বণ্টন প্রণালি কাকে বলে? বণ্টন প্রণালির শ্রেনীবিভাগ, উদ্দেশ্য ও গুরুত্ব?

বণ্টন প্রণালি কাকে বলে :-

উৎপাদিত পণ্য ভোক্তার নিকট প্রেরণ করার জন্য যে পদ্ধতি বা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় তা বণ্টন প্রণালি নামে পরিচিত।

বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে উৎপাদিত পণ্য ভোক্তার নিকট পৌছিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা অপরিহার্য। উৎপাদনের উদ্দেশ্যই ভোগ। আর পণ্যসামগ্রীর ভোগ নিশ্চিত করার জন্য তা ভোগকারীর নিকট প্রেরণ অত্যাবশ্যক। উৎপাদক ও ভোক্তাকে যদি আমরা একট সড়কের দুপ্রান্ত মনে করি, তাবে এক প্রান্ত থেকে একটি পণ্য অপর প্রান্তে পৌঁছানের কাজে মধ্যস্থ ব্যবসায়ীরা তৎপর থাকে। যে সড়ক ধরে পণ্যসামগ্রী উৎপাদকের নিকট থেকে ভোক্তার নিকট পৌঁছে সে সড়কই বণ্টন প্রণালি।

ফিলিপ কটলার (Philip Kotler) এর ভাষ্য অনুযায়ী, “উৎপাদকের নিকট থেকে ভোক্তার নিকট নির্দিষ্ট পণ্য বা সেবার অধিকার হস্তান্তর বা অধীকার হস্তান্তরে সহায়তা করার কাজে নিয়োজিত ব্যক্তি অথবা প্রতিষ্ঠান বণ্টন প্রণালির আওতাভুক্ত।"

বণ্টন প্রণালি কাকে বলে? এ সম্পর্কে মারফি ও এনিস (Murphy and Enis) বলেন, “সংগঠনে পারস্পরিক সংযোজনের মাধ্যমে গঠিত হয়ে যা উৎপাদনকারী হতে ভোক্তার নিকট পণ্যপ্রবাহের সাথে সম্পর্কিত হয় তাকে পণ্য বন্ঠন প্রণালি বলে।"

W. J. Stanton বন্ঠন প্রনালির যে সংজ্ঞা প্রদান করেছেন তা হলো, উৎপাদনকারীর নিকট হতে প্রকৃত ভোক্তা বা শিল্প ব্যবহারকারী/কলকারখানার দিকে পণ্যের মালিকানা স্বত্ব যে পথ ধরে গমন করে, তাকেই একটি পণ্যের বণ্টন প্রণালি অভিহিত করা হয়।
বণ্টন প্রণালি কাকে বলে

বণ্টন প্রণালির শ্রেণিবিভাগ :-

পণ্যের প্রকৃতি ও রূপান্তরযোগ্যতা ভেদে বণ্টন প্রণালি বিভিন্ন প্রকার হতে পারে। আমরা বিবিধ প্রকার বণ্টন প্রণালিকে আলোচনার সুবিধার্থে নিম্নোক্ত পাঁচটি শ্রেণিতে বিভক্ত করতে পারি। এ পাঁচটির মধ্যে প্রথমটি প্রত্যক্ষ এবং অন্যগুলো পরোক্ষ বণ্টন প্রণালি। নিম্নে বণ্টন প্রণালির শ্রেণিসমূহকে উপস্থাপন করা হলো।

১. সরাসরি ভোক্তার নিকট বিক্রয় (Direct sale to consumer) :-

উৎপাদক যখন ভোক্তার নিকট সরাসরি পণ্য বিক্রয় করে তখন প্রত্যক্ষ বণ্টন প্রণালির উদ্ভব হয়। প্রত্যক্ষ বণ্টন প্রণালি অনুসরণ করা হলে উৎপাদক তার পণ্য বিক্রয়ের জন্য কোনো মধ্যস্থব্যবসায়ীর সাহায্য গ্রহণ করে না। সে নিজের উদ্যোগেই ভোক্তার নিকট পণ্য পৌঁছানোর ব্যবস্থা গ্রহণ করে।

