কমেডি নাটক কাকে বলে | কমেডি নাটকের সংজ্ঞা, উৎপত্তি, প্রকারভেদ, বৈশিষ্ট্য ও উদাহরণ

অ্যারিস্টটল তাঁর 'Poetics' গ্রন্থের চতুর্থ পরিচ্ছেদে কমেডির কথা প্রথম উল্লেখ করেছেন এবং পঞ্চম পরিচ্ছেদে কমেডির চরিত্র সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন।

কমেডির উৎপত্তি :-

কমেডি (Comedy) শব্দটির উৎপত্তি গ্রীক শব্দ 'Komoidia' থেকে। এই শব্দ থেকে লাতিন 'Comoedia' এবং এখান থেকে 'Comedy'এসেছে।

'Komoidia' শব্দের আদি অর্থ হাসিতে সমাপ্ত নাটক অর্থাৎ মিলনান্ত নাটক । 'Kome' ও 'Oide' শব্দের সংযোগ সৃষ্টি 'Komoidia'।

'Kome'-র অর্থ গ্রাম (Village) এবং 'Oide' এর অর্থ গান গাওয়া (Singing)। অর্থাৎ কমেডি মানে গ্রাম্য ভোজন উৎসবের আনন্দ গান অথবা একে বলা যেতে পারে জনপ্রিয় নাট্যকলা।

গ্রীক দেবতা ডায়োনিসাসের পুজো উপলক্ষ্যে শীতকালীন যে উৎসব হত সেখান থেকে কমেডির উদ্ভব। ডায়োনিসাসের মৃত্যু উপলক্ষ্যে ট্র্যাজেডি ও পুনর্জন্ম উপলক্ষে কমেডির সৃষ্টি।

এই আনন্দানুষ্ঠানে ফ্যালিক গান (Phallic Song) গাওয়া হত। গান - বাজনা সহকারে শোভাযাত্রার নাম ‘কোমাস (Comus)। কোমাস থেকেই কমেডির উৎপত্তি।
কমেডি নাটক কাকে বলে

কমেডি নাটক কাকে বলে :-

কমেডি হচ্ছে মিলানন্তক নাটক।

এককথায় কমেডি নাটক কাকে বলে তা বলতে বোঝায়, যে নাটক দর্শককে আনন্দ দেয় তাই কমেডি নাটক


এম. এইচ. আব্রামস্ ও জি. জি. হারফাম তাঁদের 'A Handbook of Literary Terms' এ কমেডির সংজ্ঞা হিসাবে বলেছেন -
"a comedy is a fictional work in which the materials are selected and managed primarily in order to interest and amuse us the characters and their discomfiture engage our pleasurable attention rather than our profound concern, we are made to feel confident that no great disaster will occur, and usually the action turns ant happily for the chief character. The term "Comedy" is customarily applied only to plays for the stage or motion pictures."


কমেডি কি? এ সম্পর্কে অ্যারিস্টটল এ বিষয়ে বলেছেন -
"Comedy is an imitation of man worse than the average worse however not as regards any and every sort of fault but only as regards particular kind.............. The ridiculous may be defined as a mistake or deformity not productive of pain or harm to others."


কমেডি নাটকের প্রকারভেদ বা শ্রেণীবিভাগ :-

নাট্যতত্ত্ববিদরা কমেডিকে কয়েকটি প্রকারভেদে বাশ্রেণীতে ভাগ করেছেন যথা -

১ - রোমান্টিক কমেডি বা কমেডি অব রোমান্স,

২ - কমেডি অব হিউমার,

৩ - স্যাটায়রিক্যাল কমেডি,

৪ - কমেডি অব ম্যানারস,

৫ - কমেডি আব ইনট্রিগ বা ষড়যন্ত্র মূলক কমেডি,

৬ - ফার্স বা প্রহসন কমেডি,

৭ - ব্ল্যাক কমেডি,

৮ - জেন্টন কমেডি।

রোমান্টিক কমেডি কাকে বলে (Comedy of Romance) :

