প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি কাকে বলে? প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানির বৈশিষ্ট্য, সুবিধা ও অসুবিধা

যারা একই সাথে সীমাবদ্ধ দায়ের সুবিধা এবং ব্যবসায়ের নিয়ন্ত্রণ যথাসম্ভব নিজেদের হাতে ধরে রাখার সুবিধা ভোগ করবার অভিলাসী তাদের জন্য প্রাইভেট কোম্পানি বিশেষভাবে উপযোগী। 
অংশীদারি ব্যবসায়ের সাথে প্রাইভেট কোম্পানির কতিপয় মিল থাকলেও কোম্পানির সদস্যদের পায় সীমাবদ্ধ হওয়ায় (যা অংশীদারি ব্যবসায়ে সাধারণত নেই) ব্যবসায়ীরা প্রাইভেট কোম্পানিই বেশি পছন্দ করে। 

আসুন তাহলে জেনে নেই প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি কী, এর বৈশিষ্ট্য এবং সুবিধা-অসুবিধাগুলো।

প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি কাকে বলে :-

সীমাবদ্ধ দায়সম্পন্ন কোনো কোম্পানি যদি ২ থেকে ৫০ জন সদস্য নিয়ে গঠিত এবং শেয়ার বিক্রয় বা হস্তান্তর করার অধিকার সীমাবদ্ধ করে দেয় তাকে প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি বলে।

তুলনামূলকভাবে এরূপ কোম্পানি ক্ষুদ্রায়তনের হয়ে থাকে এবং একে কঠোর আইনগত নিয়ন্ত্রণ থেকে রেহাই দেওয়া হয়। প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানিকে প্রাইভেট কোম্পানি কিংবা ঘরোয়া সসীম দায়সম্পন্ন কোম্পানি নামেও অভিহিত করা হয়। নিম্নে প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানির দুটি আইনগত সংজ্ঞা উল্লেখ করা হলো।


প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি কাকে বলে? এ সম্পর্কে ১৯৯৪ সালের কোম্পানি আইনের ২ (১-ট) ধারায় বলা হয়েছে, “প্রাইভেট কোম্পানি বলতে এমন কোম্পানিকে বোঝাবে যা এর নিয়মাবলি অনুসারে সদস্য সংখ্যা ৫০ এ সীমিত রাখে, সদস্যদের শেয়ার হস্তান্তরের অধিকারে সীমাবদ্ধতা আরোপ করে এবং শেয়ার ও ঋণপত্র ক্রয়ের জন্য জনসাধারণের প্রতি আহ্বান নিষিদ্ধ করে।

১৯৫৬ সালের ভারতীয় কোম্পানি আইনের ৩ ধারা অনুসারে “প্রাইভেট কোম্পানি বলতে এমন কোম্পানিকে বোঝায় যা পরিমেল নিয়মাবলি দ্বারা (ক) সদস্যদের শেয়ার হস্তান্তরের অধিকার সীমাবদ্ধ রাখে, (খ) সংখ্যা ৫০ এর মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখে, (গ) জনগণের প্রতি শেয়ার বা ঋণপত্র ক্রয়ের আহ্বান নিষিদ্ধ করে।"

সুতরাং প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি কাকে বলে? এর উত্তরে বলা যায়, কৃত্রিম ব্যক্তিসত্তা বিশিষ্ট যে সীমিত দায়সম্পন্ন কোম্পানি ৫০ এর অধিক সদস্য গ্রহণ করতে পারে না, জনগণের উদ্দেশ্যে শেয়ার বা ঋণপত্র ক্রয়ের আহ্বান জানাতে পারে না এবং অবাধে শেয়ার হস্তান্তর করতে পারে না তাকে প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি বলে।
প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি কাকে বলে

প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানির বৈশিষ্ট্য :-

ঘরোয়া প্রকৃতির সসীম দায়সম্পন্ন স্বাধীন ব্যবসায় সংগঠন হচ্ছে প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি। শেয়ার অহস্তান্তরযোগ্য এ ছোটো আকারের ব্যবসায় সংগঠনকে ঘরোয়া সসীম দায় কোম্পানি সংগঠনও বলে। এ প্রকৃতির সংগঠনের কিছু স্বকীয় বৈশিষ্ট্য রয়েছে:

১. সদস্য সংখ্যা :-

কমপক্ষে ২ জন ব্যক্তি প্রাইভেট কোম্পানি গঠন করতে পারে। তবে এর সদস্য সংখ্যা ৫০ জনের বেশি হতে পারে না। সদস্য সংখ্যা ৫০ জনের বেশি হলে কিংবা ২ জনের নিচে হলে সেটি প্রাইভেট কোম্পানি রূপে গণ্য হবে না।

২. শেয়ার বিক্রয় :-

প্রাইভেট কোম্পানি বিবরণপত্র ইস্যু করে জনসাধারণকে শেয়ার ক্রয় করার জন্য আমন্ত্রণ জানাতে পারে না। প্রাইভেট কোম্পানির জন্য জনগণের নিকট শেয়ার বিক্রয় নিষিদ্ধ।

৩. শেয়ার হস্তান্তর :-

কোম্পানি আইনের বিধান অনুযায়ী প্রাইভেট কোম্পানির কোনো সদস্য তার ক্রীত শেয়ার অন্যের নিকট হস্তান্তর করতে পারে না। এরূপ কোম্পানিকে শেয়ার হস্তান্তরের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা কঠোরভাবে মেনে চলতে হয়।

৪. প্রাইভেট কোম্পানির দায়সমূহ :-

কোম্পানির সদস্যদের দায় সীমাবদ্ধ। তাদের দায় শেয়ার দ্বারা অথবা প্রতিশ্রুতি দ্বারা সীমাবদ্ধ হতে পারে। প্রাইভেট কোম্পানি কখনো সীমাহীন নারবিশিষ্ট হয় না।

৫. পুঁজির সংস্থান :-

প্রাইভেট কোম্পানি শেয়ার ইস্যুর মাধ্যমে মূলধন সংগ্রহ করতে পারে না বলে কোম্পানির সীমিত সংখ্যক সদস্যদেরকেই মূলধনের যোগান দিতে হয়।

৬. প্রাইভেট লিমিটেড শব্দের ব্যবহার :-

কোম্পানি আইনের বিধান অনুসারে প্রাইভেট কোম্পানির নামের শেষে প্রাইভেট লিমিটেড শব্দ দুটো যোগ করতে হয়।

৭. বিবরণপত্র প্রচার :-

প্রাইভেট কোম্পানির বেলায় বিবরণপত্র বা বিকল্প বিবরণপত্র প্রচার করা যায় না কিংবা তা নিবন্ধকের নিকট দাখিলও করতে হয় না।

৮. ন্যূনতম পুঁজি :-

এ কোম্পানির বেলায় ন্যূনতম পুঁজি সংগ্রহের বাধ্যবাধকতা নেই।

৯. ব্যবসায়ের আরম্ভ :-

নিবন্ধকের নিকট থেকে নিবন্ধনপত্র পেয়ে প্রাইভেট কোম্পানি ব্যবসায় আরম্ভ করতে পারে, কার্যারম্ভের অনুমতিপত্রের জন্য অপেক্ষা করতে হয় না

১০. বিধিবদ্ধ সভা :-

প্রাইভেট কোম্পানিকে বিধিবদ্ধ সভা ডাকতে হয় না এবং নিবন্ধকের নিকট বিধিবদ্ধ প্রতিবেদনও দাখিল করতে হয় না।

আরও পড়ুন:- কোম্পানি কাকে বলে?

প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানির এ বৈশিষ্ট্যসমূহ পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি থেকে এক পৃথক প্রকৃতির সংগঠন হিসেবে পরিচিত করেছে। এ বৈশিষ্ট্যসমূহ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি শুধু কোম্পানি সংগঠনেরই নয় অংশীদারি ব্যবাসয়েরও অনেক সুবিধা অর্জন করতে সক্ষম। এ কারণে সারা বিশ্বে এ সংগঠন জনপ্রিয় সংগঠন।

প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানির সুবিধা :-

কিছু ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা থাকলেও গঠনগত, ন্যূনতম পুঁজি সংগ্রহ, সভা আহ্বান কার্যারম্ভ ইত্যাদি বহুবিধ বিষয়ে প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি থেকে সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছে। প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানির এসব সুবিধা নিচে আলোচনা করা হলো।

