হিসাববিজ্ঞানের উদ্দেশ্য ও প্রয়োজনীয়তা এবং সীমবদ্ধতা?

হিসাববিজ্ঞানের উদ্দেশ্য :-

হিসাববিজ্ঞান একটি সেবামূলক কর্মকান্ড। এর উদ্দেশ্য বহুবিধ। মূলতঃ প্রতিষ্ঠানের সংঘটিত লেনদেন হিসাবভুক্তকরণ, ফলাফল ও আর্থিক অবস্থা নির্ণয় এবং মূল্যায়ন ও বিশ্লেষণ সংক্রান্ত তথ্য স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষকে সরবরাহ করাই হিসাববিজ্ঞানের প্রধান উদ্দেশ্য। নিম্নে হিসাববিজ্ঞানের উদ্দেশ্যগুলো সম্পর্কে আলোকপাত করা হলো

১. আর্থিক লেনদেনের স্থায়ী হিসাব সংরক্ষণ :-

প্রতিদিনের অসংখ্য লেনদেন দীর্ঘকাল মনে রাখা সম্ভব নয়। তাছাড়া আর্থিক ফলাফল নির্ণয়ের জন্যও লেনদেন লিপিবন্ধ করা প্রয়োজন। তাই হিসাববিজ্ঞানের প্রাথমিক উদ্দেশ্য হলো আর্থিক লেনদেন জাবেদায় ধারাবাহিকভাবে লিপিবদ্ধ করা এবং পরে স্থায়ীভাবে খতিয়ানে হিসাব সংরক্ষণ করা।

২. কার্যক্রমের ফলাফল নির্ণয় :-

নির্দিষ্ট সময় পর মালিক ও অন্যান্য স্বার্থ সংশ্লিষ্ট পক্ষ প্রতিষ্ঠানের আর্থিক কার্যক্রমের ফলাফল জানতে চায়। ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের জন্য লাভ-লোকসান হিসাব ও অব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের জন্য আয়-ব্যয় হিসাব প্রস্তুত করে আর্থিক কার্যক্রমের ফলাফল নির্ণয় করা হিসাববিজ্ঞানের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য।

৩. প্রতিষ্ঠানের আর্থিক অবস্থা নিরূপণ :-

আর্থিক অবস্থা নিরূপণ করা হিসাববিজ্ঞানের আর একটি প্রধান উদ্দেশ্য। প্রতিষ্ঠানের দায়-দেনা, মূলধন, চলতি সম্পত্তি, স্থায়ী সম্পত্তি ইত্যাদির পরিমাণ নির্ধারণ করার জন্য হিসাব বৎসর শেষে নির্দিষ্ট দিনে উদ্বৃত্তপত্র (Balance sheet) প্রস্তুত করা হয়। আর্থিক বিবরণীর এই অংশ আর্থিক অবস্থা নির্দেশ করে।


৪. কার্যক্রম মূল্যায়ন ও নীতি নির্ধারণ :-

আর্থিক বিবরণীসমূহের বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যাকরণ এবং প্রয়োজনীয় আর্থিক তথ্য সরবরাহের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম মূল্যায়নে ও নীতি নির্ধারণে ব্যবস্থাপনাকে সহায়তা করা হিসাববিজ্ঞানের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য।

৫. কার্যক্রম ও দেনাপাওনা সম্পর্কে অবহিতকরণ :-

দৈনন্দিন লেনদেন, ক্রয়বিক্রয় ও দেনাপাওনা সম্পর্কে অবহিত করা হিসাববিজ্ঞানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য।

৬. হিসাববিজ্ঞানের শুদ্ধতা যাচাইকরণ :-

প্রতিটি লেনদেন দু'তরফা দাখিলা পদ্ধতি অনুসারে লিপিবন্ধ করা হয়। হিসাবের গাণিতিক শুদ্ধতা যাচাই করার উদ্দেশ্যে রেওয়ামিল প্রস্তুত করা হয়।

৭. হিসাববিজ্ঞানে ভুল ও জালিয়াতি উদ্ঘাটন :-

সংরক্ষিত হিসাবসমূহের নিরীক্ষার মাধ্যমে ভুল ও জালিয়াতি উদ্ঘাটন ও প্রতিরোধ হিসাববিজ্ঞানের উদ্দেশ্য।

