পূর্বরাগ-অনুরাগ-অভিসার-অভিসারিকা-আক্ষেপানুরাগ-প্রার্থনা কি বা কাকে বলে

আজ আমরা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের তথা বৈষ্ণব পদাবলীর কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংজ্ঞা নিয়ে আলোচনা করব। যেমন - পূর্বরাগ, অনুরাগ, অভিসার, অভিসারিকা কি ও কত প্রকার, তেমনি আবার আক্ষেপানুরাগ কাকে বলে? এর শ্রেনীবিভাগ, নিবেদন, বিরহ বা মাথুর, ভাব সম্মিলন, প্রার্থনা কি বা কাকে বলে

পূর্বরাগ কাকে বলে :-

রতির্যা সঙ্গমাৎ পূর্বং দর্শন শ্রবণাদিজা।

তয়োরুছীলতি প্রাজ্ঞৈঃ পূর্বরাগ: স উচ্যতে।।


যে রতি মিলনের পূর্বে দর্শন শ্রবণাদি দ্বারা উৎপন্ন হয়ে নায়ক নায়িকা উভয়ের উন্মীলন অর্থাৎ বিভাবাদির মিশ্রণে আনন্দময়ী হয় পণ্ডিতেরা তাকে পূর্বরাগ বলেন।

অনুরাগ কাকে বলে :-

সদানুভূতমপি যঃ কুর্যাপ্লবনবং প্রিয়ম।

রাগো ভাবনব : সোহনুরাগ ইতীর্যতে।।
পূর্বরাগ-অনুরাগ-অভিসার-অভিসারিকা-আক্ষেপানুরাগ-প্রার্থনা কি বা কাকে বলে
যে রাগ নতুন নতুন হয়ে সতত অনুভূত প্রিয়জনকে সর্বদা নব নব রূপে অনুভব করায়, তাকেই অনুরাগ বলে।

অভিসার কাকে বলে :-

অভিসারের লক্ষণে বলা হয়েছে -

কী পুংসঃ অন্যতরার্থ শাতরার্থ সঙ্কেতস্থলগমনম্'

প্রিয়র মিলন আশে কুঞ্জেতে গমন।

সঙ্কোচপূর্বক অভিসারের লক্ষণ।। 

 আরও পড়ুন :- পদাশ্রিত নির্দেশক কি ও কয়টি?

অভিসারিকা কাকে বলে :-
কান্তার্থিনী তু যা যাতি সঙ্কেতং সার্ভিসারিকা।

উজ্জ্বলনীলমণিতে আরও বলা হয়েছে-

যা অভিসরয়তে কান্তং স্বয়ং বাভিসরত্যপি।

সা জ্যোৎস্না তামসী যান যোগ্য বেশাভিসারিকা।

লজ্জয়া স্বাঙ্গলীনের নিঃশব্দাখিল মণ্ডনা।

কৃতাব গুণ্ঠা স্নিগ্ধেক সখীযুক্তা প্ৰিয়ং ব্ৰজেং।।


যে নায়িকা কান্তকে অভিসার করায় অথবা স্বয়ং অভিসার করে, তাকে অভিসারিকা বলে। ঐ অভিসারিকা জ্যোৎস্না ও অন্ধকার গমনযোগ্য বেশ দ্বারা জ্যোৎস্না ও তামসী ভেদে দু'রকম হয়। যখন অভিসারিকা কান্তের কাছে যায়, তখন লজ্জাবশতঃ নিজ অঙ্গদ্বারা অঙ্গ সঙ্গোপন ভূষণ সকলের নিঃশব্দে ও অবগুন্ঠনবর্তী হয়ে একটি মাত্র সখীর সঙ্গে যায়।

আক্ষেপানুরাগ কাকে বলে :-

আক্ষেপ + অনুরাগ অন্তরে কৃষ্ণ অনুরাগ অসীম কিন্তু বাইরে মিলনে আক্ষেপ। যারা এই বাধা দেয় তাদের সকলের বিরুদ্ধেই আক্ষেপ।