১. গঠনগত সুবিধা :-

ন্যূনতম দুজন ব্যক্তি একত্রিত হয়ে প্রাইভেট কোম্পানি সহজেই গঠন করতে পারে। সহজ গঠনের জন্য এর জনপ্রিয়তাও অধিক।

২. সীমিত পায় :-

প্রাইভেট কোম্পানির সদস্যদের দায় সীমিত বলে অসীম দায়বিশিষ্ট ব্যবসায়ের চেয়ে এর প্রতি বিনিয়োগকারীরা বেশি আকৃষ্ট হয়।

৩. আইনগত সুবিধা :-

এরূপ কোম্পানিতে আইনের জটিলতা তেমনটা পোহাতে হয় না। এ জাতীয় কোম্পানির গঠন ও পরিচালনায় আইনগত বিধিনিষেধ কড়াকড়িভাবে আরোপিত হয় না।

8. নিবন্ধন :-

নিবন্ধনপত্র প্রাপ্তির পর পরই প্রাইভেট কোম্পানি ব্যবসায় আরম্ভ করতে পারে। তাকে কার্যারম্ভের অনুমতিপত্রের জন্য অপেক্ষা করতে হয় না।

৫. ন্যূনতম পুঁজি থেকে মুক্তি :-

ন্যূনতম পুঁজি সংগ্রহ না করেই প্রাইভেট কোম্পানি ব্যবসায় আরম্ভ করতে পারে। এরূপ কোম্পানির জন্য ন্যূনতম পুঁজি সংগ্রহ করা বাধ্যতামূলক নয় বিধায় উদ্যোক্তরা সহজেই ব্যবসায়ের দ্বার উদ্ঘাটন করতে সক্ষম হয়।

৬. বিধিবদ্ধ সভা হতে অব্যাহতি :-

কোম্পানি আইন প্রাইভেট কোম্পানিকে বিধিবদ্ধ সভা অনুষ্ঠানের বিধান থেকে অব্যাহতি দিয়েছে।

৭. রূপান্তারের সুযোগ :-

সদস্যগণের যদি স্বদিচ্ছা থাকে তাহলে পরিমেল নিয়মাবলি পরিবর্তনের মাধ্যমে প্রাইভেট কোম্পানিকে পাবলিক কোম্পানিতে রূপান্তর করতে পারে।

৮. সিদ্ধান্ত গ্রহণে দ্রুত নমনীয়তা :-

সদস্য সংখ্যা কম হওয়ায় প্রাইভেট কোম্পানি দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে সক্ষম হয়।

৯. পলিসি সংক্রান্ত নমনীয়তা :-

প্রাইভেট কোম্পানি সাধারণত আয়তনে ছোটো এবং স্বল্প সদস্যবিশিষ্ট বলে প্রয়োজনবোধে অবস্থার সাথে তাল মিলিয়ে সহজেই পলিসি পরিবর্তন করতে পারে।

১০. গোপনীয়তা রক্ষা :-

কর্মীর সংখ্যা কম হওয়ায় এবং তাদের কার্যাবলির ওপর পরিচালকদের ব্যক্তিগত তদারক থাকার কারণে ব্যবসায়ের গোপনীয়তা বজায় রাখা সম্ভব হয়।

১১. ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা :-

পরিচালকগণ ব্যক্তিগত উদ্যোগ নিয়ে ব্যবসায় পরিচালনা করেন। তাই কর্মীরা কাজে উৎসাহ পায়। এতে ব্যবস্থাপনারও দক্ষতা বৃদ্ধি পায়।

১২. পরিচালক সংখ্যা বৃদ্ধি :-

প্রাইভেট কোম্পানির ক্ষেত্রে পরিচালকের সংখ্যা বাড়াতে হলে সরকারের অনুমতির প্রয়োজন হয় না।

১৩. উদ্বৃত্তপত্র :-

প্রাইভেট কোম্পানিকে প্রত্যেক সদস্য বা ঋণপত্রধারীর নিকট উদ্বৃত্তপত্র বা ব্যালেন্স শিট পাঠাতে হয়না।

১৪. সূচি রক্ষণ :-

আইন মোতাবেক প্রাইভেট কোম্পানির সদস্যদের জন্য কোনো সূচি রাখতে বাধ্য নয়।

১৫ ঋণের সহজলভ্যতা :-

এ কোম্পানিকে ঋণ দেওয়া নেয়ার ব্যাপারে কঠোরভাবে আইনের শাসন মানতে হয় না।

আরও পড়ুন:- পণ্য কাকে বলে?