৮. কর নির্ধারণ :-

হিসাববিজ্ঞানের উদ্দেশ্য হলো সুষ্ঠুভাবে হিসাব সংরক্ষণের মাধ্যমে আয়কর, VAT ও অন্যান্য কর নির্ধারণ কর্তৃপক্ষকে সহায়তা করা।

৯. আইনগত বিধি নিষেধ পালন :-

সব ধরনের প্রতিষ্ঠানকে আইনগত বিধি-নিষেধ মেনে চলার জন্য সঠিকভাবে হিসাব সংরক্ষণ করতে হয়। অংশিদারী, কোম্পানি, বাণিজ্য, আয়কর, সিকিউরিটি ও এক্সচেঞ্জ ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের আইনের জন্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে সঠিকভাবে হিসাব রাখতে হয়।

১০. মূল্যবোধ ও জবাবদিহিতা সৃষ্টি :-

হিসাববিজ্ঞানের অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের মধ্যে উন্নত মূল্যবোধ জাগ্রত করা এবং হিসাবে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা।
হিসাববিজ্ঞানের উদ্দেশ্য ও প্রয়োজনীয়তা এবং সীমবদ্ধতা

হিসাববিজ্ঞানের প্রয়োজনীয়তা :-

কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমের ফলাফল নিরূপণ, গতি-প্রকৃতি নির্ধারণ, আর্থিক অবস্থা নিরূপণ ও ব্যবস্থাপনার সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য হিসাববিজ্ঞানের সাহায্য অতি অপরিহার্য। নিম্নে হিসাববিজ্ঞানের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে আলোকপাত করা হলো।

১. স্থায়ী হিসাব সংরক্ষণ :-

প্রতিদিন ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে অনেক লেনদেন সংঘটিত হয়, যার বিবরণ অনেক দিন পর্যন্ত মনে রাখা সম্ভব নয়। এ সব লেনদেন হিসাবের বইতে স্থায়ীভাবে লিপিবদ্ধ ও সংরক্ষণ করার কলাকৌশল হিসাববিজ্ঞান শিক্ষা দেয়।

২. প্রতিষ্ঠানের আর্থিক ফলাফল নির্ণয় :-

ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের প্রধান উদ্দেশ্য হলো মুনাফা অর্জন। এ উদ্দেশ্য কতটা অর্জিত হয়েছে নির্দিষ্ট সময় পর তা জানা প্রয়োজন। হিসাববিজ্ঞান আর্থিক লেনদেনের সুষ্ঠু হিসাব রেখে এবং হিসাব কাজ শেষে আর্থিক বিবরণী প্রস্তুত করে ব্যবসায়ের ফলাফল নির্ণয় করে থাকে।

আরও পড়ুন :- হিসাববিজ্ঞান কাকে বলে?

৩. আর্থিক অবস্থা নিরূপণ :-

হিসাববিজ্ঞান কোনো নির্দিষ্ট সময়ে প্রতিষ্ঠানের উদ্বতপত্র প্রস্তুত করে আর্থিক অবস্থা তথা মূলধন, দেনা-পাওনা, চলতি সম্পদ, স্থায়ী সম্পদ, হাতে নগদ, ব্যাংক জমা ইত্যাদি সম্পর্কে জানতে সহায়তা করে।

৪. ফলাফল ও আর্থিক অবস্থার তুলনা :-

প্রতিষ্ঠানের সঠিক কার্যক্রম গ্রহণ ও সম্প্রসারণ পরিকল্পনার জন্য এবং অন্যান্য প্রতিযোগী সংগঠনের ফলাফল ও আর্থিক অবস্থার তুলনামূলক পর্যালোচনার প্রয়োজন হয়, যা হিসাববিজ্ঞানের সহায়তা ছাড়া সম্ভব নয়।

৫. ভুল-জালিয়াতির উদ্ঘাটন ও প্রতিরোধ :-

সঠিকভাবে হিসাব সংরক্ষণ করলে যে কোনো প্রতিষ্ঠানে সংঘটিত হিসাবের ভুল-জালিয়াতি উদ্ঘাটন ও প্রতিরোধ সম্ভব। তাছাড়া নিরীক্ষাশাস্ত্র ভুল ও জালিয়াতি উদ্ঘাটন ও প্রতিরোধে সাহায্য করে।