আক্ষেপানুরাগের উক্তি নানাবিধ হয়ে।

দিগরশন লাগি কিঞ্চিৎ কহিয়ে।।

কৃষ্ণকে আক্ষেপ করে আর মুরলীকে।

দূতীকে আক্ষেপ করে আর যে সখীকে।।

গুরুজনে আক্ষেপ আর কুলশীল জাতি।

আপনাকে নিন্দে কভু দৈন্য ভাব গতি।।

কন্দর্পকে মন্দ বলে করিয়া ভৎসনা।

বিপক্ষাদির ব্যঞ্জিয়া কভু করয়ে ক্ষমা।।

বিধাতাকে মন্দ বলে কভু দৈবরোষে।
আরও পড়ুন :- বৈষ্ণব পদাবলী কি?

উপরের উদ্ধৃতিতে দেখা গেল আক্ষেপনানুরাগ আট প্রকার—

  1. প্রিয় সম্বোধনে,
  2. বংশী নিদনে,
  3. স্বাগত কথনে,
  4. সথী সম্বোধনে,
  5. দুৰ্তী সম্বোধনে,
  6. বিধাতুনিন্দনে,
  7. কন্দর্প নিন্দনে,
  8. গুরুজন নিন্দনে সব মিলিয়ে পিরীতি ব্যঞ্জনা।

নিবেদন কাকে বলে :-

রাধার জবানীতে কবি কৃষ্ণচন্দ্রের পায়ে যে আত্মনিবেদন করেছেন তারই নাম নিবেদন। 'সব সমর্পিয়া / একমন হৈয়া নিশ্চয় হইলাম দাসী'। আত্ম নিবেদনের এই ভাবে।

বিরহ/মাথুর কাকে বলে :-

‘পূর্বসঙ্গতয়োথুনোওঁবেদ্দেশান্তরাদিভঃ

ব্যবধানাস্তযৎ প্রাজ্ঞৈঃ ন প্রবাস ইতীর্যতে।।
আরও পড়ুন :- শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের কাহিনি?

পূর্বে মিলিত প্রেমিক প্রেমিকা যুগলের মধ্যে যখন দেশগ্রাম বনান্তরের ব্যবধান রচিত হয় তখন তাকে বিরহ বলে।

এই প্রবাদজনিত বিরহ যখন কৃষ্ণের মথুরা প্রস্থানের জন্য ঘটে তখন তাকে বলা হয় মাথুর। বিরহের চরম রূপ মাথুরে। প্রবাস বিরহের তিন রূপ ভাবী, ভবস ও ভূত বিরহ।

ভাব সম্মিলন কাকে বলে :-

দর্শনালিঙ্গনাদীনামানুকূল্যোন্নিষেবয়া।

য়ুনোরমানমারোহণ ভাব সম্ভোগ ঈর্ষতে।।


দর্শন আলিঙ্গনাদি অনুকূল ব্যবহারের মধ্যে দিয়ে নায়ক নায়িকা যে আনন্দ উল্লাস প্রাপ্ত হন তাকে বলে মিলন। এই মিলন মুখ্য গৌণ ভেদে দুই প্রকার গৌণ মিলনের মধ্যে আবার সামান্য ও বিশেষ ভেদের কথা বলা হয়েছে। এই বিশেষ নির্ণামদ ভাব মিলন অর্থাৎ বাস্তব মিলনের কর্নিা থাকলেও তা আসলে ভাবেরই মিলন।

প্রার্থনা কাকে বলে :-

ভগবচরণে শরণাগতি নিয়ে যে আত্মসমর্পণ, তাঁর কাছে যে মুক্তি বা ত্রাণ প্রার্থনা করেছেন কবি, তারই নাম প্রার্থনা।

কোনও ভক্ত যথা বিদ্যাপতি চেয়েছেন নিজের মুক্তি, কেউ কেউ যথা — গোবিন্দদাস, নরোত্তম দাস গোষ্ঠীগত ভাবে কৃষ্ণের সেবায় অধিকার প্রার্থনা করেছেন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