শিল্পপণ্য বণ্টনের ক্ষেত্রে এ প্রণালি সর্বাধিক ব্যবহার করা হয়। উদাহরণস্বরূপ সাধনা ঔষধালয়, বাট স্যু কোম্পানি ও সিংগার কোম্পানির নাম উল্লেখ করা যেতে পারে।

২. খুচরা ব্যবসায়ীদের নিকট সরাসরি বিক্রয় (Direct sale to retailers) :-

সকল পণ্য সর্বদা সব ধরনের উৎপাদকের পক্ষে ভোক্তার নিকট সরাসরি বিক্রয় করা সম্ভব হয় না। এমতাবস্থায় শিল্পীয় উৎপাদক ও কৃষি উৎপাদকগণ সরাসরি খুচরা দোকানদারের নিকট পণ্য বিক্রয় করে থাকে।

আরও পড়ুন:- ব্যবসায় সংগঠন কাকে বলে?

অনেক ভোগ্যপণ্যর উৎপাদক ভোক্তাদের রুচি, ফ্যাশন, প্রবণতা, পণ্যসামগ্রীর প্রতি তাদের আকর্ষণ ও চাহিদা সম্পর্কে বিস্তারিত ও নির্ভরযোগ্য ধারণা লাভ করার উদ্দেশ্য খুচরা ব্যবসায়ীদের নিকট পণ্য বিক্রয় করে। বটন খরচ হ্রাস করাও এ ধরনের প্রণালি ব্যবহার করার অন্যতম উদ্দেশ্য। বিস্কুট ও সাবান উৎপাদক, শীতল পানীয় যথা-কেক, পেপসি ইত্যাদি প্রস্তুতকারক খুচরা ব্যবসায়ীদের নিকট সরাসরি পণ্য বিক্রয় করে থাকে।

৩. পাইকারদের মাধ্যমে বিক্রয় (Selling through wholesalers) :-

উৎপাদক যদি মনে করে যে, ভোক্তা বা খুচরা ব্যবসায়ীদের নিকট সরাসরি পণ্য বিক্রয় করা তার অসুবিধাজনক বা অলাভজনক তবে সে পাইকারের মাধ্যমে পণ্য বণ্টনের ব্যবস্থা করতে পারে। এক্ষেত্রে তার পণ্যসামগ্রী সরাসরি পাইকারি ব্যবসায়ীর নিকট সরবরাহ করে এবং পাইকার তার খুচরা ব্যবসায়ীর নিকট বিক্রয় করে থাকে।

৪. পরিবেশকের মাধ্যমে বিক্রয় (Selling through distributors) :-

শিল্পীয় পণ্যের ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ বণ্টন প্রাণালির ব্যাপক ব্যবহার থাকলেও অনেক উৎপাদক এ জাতীয় পণ্য বন্টনের জন্য ডিলার বা পরিবেশকের সাহায্য নিয়ে থাকে।

পরিবেশক উৎপাদকের নিকট থেকে পণ্যের সরবরাহ পায় এবং তা শিল্পায়ী ব্যবহারকারীর নিকট বিক্রয় করে। ভোগ্যপণ্য বণ্টনের ক্ষেত্রে এ ধরনের বণ্টন প্রণালি খুব কমই ব্যবহৃত হতে দেখা যায়।

৫. প্রতিনিধির মাধ্যমে বিক্রয় (Selling through agents) :-

উৎপাদক পাইকারের নিকট সরাসরি পণ্য বিক্রয় না করে নিজস্ব প্রতিনিধির মাধ্যমে পাইকার বা খুচরা ব্যবসায়ীর নিকট পণ্য বিক্রয়ের ব্যবস্থা করতে পারে।

প্রতিনিধি উৎপাদকের সাথে চুক্তি মোতাবেক নির্দিষ্ট হারে কমিশনের ভিত্তিতে পণ্যসামগ্রী নির্দেশিত ব্যক্তির (পাইকার, খুচরা দোকানদার বা ভোক্তা) নিকট সরবরাহ করে। অনেক করাত কলের মালিক তাদের উৎপাদিত ভোক্তা বা অন্যান্য কাঠ সামগ্রী বিক্রয় প্রতিনিধির মাধ্যমে বিক্রয় করে থাকে।

আরও পড়ুন:- শেয়ার কাকে বলে?