৬. কর নির্ধারণ :-

সঠিক পদ্ধতিতে ও সুষ্ঠু হিসাব সংরক্ষণের মাধ্যমে হিসাববিজ্ঞান আয়কর, বিক্রয় কর, ভ্যাট ইত্যাদি নির্ধারণে সাহায্য করে।

৭. ব্যয় নিয়ন্ত্রণ :-

বিচ্যুতি বিশ্লেষণ, মান ব্যয়, বাজেটিয় নিয়ন্ত্রণ, দায়িত্ব হিসাববিজ্ঞান ইত্যাদি কৌশল ব্যবহার করে বায় নিয়ন্ত্রণে হিসাববিজ্ঞান সহায়তা করে থাকে।

৮. ব্যবস্থাপকীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও পরিচালনা :-

ব্যবস্থাপনাকে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়। হিসাববিজ্ঞান বিভিন্ন প্রতিবেদন ও বিবরণীর মাধ্যমে প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ করে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে কার্যকর ভূমিকা পালন করে। এ জন্য হিসাববিজ্ঞানকে ব্যবস্থাপনার সহায়ক বলা হয়।

৯. প্রামাণ্য দলিল :-

সঠিকভাবে সংরক্ষিত দলিল প্রামাণ্য দলিল হিসেবে কাজ করে। বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে ভুল বোঝাবোঝি এড়ানো যায় এবং বিরোধ নিষ্পত্তিতে আদালতে প্রমাণপত্র হিসেবে উপস্থাপন করা যায়।

১০. মূল্য নির্ধারণ :-

সাধারণত পণ্য বা সেবার ব্যয়ের সাথে মুনাফা যোগ করে বিক্রয়মূল্য নির্ধারণ করা হয়। সঠিক হিসাব সংরক্ষণের মাধ্যমে পণ্য বা সেবার প্রকৃত ব্যয় ও মুনাফার হার নির্ণয় করে মূল্য নির্ধারণে হিসাববিজ্ঞান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।‌

১১. ঋণ গ্রহণ :-

ব্যবসায়ের প্রয়োজনে অনেক সময় ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ গ্রহণ করতে হয়। ঋণদাতা গ্রহীতার আর্থিক বিবরণী বিশ্লেষণ করে ঋণ যোগ্যতা যাচাই করে। হিসাববিজ্ঞান যথার্থ আর্থিক বিবরণী প্রস্তুত করে ঋণ প্রাপ্তিতে সাহায্য করে।

১২. সংশ্লিষ্ট পক্ষসমূহকে তথ্য পরিবেশন :-

সর্বোপরি হিসাববিজ্ঞান বিভিন্ন আর্থিক বিবরণী, প্রতিবেদন ও বিবৃতির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের সাথে স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ভেতর ও বাহিরের পক্ষসমূহকে প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ করে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

আরও পড়ুন :- হিসাববিজ্ঞানের পরিধি লিখ?

হিসাববিজ্ঞানের সীমাবদ্ধতা :-

বিভিন্ন সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্বশাসিত, ছোটো বড় ও মাঝারি প্রতিষ্ঠানে যে পদ্ধতির হিসাব ব্যবস্থা চালু আছে তা পুরোপুরি যথাযথ নয়। অর্থাৎ হিসাববিজ্ঞানের বিভিন্ন সুবিধা থাকা সত্ত্বেও এর কতিপয় সীমাবদ্ধতা রয়েছে, যা নিম্নে আলোচনা করা হলো:

১. দুতরফা পদ্ধতি প্রয়োগের অভাব :-

দুতরফা দাখিলা হিসাব পদ্ধতি একটি বিজ্ঞানসম্মত ও সার্বজনীন হিসাব ব্যবস্থারূপে গণ্য হয়েছে। তথাপিও আমাদের দেশসহ পৃথিবীর অন্যান্য দেশের ছোটোখাটো বহু ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে এখনো দুতরফা দাখিলা হিসাব পদ্ধতি পুরাপুরি অনুসৃত হয় না। ফলে হিসাববিজ্ঞানের গ্রহণযোগ্যতাও দিন দিন নষ্ট হচ্ছে।