যে কমেডির মধ্যে থাকে রোমান্স অর্থাৎ কল্পনার উচ্ছ্বাস তাকে রোমান্টিক কমেডি বলা যায়।



কমেডি অব হিউমার (Comedy of Humour) :

হিউমার মানে নির্ভেজাল হাস্যরস। এই জাতীয় কমেডিতে বিশুদ্ধ হাস্যরস ব্যবহৃত হয়। একটি আবেগপ্রবা প্রেক্ষাপট সৃজন করা হয়।

বেন জনসনের 'এভরিম্যান ইন হিজ হিউমার' ও 'এভরিম্যান আউট অব হিজ হিউমার, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের “কিঞ্চিৎ জলযোগ”, রবীন্দ্রনাথের 'বৈকুণ্ঠের খাতা'- এই শ্রেণীর কমেডির উদাহরণ

স্যাটায়রিক্যাল কমেডি বা কমেডি অব স্যাটায়ার (Comedy of Satire):

এই শ্রেণীর কমেডিতে প্রকাশিত হয় সামাজিক অপরাধ এবং অপ্রাপ্তির কথা। এই অপরাধ সেই সব মানুষের যারা তাদের শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব করেন। বলা যেতে পারে নাট্যকার বিদ্রূপের কশাঘাত চালান।

এই ধরণের কমেডির উদাহরণ বেন জনসনের 'ভোলপোন' (volpone) বা 'সেরিডান স্কুল ফর স্ক্যান্ডাল'; অ্যারিস্টো ফেনিস এর ‘ক্লাউড’ ও ‘বাউস', মধুসূদন দত্তের 'একেই বলে সভ্যতা' ইত্যাদি।

কমেডি অব ম্যানারস (Comedy of Manners) :

সামাজিক রীতিনীতি আচার-আচরণ প্রভৃতি যে কমেডির বিষয়বস্তু তাকে কমেডি অব ম্যানারস বলে। এখানে থাকে উইট বা বাগবৈদগ্ধ।

এই জাতীয় কমেডি শেক্সপীয়রের 'লাভস লাব লস্ট’, বার্নাড শ-এর 'আর্মস অ্যান্ড দি ম্যান', দীনব ‘বিয়ে পাগলে বুড়ো”, অমৃতলাল বসুর 'কৃপণের ধণ", রবিন্দ্রনাথের 'শেষরক্ষা' ইত্যাদি।

কমেডি অব ইনট্রিগ বা ষড়যন্ত্রমূলক কমেডি (Comedy of Intrigue):

ষড়যন্ত্রের জাল, জটিলতা ঘটনার ঘাত প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে প্রকাশিত হয় কমেডি অব ইনট্রিপে। প্রধান চরিত্র এই ষড়যন্ত্রের শিকার হলেও শেষপর্যন্ত সমস্ত জাল ছিন্ন করে বেরিয়ে আসে।

আরও পড়ুন :- বাংলা নাটকের বৈশিষ্ট্য লেখ?

এই শ্রেণীর রচনা ড্রাইডেনের 'দ্যা স্প্যানিশ ফেয়ার', অমৃতলাল বসুর 'রূপান্নবর্ধনা' রবীন্দ্রনাথের 'বৈকণ্ঠেরখানা' ইত্যাদি।


ফার্স (Erace):

ফার্স এর বাংলা প্রহসন। সমাজ চরিত্রের ভন্ডামী অসংগতি যে নাটকে প্রকাশিত হয় তাকে ফার্স বলা হয়। এই অসংগতি ব্যঙ্গ ও বিদ্রূপসহ ব্যক্ত হয়। এটি লঘুস্তরের কমেডি।

ফার্সের উদাহরণ শেক্সীপীয়রের 'কমেডি অব এররস’ ও ‘হেনরি কোর’; মধুসূদন দত্তের 'একেই কি বলে সভ্যতা’ ও ‘বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ’; দীনবন্ধু মিত্রের 'সধবার একাদশী' ইত্যাদি।

