ব্যঞ্জনধ্বনি কাকে বলে? ব্যঞ্জনধ্বনি কয়টি ও কি কি? উদাহরণ দাও? ব্যঞ্জনধ্বনির শ্রেণীবিভাগ

ভাষার ক্ষুদ্রতম একক হলো ধ্বনি। এই ধ্বনিকে সাধারণত দুই ভাগে ভাগ করা যায়, একটি স্বরধ্বনি ও অপরটি ব্যঞ্জনধ্বনি

আমরা অন্য একটি পোস্টে ধ্বনি কাকে বলে ও স্বরধ্বনির প্রকারভেদ নিয়ে আলোচনা করেছি। কিন্তু এখানে প্রশ্ন আসে ব্যঞ্জনধ্বনি কাকে বলে এবং এর প্রকারভেদ কি কি? তা আমরা এই পোস্টে জানবো।

ব্যঞ্জনধ্বনি কাকে বলে :-

যে ধ্বনি উচ্চারণের সময় মুখের ভেতরে কোথাও না কোথাও বাধা পায় এবং যা স্বরধ্বনির সাহায্য ছাড়া স্পষ্টরূপে উচ্চারিত হতে পারে না তাকে ব্যঞ্জনধ্বনি বলে।

অথবা আমরা এটাও বলতে পারি, যেসব ধ্বনি স্বরধ্বনির সাহায্য নিয়ে উচ্চারণ করা হয় সেই সব ধ্বনিকে ব্যঞ্জনধ্বনি বলে।
ব্যঞ্জনধ্বনি কাকে বলে? উদাহরণ দাও

ব্যঞ্জনধ্বনি কয়টি ও কি কি :-

বাংলা ভাষায় ব্যঞ্জন বর্ণের সংখ্যা ৩৯ টি।
  • ক, খ, গ, ঘ, ঙ,
  • চ, ছ, জ, ঝ, ঞ,
  • ট, ঠ, ড, ঢ, ণ,
  • ত, থ, দ, ধ, ন,
  • প, ফ, ব, ভ, ম,
  • য, র, ল,  , শ,
  • ষ, স, হ, ড়, ঢ়,
  • য়, ৎ, ং, : ঁ,

বাংলা ভাষায় ব্যঞ্জনধ্বনির সংখ্যা ৩০ টি।
  • ক, খ, গ, ঘ, ঙ,
  • চ, ছ, জ, ঝ,
  • ট, ঠ, ড, ঢ,
  • ত, থ, দ, ধ, ন,
  • প, ফ, ব, ভ, ম,
  • , র, ল, ব, শ,
  • , স, হ, ড়, ঢ়,
  • , ৎ, ং, ঃ, ঁ,


ব্যঞ্জনধ্বনির উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় - ক (ক+অ), ম (ম+অ), শ (শ+অ) প্রভৃতি।

ব্যঞ্জনধ্বনির শ্রেণীবিভাগ বা প্রকারভেদ :-

ব্যঞ্জনধ্বনির প্রকারভেদ প্রধানত তিন ভাগে বিভক্ত। যথা :-
  1. স্পর্শধ্বনি,
  2. অন্তঃস্থ ধ্বনি এবং
  3. উষ্মধ্বনি।
উচ্চারণ স্থান অনুযায়ী ব্যঞ্জন ধ্বনির শ্রেণীবিভাগ :-

আবার অন্যদিকে উচ্চারণস্থান অনুসারে ব্যঞ্জনধ্বনির শ্রেনীবিভাগকে পাঁচটি বিভাগে বিভক্ত করা যায়। যেমন -
  1. কণ্ঠ্য বা জিহ্বামূলীয় ধ্বনি
  2. তালব্যধ্বনি
  3. মূর্ধন্যধ্বনি
  4. দন্ত্যধ্বনি
  5. ওষ্ঠ্যধ্বনি
এখন প্রশ্ন হলো এই সব ব্যঞ্জনধ্বনি বলতে কি বুঝায়? তা আলোচনা করা।