২. ডুপ্লিকেট হিসাব রক্ষণ :-

অনেক প্রতিষ্ঠান আয়কর ফাঁকি দেওয়ার উদ্দেশ্যে এবং লোক দেখানোর জন্য দুই ধরনের হিসাব তৈরি করেন। এক ধরনের ভুয়া হিসাব তৈরির জন্য প্রতিষ্ঠান অনেক সময় নগদ আদানপ্রদান, ক্রয়বিক্রয়, দেনা-পাওনার পরিমাণ ইত্যাদি ভুলভাবে উপস্থাপন করে।

৩. মুদ্রার ক্রয় ক্ষমতা লিপিবদ্ধকরণ সমস্যা :-

মুদ্রাস্ফীতি অথবা মুদ্রা সংকোচনের ফলে উদ্বর্তপত্রে বিভিন্ন সম্পদ এবং দেনার দফাগুলোর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের প্রকৃত আর্থিক অবস্থা নির্ণয় করা যায় না। অর্থাৎ‍ এক্ষেত্রে হিসাববিজ্ঞান প্রকৃত আর্থিক অবস্থা পরিমাপ করতে ব্যর্থ হয়।

৪. স্থায়ী সম্পত্তি প্রতিস্থাপনে সমস্যা :-

হিসাববিজ্ঞানের নীতিমালা অনুসারে সম্পদের অতীত মূল্যের ওপর একটি নির্দিষ্ট শতকরা হারে অবচয় ধার্য করতে হয়। সম্পদের কার্যকাল শেষে অবচয় হিসাবে রক্ষিত টাকা দিয়ে নতুন সম্পদ ক্রয় করা হয়। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, সম্পত্তিটি প্রতিস্থাপন করতে যে পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন, তা অবচয় হিসাবে সংরক্ষিত হয়নি; কারণ ইতিমধ্যে সম্পত্তিটির বাজার মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। সুতরাং এরূপ পরিস্থিতিতে হিসাববিজ্ঞান ব্যর্থ বলে বিবেচিত হয়।

৫. পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিধিবিধানের ভিন্নতা :-

পৃথিবীর সকল দেশে আইনকানুন, বিধিবিধান, পেশাগত মানের ধরন ইত্যাদি একরূপ নয়। যেমন: কোনো দেশের আয়কর আইনে যে পরিমাণ আয়কর প্রদর্শিত হয়, অপর একটি দেশে সমপরিমাণ আয়ের জন্য সমপরিমাণ আয়কর প্রদর্শিত হয় না। বিধিবিধানের এরূপ বিভিন্নতার জন্য হিসাববিজ্ঞানের মাধ্যমেও বিভিন্ন ধরনের ফলাফল পাওয়া যায়। তবে এরূপ ভিন্নতা সমন্বয়ের মাধ্যমে সমরূপতা আনয়ন করা হলেও তা একটি দুরূহ কার্য। সেহেতুে আপাতদৃষ্টিতে এরূপ বিভিন্নতাকে কেউ কেউ হিসাববিজ্ঞানের একটি ব্যর্থতা মনে করেন।


৬. অগ্রিম অর্থ সমন্বয়ের সমস্যা :-

একটি আর্থিক হিসাবকাল শেষে প্রতিষ্ঠানের সকল অগ্রিম প্রাপ্তি অথবা অগ্রিম প্রদানের সঠিক সমন্বয় করা সম্ভব হয় না, ফলে হিসাববিজ্ঞানে সঠিক চিত্র ফুটে উঠে না।

উপরোক্ত অসুবিধাগুলো থাকা সত্ত্বেও আধুনিক বিশ্বের সব দেশে হিসাববিজ্ঞান একটি সর্বজন স্বীকৃত হিসাব মাধ্যমরূপে স্বীকৃত হয়েছে। তবে হিসাববিজ্ঞানের বিভিন্ন নিয়মকানুনগুলো প্রয়োগের ক্ষেত্রে অধিকতর সতর্কতা অবলম্বন করা আমাদের সকলের উচিত।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