ব্ল্যাক কমেডি (Black Comedy) :

যে কমেডিতে অসূয়া (Cynicism) ও মোহমুক্তি (Disillusionment) প্রতিফলিত তাকে ব্ল্যাক কমেডি বলে। মানব চরিত্র অজানা শত্রুর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে নিজের উপর আস্থা হারিয়ে ফেলে। এই অবস্থাটাই জীবনের অসংগতিরূপে প্রকাশিত। তবে এ কমেডি মূলত ফরাসী দেখা মেলে। এগুলিতে অ্যাবসার্ড ভাবনা রয়েছে।

যেমন আয়েনেস্কোর লা চেয়ার বাজেনের ‘রাইনো', মোহিত চট্টোপাধ্যায়ের 'রাজরক্তা, বাদল সরকারের 'বাকি ইতিহাস'।

জেন্টন কমেডি :

এছাড়া কেউ কেউ জেন্টল কমেডি বা ক্ল্যাসিক্যাল কমেডি-র কথাও বলেছেন। জেন্টল কমেডির বিষয় চরিত্রের নৈতিকতা। ক্ল্যাসিক্যাল কমেডি মূলত অ্যারিস্টটলীয় ধ্রুপদীরা প্রাচীন কমেডি।

ট্রাজি কমেডি কাকে বলে :-

ট্রাজি কমেডি বলতে এমন একটি কমেডি উপন্যাস বা নাটককে বোঝায় যেখানে নায়ক বা নায়িকার জীবনে দুঃখজনক ঘটনার ফলে তাদের অবস্থা দয়নীয় হয়ে পড়ে।

এই ধরনের কমেডিতে থাকে ব্যর্থতা, মৃত্যু, পরাজয়, বিপর্যয় ইত্যাদি যা পাঠক বা দর্শকদের কাছে দয়া ও সহানুভূতি সৃষ্টি করে।

শেক্‌সপিয়ারের রমিও অ্যান্ড জুলিয়েট, আর্থার মিলারের ডেথ অফ এ সেলসম্যান প্রমুখ উদাহরণ।

ডার্ক কমেডি কাকে বলে :-

ডার্ক কমেডি বলতে এমন কমেডিকে বোঝায় যেখানে মর্মস্পর্শী, গভীর ও জটিল বিষয়গুলো সাধারণত হাস্যকর উপায়ে তুলে ধরা হয়। এর মধ্যে থাকে সমাজের বিভিন্ন সমস্যা, মানব মনোবৃত্তির গভীর পরিস্থিতি, মৃত্যু, সংশয়, দুঃখ ইত্যাদি।

ডার্ক কমেডির মূল উদ্দেশ্য হলো সমাজের কোন ব্যাপক সত্যকে গুন্ডামি ছাড়াই তুলে ধরা। এতে কখনো কখনো অসুবিধাজনক হাস্য থাকতে পারে। এর কিছু জনপ্রিয় উদাহরণঃ Catch 22, MASH, Night, Waiting for Godot ইত্যাদি।

সার্থক কমেডি নাটক :-

সার্থক কমেডি নাটক বলতে এমন একটি কমেডি নাটককে বোঝায় যার মূল উদ্দেশ্য হলো দর্শকদের মনোরঞ্জন করার সাথে সাথে কোনও সার্থক বার্তাও তুলে ধরা। এর কিছু বৈশিষ্ট্য:

১. এতে সমাজের বিভিন্ন সমস্যাকে স্পর্শ করা হয় এবং সমাধানের পথ নির্দেশ করা হয়।

২. গভীরভাবে মানুষের মনোভাব এবং প্রকৃতিকে তুলে ধরা হয়।

৩. বাস্তবতাকে স্পর্শ করা হয় এবং বোধগম্য প্লট থাকে।

৪. লোকজীবন, রীতি-নীতি ও চরিত্রকে বেশ ভালোভাবে তুলে ধরা হয়।

৫. দর্শকদের মাঝে সচেতনতা তৈরিতে সাহায্য করে।

বাংলা কমেডি নাটকের বৈশিষ্ট্য :-

কমেডির বৈশিষ্ট্য গুলো সম্পর্কে নীচে আলোচনা করা হলো -

১ - ‘কমেডি হল নিম্নতর নরনারীর জীবনবৃত্তের অনুকরণ"। অর্থাৎ সাধারণ মানুষ চিত্রিত হয় এখানে।

২ - অ্যারিস্টটলের মতে কোন জীবন আদর্শ নয়, সামাজিক বৈচিত্র্যপূর্ণ জীবন লেখা পরিবেশিত হয়েছে কমেডিতে।

৩ - কমেডির প্রধান রস হাসারস। তবে হাস্যরসে অশ্লীল বা ভাঁড়ামি নয়। বরং সেখানে জীবনের অসংগতি প্রকাশিত।

৪ - কমেডি কোনো জটিলতাকে ব্যক্ত করে না, বরং জীবনের উপরিতলশায়ী ভাব প্রকাশিত হয়।

৫ - কমেডি মানুষকে আনন্দ দান করে। ফলে গুরুগম্ভীর ভাব নয়, মিলন প্রীতির ছবি দেখা যায়।

৬ - কমেডিতে অনেক চরিত্রের সমাবেশ হয়।

ট্রাজেডি ও কমেডির পার্থক্য :-

ট্রাজেডি ও কমেডির মধ্যে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য রয়েছে:

১. ট্রাজেডিতে ঘটনার শুরু থেকেই দুঃখজনক ঘটনা ঘটে এবং শেষ পর্যন্ত সেটাই থাকে। আর কমেডিতে শুরুতে সুখের ঘটনা ঘটে, শেষে হঠাৎ করেই দুঃখজনক ঘটনা ঘটে।

২. ট্রাজেডিতে নায়ককে অবশেষে পরাজয়ের সম্মুখীন হতে হয়। কমেডিতে নায়ক জয়ী হন।

৩. ট্রাজেডি থেকে দর্শকরা বেদনা ও জ্ঞান লাভ করে। আর কমেডি থেকে আনন্দ ও হাসি লাভ করে।

৪. ট্রাজেডিতে চরিত্র ও ঘটনার উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। কমেডিতে মূলত ঘটনার উপর জোর দেওয়া হয়।

৫. ট্রাজেডির ভাষা সাধারণত গভীর এবং সংবেদনশীল হয়। আর কমেডির ভাষা হালকা হাস্যময় শিল্পসচ্ছল হয়।

কমেডি ও প্রহসনের মধ্যে পার্থক্য :-

কমেডি ও প্রহসনের মধ্যে কিছু মৌলিক পার্থক্য রয়েছে:

১. কমেডির মূল উদ্দেশ্য হলো মানুষকে হাসানো। কিন্তু প্রহসনের মূল উদ্দেশ্য হলো কোনো ব্যক্তি বা বিষয়কে ঠেলানো।

২. কমেডিতে মানব জীবনের ছোটখাটো ব্যাপারগুলোকে তুলে ধরা হয় যা সবার সাথেই সাদৃশ্য রাখে। কিন্তু প্রহসনে কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা বিষয়কে লক্ষ্য করে কটাক্ষ করা হয়।

৩. কমেডিতে মিছিল হাস্যরস থাকে। সবার সাথে একাকার হওয়া যায়। কিন্তু প্রহসনে হাস্যরস বিরক্তিরস হয়ে উঠতে পারে।

৪. কমেডির চরিত্রগুলো বাস্তবিক এবং সহানুভূতি প্রদর্শন করার মত হয়। কিন্তু প্রহসনের চরিত্রগুলো বাস্তবিক হয় না এবং সহানুভূতি থাকে না।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

3 মন্তব্যসমূহ

Please do not enter any spam link in the comment box.