বিভিন্ন প্রকার ব্যঞ্জনধ্বনির সংজ্ঞা :-

১ - স্পর্শধ্বনি :-

যেসব ব্যঞ্জনধ্বনির উচ্চারণে জিভ মুখের ভেতরে কণ্ঠ, তালু, মূর্ধা, দত্ত, ওষ্ঠ প্রভৃতি কোনো না কোনো স্থান স্পর্শ করে উচ্চারিত হয়, তাদেরকে স্পর্শধ্বনি বলে। ক থেকে ম পর্যন্ত এই পঁচিশটি ধ্বনিকে স্পর্শধ্বনি বলা হয়।

এই ধ্বনিগুলিকে বর্গীয় ধ্বনিও বলা হয়। প্রথম ধ্বনির নাম অনুসারে বর্গের নাম নির্দেশ করা হয়। পাঁচটি বর্গ হল –
ক বর্গক খ গ ঘ ঙ
চ বর্গচ ছ জ ঝ ঞ
ট বর্গট ঠ ড ঢ ণ
ত বর্গত থ দ ধ ন
প বর্গপ ফ ব ভ ম
স্পর্শব্যাঞ্জনধ্বনি আবার ৪ প্রকার। যথা –

ক) ঘোষ ধ্বনি –

যে স্পর্শ ধ্বনি গুলি উচ্চারণের সময় ঘোষ অর্থাৎ কন্ঠস্বরে গাম্ভীর্যভা থাকে সেগুলিকে ঘোষ ধ্বনি বলে। বর্গের তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম ধ্বনি অর্থাৎ গ-ঘ-ঙ, জ-ঝ-ঞ, ড-ঢ-ণ, দ-ধ-ন, ব-ভ-ম – হল ঘোষধ্বনি ।

খ) অঘোষ ধ্বনি –

যে স্পর্শধ্বনি গুলি উচ্চারণের সময় কণ্ঠস্বরে মৃদুভাব থাকে সেগুলিকে অঘোষধ্বনি বলে । বর্গের প্রথম ও দ্বিতীয় ধ্বনি অর্থাৎ ক-খ, চ-ছ, ট-ঠ, ত-থ, প-ফ হল অঘোষ ধ্বনি।

আরও পড়ুন :- দ্বিশ্বর ধ্বনি কি ও কয়টি

গ) অল্পপ্রাণ ধ্বনি -

বর্গের প্রথম ও তৃতীয় ধ্বনির উচ্চারণের সময় প্রাণ অর্থাৎ শ্বাসবায়ু জোরে বার হয় না বলে এদের অল্পপ্রাণ ধ্বনি বলে। অল্পপ্রাণ ধ্বনিগুলি হল – ক-গ, চ-জ, ট-ড. ত-দ, প-ব।

ঘ) মহাপ্রাণ ধ্বনি -

বর্গের দ্বিতীয় ও চতুর্থ ধ্বনির উচ্চারণের সময় শ্বাসবায়ু জোরে বের হয় বলে, এইসব ধ্বনি গুলোকে মহাপ্রাণ ধ্বনি বলে। এগুলি হল – খ- ঘ, ছ- ঝ, ঠ-ঢ, থ-ধ, ফ-ভ। এছাড়া হ-কেও মহাপ্রাণ ধ্বনি বলে।

২ - অন্তঃস্থ ধ্বনি :-

য, য়, র, ল এবং অন্তঃস্থ-ব এই ধ্বনিগুলোর অবস্থান স্পর্শধ্বনি ও উষ্মধ্বনির মাঝামাঝি বলে এদেরকে অন্তঃস্থ ধ্বনি বলে।

৩ - উষ্মধ্বনি :-

যেসব ব্যঞ্জনধ্বনির উচ্চারণে ধ্বনিগুলোর রেশ টেনে রাখা যায়, তাদেরকে উষ্মধ্বনি বলে। শ, ষ, স, হ উষ্মধ্বনি।

একটি মজার বিষয় হলো শ, ষ, স এই তিনটি ধ্বনিকে শিস ধ্বনিও বলা হয়। কারণ শিস দেওয়ার সঙ্গে এ ধ্বনিগুলোর সাদৃশ্য রয়েছে।

৪ - কণ্ঠ্যধ্বনি :-

যেসব ধ্বনির উচ্চারণস্থান কণ্ঠনালির উপরিভাগ বা জিহ্বামূল, তাদের কণ্ঠ্যধ্বনি বলে। ক, খ, গ, ঘ, উ, হ কণ্ঠ্যধ্বনি।

