পদাশ্রিত নির্দেশক কাকে বলে ও কত প্রকার? পদাশ্রিত নির্দেশকের ব্যবহার

ভাষায় কিছু পদ আছে যেগুলো অন্য পদের নির্দিষ্টতা বুঝিয়ে থাকে। নির্দিষ্টতা জ্ঞাপনকারী এই পদগুলো সাধারণত নামপদের পরে বসে বা আশ্রয়ে থাকে। তাই বাংলা ব্যাকরণে এদেরকে পদাশ্রিত নির্দেশক বলা হয়ে থাকে।

তবে এই নির্দেশক পদের ব্যবহারের কতিপয় নিয়মও রয়েছে। আবার বাংলা ভাষার শব্দগঠনের পদাশ্রিত নির্দেশকের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।

পদাশ্রিত নির্দেশক গুলো ব্যক্তি বা বস্তুকে নির্দিষ্ট করে প্রকাশে ব্যবহৃত হয়। এই পোস্টে বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত এসব পদাশ্রিত নির্দেশকের ব্যাকরণিক বৈশিষ্ট্য উপস্থাপন করা হয়েছে।

পদাশ্রিত নির্দেশক কাকে বলে :-

যে সব অব্যয় বা প্রত্যয় বিশেষ্য ও সর্বনাম পদকে নির্দেশ করার জন্য বিশেষ্য বা সর্বনামের সঙ্গে যুক্ত হয়, সেগুলোকে পদাশ্রিত নির্দেশক বলা হয়।

সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় এ প্রসঙ্গে বলেছেন,

"কোনো বিশেষ্য দ্বারা দ্যোতিত পদার্থের রূপ, প্রকৃতি অথবা তৎসম্বন্ধে বক্তার মনের ভাব প্রকাশ করার একটা বিশেষ উপায় বাঙ্গালা ভাষায় আছে। টা, টি, টুকু, টুক, খানা, খানী (খানি) জল প্রভৃতি কতগুলো শব্দ বা শব্দাংশ আছে যেগুলি বিশেষ্যের সহিত (অথবা বিশেষ্যের পূর্বে ব্যবহৃত সংখ্যাবাচক বিশেষণের সহিত) সংযুক্ত হইয়া যায়। পদার্থ বা বস্তুর গুণ বা প্রকৃতি নির্দেশ করে। এই রূপ শব্দ বা শব্দাংশকে পদাশ্রিত বলা যাইতে পারে।"
……..(ভাষা প্রকাশ বাঙ্গালা ব্যাকরণ)
পদাশ্রিত নির্দেশক কাকে বলে

বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত পদাশ্রিত নির্দেশক উদাহরণ :-

বাংলা ভাষার ব্যবহৃত পদাশ্রিত নির্দেশকের মধ্যে টি, টা, টো, টুকু, টুকুন, টু, টুক, খান, খানা, খানি, খানেক, খানিক, গাছ, গাছি, গাছা, গোটা, গুলি, গুলো, গুলান ইত্যাদি বহুল প্রচলিত।


পদাশ্রিত নির্দেশক কত প্রকার ও কি কি :-

বাংলা ভাষায় বচনভেদে পদাশ্রিত নির্দেশক বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। যেমন-

ক. একবচন প্রকাশে টি, টা, খানা, খানি, গাছা, গাছি ইত্যাদি।

উদাহরণ - কলমটি, বইটা বৈঠকখানা, ইত্যাদি।

খ. বহুবচন প্রকাশে গুলি, গুলা গুলো ইত্যাদি।

উদাহরণ - আমগুলি, ফলগুলো, গরুগুলো কুকুরগুলো বিড়ালগুলা প্রভৃতি।

গ. কোনো সংখ্যা বা পরিমাপের স্বল্পতা প্রকাশেঃ টে. টুকু, টুকুন ইত্যাদি।

উদাহরণ - তিনটে চাল, ভাতটুকু, পায়েস টুকুন, এতটুকুন মেয়ে প্রভৃতি।

ঘ. অনির্দেশক প্রত্যয় টি, টা, এক, জন, খান ইত্যাদি দ্বারা নির্দিষ্ট কাউকে বোঝায় না। তাই এসব প্রত্যয় অনির্দেশক প্রত্যয় হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।

উদাহরণ - একটা গল্প বলি, চারটি ভাত দাও, জন চারেক লোক হলেই চলবে, এক যে ছিল রাণী, গোটা কয়েক সমস্যা ইত্যাদি।