বন্টন প্রণালির উদ্দেশ্য / গুরুত্ব :-

পণ্য বণ্টনের সাথে জড়িত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে বণ্টন প্রণালি গঠিত হয়ে থাকে। উৎপাদকের উৎপাদিত পণ্য ভোক্তাদের মাঝে বন্টন করা হলো এদের অন্যতম দায়িত্ব। এছাড়াও আরো কতকগুলো উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে পণ্য বিক্রয়ে বণ্টন প্রণালি ব্যবহার হয়ে থাকে তা নিয়ে আলোচনা করা হলো -

১. স্থানগত উপযোগ সৃষ্টি করা :-

স্থানগত উপযোগ সৃষ্টিতে বণ্টন প্রণালি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। বৃহদায়তন উৎপাদনের ফলে ভোক্তা এবং উৎপাদকের মধ্যে দূরত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে। বণ্টন প্রণালির মাধ্যমে পৃথিবীর এক প্রান্তের উৎপাদিত পণ্য অন্য প্রান্তের ভোক্তারা সহজেই ব্যবহার করতে পারছে। ফলে বণ্টনের মাধ্যমে স্থানগত উপযোগের সৃষ্টি হচ্ছে।

২. পণ্যের সহজ প্রাপ্তি নিশ্চিত করা :-


বণ্টন প্রণালির প্রধান উদ্দেশ্য হলো ভোক্তা যেন সঠিক সময়ে সঠিক পণ্যটি পেতে পারে তার ব্যবস্থা করা। প্রয়োজনীয় মূহুর্তে রাজশাহীর একজন ক্রেতার পক্ষে ঢাকা অথবা ভারত থেকে পণ্য সংগ্রহ করা সম্ভবপর নয়। বণ্টন প্রণালি ভোক্তাদের চাহিদা মোতাবেক পণ্যটি ক্রেতাদের সরবরাহ করে থাকে।

৩. বিক্রয় বৃদ্ধি করা :-

বর্তমানে পণ্যের প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি পাওয়ায় উৎপাদকের প্রধান উদ্বিগ্নতা হলো পণ্য বিক্রয় নিয়ে। সে কারণে উৎপাদক চেষ্টা করে দক্ষ মধ্যস্থব্যবসায়ীদের নিয়ে বণ্টন-ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য যারা ক্রমবর্ধমান প্রতিযোগিতা মোকাবেলা করে প্রতিষ্ঠানের বিক্রয় বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

৪. বণ্টন ব্যয় হ্রাস করা :-

ভোক্তার নিকট সবচেয়ে কম খরচে পণ্য পৌঁছানো বন্টন প্রণালীর অন্যতম উদ্দেশ্য। সুষ্ঠু বণ্টন-ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা এবং বণ্টন প্রণালি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে বণ্টন খরচ অনেকাংশে কমানো সম্ভবপর হয়। বাজারজাতকরণ দক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে খুব কম খরচে ভোক্তার নিকট পণ্য পৌঁছানো সম্ভব।

৫. সেবার পরিসর বৃদ্ধি করা :-

ক্রেতারা পণ্য ক্রয়ের পাশাপাশি অনেক ধরণের সেবা আশা করে। উৎপাদকের পক্ষে এ সকল সেবা সরবরাহ করা সম্ভবপর নয়। যেহেতু বণ্টন প্রণালির সদস্যরা ভোক্তাদের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত, সেহেতু তারা ভোক্তাদের চাহিদা, আশা-আকাঙ্খা বিশ্লেষণ করে তাদেরকে কাম্য সেবা সরবরাহ করে থাকে।

৬. ক্রেতার আনুগত্য অর্জন :-

পণ্যের প্রতি ক্রেতার আনুগত্য সৃষ্টি বণ্টন প্রণালির আর একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য। পণ্যের প্রাপ্তি ও পণ্যমানের উপর পণ্যের প্রতি ক্রেতার আনুগত্য সৃষ্টি হয়ে থাকে। প্রণালির সদস্যরা ভোক্তাদের কাছাকাছি অবস্থান করে বলে পণ্যের প্রতি ক্রেতার অনুগত্য অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

৭. দ্রুত সরবরাহ করা :-

পণ্য দ্রুত এবং কার্যকরভাবে ভোক্তাদের নিকট পৌঁছানোর জন্য বণ্টন প্রণালি প্রতিষ্ঠা করা হয়ে থাকে। এ কারণে প্রণালির সদস্যরা বিভিন্ন স্থানে মজুদকরণের ব্যবস্থা করে থাকে। পণ্য বণ্টন দ্রুততর করার জন্য সারা দেশে বণ্টন নেটওয়ার্ক তৈরি করা হয়।

আরও পড়ুন:- রপ্তানি কাকে বলে?