৫ - তালব্যধ্বনি :-

যেসব ধ্বনির উচ্চারণস্থান তালু, তাদের তালব্যধ্বনি বলে। চ, ছ, জ, ঝ, ঞ, য়, শ ভালব্যধ্বনি।

৬ - মূর্ধন্যধ্বনি :-

যেসব ধ্বনির উচ্চারণস্থান মূর্ধা বা তালুর অগ্রভাগ, তাদের মূর্ধন্যধ্বনি বলে। ট, ঠ, ড, ঢ, ণ, র, ড়, ঢ়, মূর্ধন্যধ্বনি ।


৭ - দন্ত্যধ্বনি :-

যেসব ধ্বনির উচ্চারণস্থান দন্তমূল, তাদের দন্ত্যধ্বনি বলে। ত, থ, দ, ধ, ন, ল, স দন্ত্যধ্বনি ।

৮ - ওষ্ঠ্যধ্বনি :-

যেসব ধ্বনির উচ্চারণস্থান ওষ্ঠ, তাদের ওষ্ঠ্যধ্বনি বলে। প, ফ, ব, ভ, ম ওষ্ঠ্যধ্বনি ।

অযোগবাহ ধ্বনি— এ বর্ণ দুটিকে অযোগবাহ বর্ণ বা অযোগবাহ ধ্বনি বলে, কারণ এরা নিজে নিজে কোন শব্দ তৈরি করতে পারে না, অন্যের সঙ্গে যুক্ত হয়ে তবে উচ্চারিত হয় বলে এদের অযোগবাহ বলে।

পার্শ্বিক ব্যঞ্জন ধ্বনি – ল' কে পার্শ্বিক ব্যঞ্জন ধ্বনি বলে।

তাড়নজাত ব্যঞ্জন ধ্বনি –  ড় এবং ঢ় কে তাড়নজাত ব্যঞ্জন ধ্বনি বলে। কারণ ধ্বনি দুটি উচ্চারণকালে জিডের অগ্রভাগ উলটে দিয়ে দন্তমূলে আঘাত করে। তাই এদের বলা হয় তাড়নজাত বঞ্জন ধ্বনি।

কম্পনজাত ধ্বনি – র, ন, ল, কে কম্পনজাত ধ্বনি বলে।

নাসিক্য ধ্বনি – ন, ম ধ্বনি গুলি উচ্চারণের সময় শ্বাসবায় নাসিকার ভিতর দিয়ে নির্গত হয় বলে এদের নাসিকা ধ্বনি বলে।


ব্যঞ্জনধ্বনির বৈশিষ্ট্য :-

ব্যঞ্জনধ্বনির কিছু গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য নিম্নরূপ:

১. উচ্চারণস্থান: ব্যঞ্জনধ্বনির উচ্চারণস্থান হল মুখপ্রান্তর। এর উচ্চারণে বায়ুপ্রবাহে অংশিক বা সম্পূর্ণ অবরোধ সৃষ্টি হয়।

২. তীব্রতা: ব্যঞ্জনধ্বনির তীব্রতা অনেক বেশি। স্বরধ্বনির তুলনায় এর শব্দ উচ্চ এবং স্পষ্ট।

৩. স্থায়িত্ব: ব্যঞ্জনধ্বনি অপেক্ষাকৃত অস্থায়ী। একই ব্যঞ্জনধ্বনিকে অনেকক্ষণ ধরে উচ্চারণ করা কঠিন।

৪. শব্দের সংখ্যা: প্রতিটি ভাষায় ব্যঞ্জনের সংখ্যা সীমিত, সাধারণত ২০-৪০টির মধ্যে।

৫. বাধাস্থান: ব্যঞ্জন উচ্চারণের সময় নাক, ঠোঁট, কনুই, দাঁত ইত্যাদির সাহায্যে বায়ুপ্রবাহে বাধা সৃষ্টি করে।

৬. ধ্বনির উৎপত্তি: ব্যঞ্জনধ্বনি মুখপ্রান্তরের বিভিন্ন অংশ এবং বায়ুপ্রবাহের সংঘর্ষ থেকে উৎপন্ন হয়।