পদাশ্রিত নির্দেশকের ব্যবহার :-

টি, টা-র ব্যবহার :-

১. এক শব্দের সঙ্গে টা, টি যুক্ত হলে অনির্দিষ্টতা বোঝায়। যেমন- একটি দোকান, লোকটা কী কাণ্ডই না করলো।

২. নির্দেশক সর্বনামের পরে টা, টি যুক্ত হলে তা সুনির্দিষ্ট হয়ে যায়। যেমন- এটি যেন কার বাড়ি? ওটা নয়, এটা আন। এটিই আমার প্রিয় বই।


৩. নিরর্থক ভাবেও নির্দেশক টা, টি ব্যবহৃত হয়। যেমন- সারাটি দিন তোমার অপেক্ষায় আছি, ন্যাকামিটা এখন রাখ।

৪. বড় জিনিস সম্বন্ধে অবজ্ঞা, অপ্রিয়তা ইত্যাদি বোঝাতে টা ব্যবহৃত হয়। যেমন- ছাতাটা কোথায়?

৫. প্রাণিবাচক শব্দের পরে অনাদর বা ঔদাসীনা বোঝাতে টা ব্যবহৃত হয়। যেমন- ছেলেটা কেমন! বেয়াদবটা গেল কোথায়?

৬. অতি ঘনিষ্ঠতা বোঝাতে টা ব্যবহৃত হয়। যেমন- আবিটা বেশ চটপটে। মেয়েটা বেশ ভদ্র।

৭. কোনো বস্তুর আকারের পূর্ণতা বোঝাতে টা ব্যবহৃত হয়। যেমন- বাড়িটা হাহাকার করছে। কবিতা বেশ বড়।

টু-এর ব্যবহার :-

১. অল্প অর্থে টু ব্যবহৃত হয়। যেমন- আমার ফিরতে একটু দেরি হবে। তার মন আগের চেয়ে ভালো।

২. আদর বোঝাতে টু ব্যবহৃত হয়। যেমন- একটু কাছে এস বাবা। একটু খেয়ে দুধ খাও।

টুকু-এর ব্যবহার :-

সংস্কৃত 'তনুক' শব্দ থেকে ‘টুকু' শব্দের উদ্ভব। মৈথিলী সাহিত্যে তনুক শব্দের ব্যবহার রয়েছে। এ শব্দটি এখনও হিন্দিতে ব্যবহৃত হয়। টুকু ব্যবহারের কয়েকটি নিয়ম

১. অম্ল বোঝাতে টুকু ব্যবহৃত হয়। যেমন- এতটুকু ছেলে, কিন্তু কথায় পাকা।

২. আদর বোঝাতে টুকু ব্যবহৃত হয়। যেমন- দুধটুকু খেয়ে নাও।

৩. অরূপ পদার্থবাচক বিশেষ্য পদে টুকু ব্যবহার করা হয়। যেমন- হাওয়াটুকু, কৌশলটুকু, ভারটুকু ইত্যাদি।

৪. যে জিনিসকে টুকরো করলে তার বিশেষেত্ব নষ্ট হয় না, সে সম্বন্ধে টুকু ব্যবহৃত হয়। যেমন- কাগজটুকু, বৈঠকটুকু ইত্যাদি।

'গাছা' ও 'গাছি'-র ব্যবহার :-

১. খানি, খানা যেমন মোটার ওপর চওড়া জিনিসের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয় তেমনি সরু জিনিসের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। গাছা। যেমন- লাঠিগাছা, ছড়িগাছা, সুতোগাছা, মালাগাছা, শিকলগাছা ইত্যাদি।

২. জীববাচক পদার্থ বোঝাতে গাছা ও গাছি ব্যবহৃত হয় না। যেমন- কেঁচোগাছি বলা যায় না।

৩. সরু জিনিস লম্বা ছোট হলে সেক্ষেত্রে গাছা ও গাছি ব্যবহৃত হয়। যেমন- দড়িগাছা হয়, কিন্তু গোঁফগাছা হয় না। চুলগাছি যখন বলা হয় তখন চুলের লম্বা দিককেই নির্দেশ করা হয়।


খানেক এর ব্যবহার :-

১. অনির্দেশক প্রত্যয়রূপে খানেক ব্যবহৃত হয়। যেমন- আমাকে শ খানেক টাকা দাও। চল, মাইল খানেক হেঁটে আসি

২. স্বতন্ত্র শব্দের পরেও খানেক ব্যবহৃত হয়। যেমন- ঘণ্টা খানেক পরে দেখা করো।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