আলোচিত বিষয়সমূহ প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানিকে সুবিধাজনক অবস্থানে দাঁড় করিয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অধিক হারে এ ধরনের কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হতে দেখা যায়।

প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানির অসুবিধা :-

প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি কতগুলো ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধাজনক অবস্থানে থাকলেও এর কিছু অসুবিধাও রয়েছে। এ অসুবিধাগুলো নিচে আলোচিত হলো।

১. সদস্য সংখ্যার সীমাবদ্ধতা :-

প্রাইভেট কোম্পানির সদস্য ৫০ জনের বেশি হতে পারে না। ফলে প্রয়োজন দেখা দিলেও অধিক সংখ্যক সদস্য গ্রহণ করা যায় না।

২. পুঁজির অপ্রতুলতা :-

সদস্য সংখ্যা সীমিত হওয়ায় প্রাইভেট কোম্পানি ইচ্ছেমত পুঁজির পরিমাণ বৃদ্ধি করতে পরে না। আর সীমিত সংখ্যক সদস্যের পক্ষেও বেশি পরিমাণে মূলধনের যোগান দেওয়া সম্ভব হয় না।

৩. সম্প্রসারণের অসুবিধা :-

পুঁজি প্রয়োজন মাফিক বৃদ্ধি করা সম্ভব হয় না বলে প্রাইভেট কোম্পানি অনেক সময় উজ্জ্বল সম্ভাবনা বিশিষ্ট প্রকল্প হাতে নিতে পারে না। ফলে ব্যবসায়ের সম্প্রাসারণ ব্যাহত হয়।

৪. শেয়ার হস্তান্তরে নিষেধাজ্ঞা :-

১৯৯৪ সালের কোম্পানি আইন মোতাবেক প্রাইভেট কোম্পানির সদস্যগণ শেয়ার হস্তান্তর করতে পারে না। এর শেয়ার অবাধে হস্তান্তরযোগ্য নয়।

৫. শেয়ার বাজারে অভালিকাভুক্তি :-

শেয়ার হস্তান্তরে নিষেধাজ্ঞা থাকায় প্রাইভেট কোম্পানি শেয়ার বাজারে তালিকাভুক্ত হতে পারে না।

৬. হিসাবে কারচুপি :-


প্রাইভেট কোম্পানিকে জনসাধারণ্যে হিসাব প্রকাশ করতে হয় না বলে হিসাবে কারচুপি করার সুযোগ থাকে। এরূপ কারচুপির দরুন আয়কর বিভাগ বেশি ক্ষতিগ্ৰস্ত হয়।

৭. অধিক স্বজনপ্রীতি :-

প্রাইভেট কোম্পানিতে উদ্যোক্তা বা পরিচালকগণই সর্বেসর্বা। তাই কর্মচারী নিয়োগের সময় তারা স্বজনপ্রীতির আশ্রয় নিলেও কারো কিছু বলার থাকে না। এতে কোম্পানিতে অদক্ষ কর্মীর অনুপ্রবেশ ঘটে।

আরও পড়ুন:- মার্কেটিং কাকে বলে?

৮. আর্থিক ক্ষমতার কেন্দ্রীয়করণ :-

প্রাইভেট কোম্পানির পরিচালকগণ ইচ্ছে করলে হিসাবপত্রে গোজামিল দিয়ে বা ভারচুপি করে সরকারকে আয়কর ফাঁকি দিতে পারে। ফলে তাদের হাতে অবাঞ্ছিত অর্থের সমাগম ঘটে এবং আর্থিক ক্ষমতা ধীরে ধীরে তাদের হাতে কেন্দ্রীভূত হতে থাকে।

উল্লিখিত অসুবিধাসমূহের কারণে কখনো কখনো প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি জনগণের আস্থা হারিয়ে ফেলে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