এসব বৈশিষ্ট্যের কারণেই ব্যঞ্জনধ্বনিকে ভাষার মূলধ্বনি হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

বাংলা ভাষার ব্যঞ্জনধ্বনির প্রয়োজনীয়তা :-

বাংলা ভাষার ব্যঞ্জনধ্বনির কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনীয়তা নিম্নরূপ:

১. শব্দ ও অর্থ পরিষ্কারকরণ:

ব্যঞ্জনধ্বনির সাহায্যে শব্দের অর্থ পরিষ্কার করা যায়। যেমন- খাল এবং কাল শব্দগুলো শুধু ব্যঞ্জনভিন্নতার কারণেই পারস্পরিক অর্থবৈষম্য লাভ করেছে।

২. বাক্যের গঠন:

ব্যঞ্জনধ্বনির সাহায্যে ভাষার বাক্যগুলো গঠিত হয় এবং তার অর্থগত পরিপূর্ণতা হয়।

৩. উচ্চারণ বৈচিত্র:

ব্যঞ্জনের বৈচিত্র্যময় ব্যবহারের ফলে বাংলা ভাষার শব্দ ও বাক্যের উচ্চারণে বৈচিত্র্য এসেছে।

৪. শব্দ সংখ্যা বৃদ্ধি:

ব্যঞ্জনধ্বনির সাহায্যে বাংলা ভাষায় অসংখ্য শব্দের সৃষ্টি সম্ভব হয়েছে।

৫. মাতৃভাষা শিক্ষায় প্রয়োজনীয়:

ব্যঞ্জনধ্বনি শিক্ষা মাতৃভাষা শিক্ষার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। ব্যঞ্জন শিক্ষা ছাড়া কোন ভাষাই শিক্ষার সম্ভব নয়।

এভাবে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জন্য ব্যঞ্জনধ্বনি অপরিহার্য প্রয়োজনীয়।

স্বরধ্বনি ও ব্যঞ্জনধ্বনি পার্থক্য :-

স্বরধ্বনি এবং ব্যঞ্জনধ্বনির মধ্যে প্রধান পার্থক্যগুলি নিম্নৰূপ:

১. উচ্চারণস্থান:

স্বরধ্বনির উচ্চারণস্থান হল মুখপ্রান্তর ও গলার মধ্যবর্তী অংশ। অন্যদিকে, ব্যঞ্জনধ্বনির উচ্চারণস্থান হল মুখপ্রান্তর।

২. অবরোধস্থান:

স্বরধ্বনির উচ্চারণের সময় বায়ুপ্রবাহের কোন অবরোধ হয় না, কিন্তু ব্যঞ্জনধ্বনির উচ্চারণের সময় বায়ুপ্রবাহে অংশিক বা সম্পূর্ণ অবরোধ ঘটে।

৩. তীব্রতা:

স্বরধ্বনির তীব্রতা কম থাকে, অন্যদিকে ব্যঞ্জনধ্বনির তীব্রতা বেশি।

৪. ধ্বনির উৎপত্তি:

স্বরধ্বনি বক্ষের কম্পন থেকে ও বায়ুপ্রবাহ থেকে উৎপন্ন হয়। অন্যদিকে, ব্যঞ্জনধ্বনি মুখপ্রান্তর এর বিভিন্ন অংশের সঙ্গে বায়ুপ্রবাহের সংঘর্ষ থেকে তৈরি হয়।

৫. স্থায়িত্ব:

স্বরধ্বনি অপেক্ষাকৃত স্থায়ী থাকে, যেমন 'আ' স্বরধ্বনিটি অনেকক্ষণ ধরে উচ্চারণ করা যায়। ব্যঞ্জনধ্বনি একটু অস্থায়ী, যেমন 'ক' ব্যঞ্জনধ্বনিটি অনেকক্ষণ ধরে উচ্চারণ করা কঠিন।

এই পার্থক্যগুলি ব্যতিরেকে স্বরধ্বনি ও ব্যঞ্জনধ্বনি পারস্পরিক পূরক। একটি ভাষার মৌলিক ধ্বনি হিসেবে উভয়েই গুরুত্বপূর্ণ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

2 মন্তব্যসমূহ

Please do not enter any spam link in the comment box.