু তার মধ্যে বড় হয়ে ওঠে সৌন্দর্যের অনির্বচনীয়তা। এর মধ্যে যে কাহিনীটি থাকে, তা কবি ভাবলোকে সৃষ্ট সত্যের ছায়ায় প্রকাশ। আখ্যান কাব্যের সত্য হল – মানব আদর্শের সত্য নাটক বা উপন্যাসের কাহিনীর সত্য, মানবজীবনের সত্য। কাজেই, আখ্যানকাব্য এবং নাটক উপন্যাসের আখ্যানের উদ্দেশ্য ভিন্ন, দৃষ্টিকোণ ভিন্ন এবং উপায়ও ভিন্ন। গীতিকাব্য, গাথাকাব্য ও মহাকাব্য থেকে আখ্যানকাব্য অনেকটাই আলাদা।

আখ্যানকাব্যের বৈশিষ্ট্য :-

  • আদি-মধ্য-অন্ত্যযুক্ত কাহিনী আখ্যানকাব্যের বিষয়।
  • ঐতিহাসিক ঘটনা সমূহ বা রোমান্টিক কাহিনী এসব আখ্যান কাব্যে কবির কল্পিত বিষয়।
  • নানান চরিত্রের সমাবেশ ঘটে আখ্যান কাব্যে।
  • তবে চরিত্রের মনোবিশ্লেষণ নয়, প্রাধান্য পায় তার কর্মকান্ড।
  • আখ্যান কাব্য বর্ণনাত্মক।
  • মূলত বীর ও করুণ রস এ কাব্যের আঙ্গিরস।

আখ্যান কাব্যের ধারা :-

আখ্যান কাব্যের মোট ৫ টি ধারার সন্ধান পাওয়া গেছে। এগুলো হলো-

১. পৌরাণিক বা দেবদেবীর মাহাত্ম্য জ্ঞাপক আখ্যান কাব্য :-

গিরিশচন্দ্র বসুর 'বালিবধ' (১৮৭৬), হেমচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়ের 'বৃত্রসংহার' (১৮৭৫), আনন্দচন্দ্র মিত্রের 'হেলেনাকাব্য'

২. জীবনীমূলক আখ্যান কাব্য :-

নবীনচন্দ্র সেন 'খৃষ্ট' (১৮৯০), 'অমিতাভ' (১৮৯৫), 'অমৃতাভ' (১৯০০) এবং আনন্দচন্দ্র মিত্রের রাজা রামমোহনের জীবনী অবলম্বনে রচিত 'ভারতমঙ্গল' (১৮৯৪)।

৩. ইতিহাস আশ্রিত, দেশপ্রেমমূলক আখ্যান কাব্য :-

রঙ্গলালের 'পদ্মিনীর উপাখ্যান' (১৮৫৮), নবীনচন্দ্র সেনের 'ক্লিওপেট্রা' (১৮৭৭), কালীপ্রসন্ন বন্দোপাধ্যায়ের'লুক্রোশিয়া' (১৮৭৯), হেমচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়ের 'বীরবাহু কব্য' (১৮৯৪)।


৪. আদি রসাত্মক, প্রণয়মূলক আখ্যান কাব্য :-

মধুসূদন দাস ও কালীকৃষ্ণ দাসের যৌথভাবে লেখা ‘কামিনীকুমার' (১৮৫০), মহেশচন্দ্র মিত্রের 'লায়লা মজনু' (১৮৫৩), আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের 'প্রমোদ কামিনী কাব্য' (১৮১৭)।

৫. গাথা বা নবীন রোমান্টিক কাব্য :-

অক্ষয়চন্দ চৌধুরীর 'উদাসিনী' (১৮৭৪), রবীন্দ্রনাথের 'কবিকাহিনী' (১৮৭৮), 'বনফুল' (১৮৮০)।

উনিশ শতকের আখ্যান কাব্য :-

উনিশ শতকের আখ্যান কাব্য নিয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াবলী:

১) এই সময় আখ্যান কাব্য খুব জনপ্রিয় ছিল। বিখ্যাত কবিরা যেমন - ইশ্বর ঘোষ, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ - অনেক পরিমাণ আখ্যান কাব্য রচনা করেছিলেন।

২) এই সময়ের আখ্যান কাব্যে রূপালীবদ্ধ নারীচরিত্র, রহস্যময় ঘটনা, ঐতিহাসিক কাহিনী প্রভৃতির বিষয়বস্তু ছিল প্রধান।

৩) ভাষার দক্ষতা, রসনির্বাচনের মাধুর্য এবং প্রতীকবিন্যাস নিয়ে এই সময়ের আখ্যান কাব্যের বৈশিষ্ট্য ছিল।

৪) আধুনিক ভাবধারার সংস্পর্শে এসে রোম্যান্টিক এবং সামাজিক চিত্রণের আখ্যান কাব্যও বেশি গুরুত্ব পায়।

৫) সামাজিক পরিস্থিতির প্রতিফলন: এই সময়ের আখ্যান কাব্যে তৎকালীন সমাজ, সংস্কৃতি এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রতিফলন ঘটেছিল।

৬) পাঠকপ্রিয়তা: রোচক বিষয়বস্তুর কারণে এসময়ের আখ্যান কাব্য ছিল খুব পাঠকপ্রিয়।

৭) ভাষা ও শৈলী: সাধারণ কথোপকথনের ভাষায় লেখার চেষ্টা করেছিলেন লেখকরা। শৈলীও ছিল সহজ ও সরল।

৮) মুদ্রণ ব্যবস্থা: এই সময় মুদ্রণ ব্যবস্থার বিকাশে আখ্যান কাব্যের প্রকাশনাও সহজলভ্য হয়েছিল।

আখ্যান কাব্য ও মহাকাব্যের পার্থক্য :-

আখ্যান কাব্য ও মহাকাব্যের মধ্যে বেশ কিছু পার্থক্য রয়েছে:

আকার ও বিস্তার:

- আখ্যান কাব্য সাধারণত ছোট আকারের। মহাকাব্য বৃহৎ আকারের।

বিষয়বস্তু:
 
- আখ্যান কাব্যে একটি ঘটনা বা চরিত্র তুলে ধরা হয়। মহাকাব্যে একাধিক ঘটনা ও অনেক চরিত্র থাকে।

গঠনতন্ত্র:

- আখ্যান কাব্যের গঠনতন্ত্র সরল। মহাকাব্যের গঠনতন্ত্র জটিল।

প্রসঙ্গবিস্তার:
 
- আখ্যান কাব্যে একটি নির্দিষ্ট ঘটনা বা চরিত্রের উপর গুরুত্ব দেয়া হয়। মহাকাব্যে ব্যাপক আয়ত্তে একাধিক ঘটনা তুলে ধরা হয়।

চরিত্র গঠন:

- আখ্যান কাব্যে চরিত্রগুলো খুব ব্যাপকভাবে তুলে ধরা হয় না। মহাকাব্যে চরিত্রগুলোর বিস্তারিত বর্ণনা থাকে।

মানবিক মূল্যায়ন:

- আখ্যান কাব্যে একটি ঘটনা বা চরিত্রের মানবিক মূল্যায়ন থাকে না। মহাকাব্যে বিস্তারিত মানবিক মূল্যায়ন করা হয়।

এইরকম আরো অনেক পার্থক্য রয়েছে আখ্যান কাব্য ও মহাকাব্যের মধ্যে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ

  1. মধ্যযুগীয় আখানকাব্য ও আধুনিক আখনকাব্য আর পার্থক্য কি??

    উত্তরমুছুন

Please do not enter any spam link in the comment box.