৮. ব্যবসায়িক সমন্বয় :-

ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য উৎপাদককে বিভিন্ন বিষয়ের মধ্যে সমন্বয়সাধন করতে হয়। উৎপাদকের একার পক্ষে এই সমন্বয় সম্ভব নয়। উৎপাদকের পক্ষে প্রণালির সদস্যগণ এরূপ সমন্বয়ের কাজ করে থাকে। বিভিন্ন পক্ষের সাথে যোগাযোগের মাধ্যমে উৎপাদকের ব্যবসায়িক সমন্বয়ের কাজটি বণ্টন প্রণালির সদস্যদের মাধ্যমে সম্পাদিত হয়ে থেকে।

৯. প্ৰতিযোগিতা বৃদ্ধি :-

বণ্টন প্রণালির সদস্যরা বিভিন্নভাবে প্রতিযোগিতার সৃষ্টি করছে। প্রণালির প্রত্যেক সদস্য নিজ নিজ পণ্যের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি করতে চায়। তারা ভোক্তাদের নানাভাবে পণ্য ক্রয়ে উৎসাহিত করে। অন্য দিকে, উৎপাদকে নানা ধরনের বাজার তথ্য সরবরাহ করে পণ্যের প্রতিযোগিতার পরিবেশ সৃষ্টি করে।

১০. পণ্যের ব্যাপকবণ্টন :-

বণ্টন প্রণালির আর একটি উদ্দেশ্য হলো বাজার পরিধি সম্প্রসারণ করা। প্রতিযোগিতার সাফল্যের জন্য বৃহদায়তন উৎপাদন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হয়। ফলে পণ্য বিক্রয়ের জন্য প্রয়োজন হয় বিস্তৃত বণ্টন ব্যবস্থা। অধিক সংখ্যক মধ্যস্থকারবারী নিয়োগের মাধ্যমে সহজেই বাজার দখল ও নিয়ন্ত্রন করা সম্ভবপর হয়ে থাকে।

১১. ভোক্তার সন্তুষ্টিবিধান :-

ভোক্তাদের পক্ষে উৎপাদকের সাথে সরাসরি যোগাযোগ করা সম্ভবপর হয় না। উৎপাদকের প্রতিনিধি হিসাবে মধ্যস্থকারবারীগণ কাজ করে থাকে। ক্রেতাগণ তাদের অভাব, অভিযোগ, চাহিদা, আকাঙ্খা ইত্যাদি বিষয়গুলো সরাসরি বণ্টন প্রণালির সদস্যদের নিকট ব্যক্ত করে। প্রণালির সদস্যগণ সুষ্ঠু সমাধানের মাধ্যমে ক্রেতাদের আস্থা অর্জনে সমর্থ হয়।

১২. আর্থিক অক্ষমতা :-

অনেক সময় অনেক বড় বড় কোম্পানি তাদের বণ্টনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের সমস্যার মধ্যে পড়েন। বিশেষ করে, উৎপাদিত পণ্যসমূহ সরাসরি বাজারজাতকরার সামর্থ অনেক কোম্পানিরই থাকে না। এরূপ অবস্থায় অনেক মধ্যস্থকারবারী কোম্পানির পণ্যের বাজারজাতকরণ দায়িত্ব নিয়ে থাকেন। নিজের আর্থিক অক্ষমতা দূর করার জন্য অনেক কোম্পানি বণ্টন ব্যবস্থার সহায়তা নিয়ে থাকে।

উপরোক্ত আলোচনার মাধ্যমে বলা যায় যে, বণ্টন প্রণালি ব্যবহারের গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য হলো পণ্য বা সেবা সঠিক সময়ে ক্রেতা বা ভোক্তার কাছে সরবরাহ করা ও তাদেরকে সন্তুষ্ট করা।

আরও পড়ুন :- সংগঠন কাকে বলে?

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